এখানে কোথাও কেউ নেই!
পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে। শ্রাবণ মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে। সেই অলৌকিক সঙ্গীত শোনার জন্য আমি থাকব না। কোনো মানে হয়?
সত্যি যাদুকরেরা না থাকলে এমন সব জোছনা, বৃষ্টির সেতার, অলৌকিক সঙ্গীতের কোনো মানে হয়না। মানে হয়তো হয় কিন্তু প্রাণে লাগে না।
এমনই এক যাদুকর জন্মেছিলো এই আমাদের জন্মভূমিতে। তাঁকে পেয়েছিলাম জন্মের যা কিছু সার্থকতা সেসবের কাতারে। আর কেউ নন তিনি, হুমায়ুন আহমেদ এক কিংবদন্তির নাম। প্রতিটি বইপোকা থেকে শুরু যার খুব একটা পড়ার অভ্যাস তার মনে দাগ কেটেছে এই কথাসাহিত্যিকের গল্পের যাদু। ছোট থেকে বড় সকলেরই পছন্দের ব্যক্তিত্ব। তার রচিত গল্প- উপন্যাস পড়েনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টকর।
স্বাধীনতার পরবর্তীতে শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন হিসেবে দীর্ঘ ৪০ বছর তার লেখনীতে আকৃষ্ট করে রেখেছিলেন হাজারো পাঠকগণকে। তার কলমে ছিল এক ধরনের যাদু যাতেই ছুঁয়ে দিতেন তাই কেমন হৃদয়ে তীরের মত বিঁধে যেত।
শুধু যে গল্প বা উপন্যাস তাই নয়, তিনি একাধারে লিখে গেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, ও গানেও রেখেছেন অসামান্য কৃতিত্ব। সিনেমা জগতেও রেখে গেছেন নিজের পদচিহ্ন।
১৯৭২ সালে হুমায়ুন আহমেদ এর প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে' প্রকাশিত হওয়ার পর সাথে সাথেই তার জীবনে এক অন্য মাত্রা যোগ হয়। জীবদ্দশায় রচনা করেছেন ২০০ টির ও বেশি বই। অর্জন করেছেন বাংলাদেশের 'বেস্ট সেলার' বা সর্বাধিক বই বিক্রির স্বীকৃতি।
হুমায়ুন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া গ্রামের কুতুবুপুর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক ডাক নাম ছিল কাজল। ছোট বেলায় তিনি যে খুব ভালো ছাত্র ছিলেন তা কিন্তু না। তবে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠার পর পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা পাল্টে দেয় পরিস্থিতি। ফলস্বরূপ এসএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন হুমায়ুন আহমেদ। এইচএসসি তেও মেধা তালিকায় জায়গা করে নেন এবং ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ বিভাগেই যুক্ত হন প্রভাষক হিসেবে এবং আমেরিকার নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার সায়েন্সে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন কালজয়ী এই লেখক। শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও লেখালেখিতে নিজের জাদু দেখানোর জন্য অধ্যাপনা পেশা থেকে অব্যাহতি নেন হুমায়ুন আহমেদ।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের জন্য হুমায়ুন আহমেদ এর প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে' প্রকাশিত হওয়ার কথা থাকলেও তা হয় ১৯৭২ সালে। তার কলমের জাদুতে বাংলা উপন্যাস দেখেছে এক নতুন দিগন্তের পথ। তার দ্বিতীয় গ্রন্থ 'শঙ্খনীল কারাগার'- এ সম্পূর্ণ নতুন করণ-কৌশলে উপস্থিত হয়েছিলেন। বাংলা উপন্যাস দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের লেখনীতে আকৃষ্ট ছিল। সেখান থেকে হুমায়ুন আহমেদ-ই একাই এপার বাংলার শতবর্ষের ঋণ মিটিয়ে দিয়েছেন এবং একইসাথে বাংলা সাহিত্যের রাজত্ব কলকাতা থেকে টেনে নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে।
অতি সাধারণ কোনো কথাকে সহজ ভাষায় অসাধারণ করে তোলার অশেষ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। অতিবাস্তব ঘটনাকে সকলের মাঝে বিশ্বাসী করে উপস্থাপনের ছিলো অদম্য ক্ষমতা। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন ইউরোপীয় আদলের বাইরে গিয়েও সফল ও গুণসম্পন্ন উপন্যাস সৃষ্টি করা সম্ভব। তার লেখনীকে ম্যাজিকাল রিয়ালিজম বা জাদু বাস্তবতা ধরনের ক্যাটাগরিতে ফেলানো হয়ে থাকে। তার লেখনীর নেতিবাচক চরিত্রও অনেক সময় সকলের কাছে দরদী ও সহমর্মি হয়ে উঠে।
তিনি যে পাঠকদের নিকট বহুল জনপ্রিয় এবং পছন্দের ব্যক্তিত্ব ছিলেন তার উদাহরণসরূপ বলা যায় ১৯৯০ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একুশে বই মেলায় বিক্রিত সর্বাধিক বইয়ের লেখক ছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। তার লিখিত অনেক বই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং অনেক গল্পই স্কুল কলেজ এর পাঠ্যসূচিতে জায়গা করে নিয়েছে। আজও তার বই কিনতে হাজারো মানুষ ভিড় করে বই মেলায়।
তার সৃষ্ট চরিত্র হিমুর সাথে পরিচয় নেই এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। হুমায়ুন আহমেদ এর চেয়েও অনেক বেশি জনপ্রিয় এবং পরিচিত হিমু চরিত্র বলে ধারণা করা হয়। অনেক কিশোর ই তাদের কৈশোরে নিজেকে কখনও না কখনও হিমু হিসেবে কল্পনা করে থাকেন। হিমুর ভবঘুরে জীবন, হলুদ পাঞ্জাবি সকলের কাছেই পছন্দের। তাছাড়াও মিসির আলী সমগ্র, রূপার মতো মায়াবতী প্রেমিকা, শুভ্রর মতো অতি পবিত্র চরিত্র হুমায়ুন আহমেদ এর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। হুমায়ুন আহমেদ-ই আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞানের পথিকৃৎ। 'তোমাদের জন্য ভালোবাসা ' তার রচিত প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী।
লেখালেখির পাশাপাশি টেলিভিশন জগতেও বেশ কিছু নাটক ও টেলিফিল্ম রচনা করেছেন হুমায়ুন আহমেদ। তার রচিত প্রথম টেলিভিশন নাটক 'প্রথম প্রহর' রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠে দর্শকদের কাছে। এছাড়াও অত্যন্ত জনপ্রিয় কিছু নাটক বহুব্রীহি, এসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, আজ রবিবার, তারা তিনজন, উড়ে যায় বকপক্ষীসহ আরও অনেক নাটক তিনি রচনা করেছেন। তার রচিত নাটক ' কোথাও কেউ নেই ' এর বহুল আলোচিত চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসি বন্ধের জন্য সারাদেশে মিছিল বের করেছিল মানুষ। পোস্টার লাগিয়েছিল ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে। কতটা জনপ্রিয় এবং মানুষের মনে জায়গা করে নিলে মানুষ এই কাজ করতে পারে বোঝাই যায়।
বাংলা চলচ্চিত্র জগতেও তিনি একাধারে চলচ্চিত্রকার ও পরিচালক ছিলেন। তার প্রথম চলচ্চিত্র ছিল মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক 'আগুনের পরশমণি '। 'শ্রাবণ মেঘের দিন' তার নির্মিত চলচ্চিত্র বাংলা ভাষার নির্মিত শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলোর একটি। 'শ্যামল ছায়া' চলচ্চিত্র টি ২০০৬ সালে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ থেকে অস্কার পুরষ্কারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। 'ঘেটুপুত্র কমলা' ছিল তার পরিচালনায় সর্বশেষ সিনেমা। তিনি নিজের সিনেমা এবং নাটকের জন্যই গান রচনা করতেন। তাছাড়া সেভাবে গান রচনা করতেন না তবে তার গানগুলোও ব্যাপকভাবে সাড়া পেয়েছিল দর্শকদের মাঝে।
বৈবাহিক জীবনে দুইবার বিবাহে আবদ্ধ হন। ১৯৭৩ সালে তার প্রথম বিবাহ হয় গুলকেতিন আহমেদ এর সাথে। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে প্রথম স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে বিয়ে করেন মেহের আফরোজ শাওন কে। ব্যক্তি জীবনে কিছুটা অন্তর্মুখী মানুষ ছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। নুহাশপল্লীতে ৯০ বিঘা জমির উপর বাগানবাড়ি রয়েছে হুমায়ুন আহমেদের এবং তিনি সেখানে থাকতেই ভালোবাসতেন।
জীবনে বহু সম্মানজনক পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন এই কিংবদন্তি লেখক। বাংলা একাডেমী পুরষ্কার, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার, শিশু একাডেমী পুরষ্কার তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘদিন ক্যান্সার এর সাথে লড়াই করার পর ২০১২ সালের ১৯ জুলাই ক্যান্সারের কাছে হার মেনে না ফেরার দেশে চলে যান সকলের প্রিয় নন্দিত লেখক হুমায়ুন আহমেদ।
তিনি হয়তো চলে গেছেন এই পৃথিবী থেকে কিন্তু মানুষের হৃদয়ে আজও একইভাবে বিরাজ করেন। আজও সাহিত্য জগতের শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন হিসেবে রয়েছেন পাঠকদের মনে। আজ এই কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিকের জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।