ছবি জীবনের কথা বলে
কিছুদিন আগে চারুকলায় পড়ুয়া সুনামগঞ্জের শিক্ষার্থীরা আয়োজন করেছিল ‘অপ্রাকৃত প্রকৃতি’ নামের একটি শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। অতিমারী তাদের গৃহবন্দি করে রাখে। তবে এ সময়টি তারা কাজে লাগিয়ে যেসব ছবি এঁকেছে তা নিয়ে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে।
সুনামগঞ্জ ছোট শহর। শুক্রবার ১৯ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৫টায় সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির সংগ্রহশালায় পৌঁছে দেখলাম গ্যালারির মতোই এই রুমটি। সেখানে তিনদিনের এ প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন একাডেমির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুল আবেদীন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সুনামগঞ্জ জেলা উদীচীর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, জেলা কালচারাল অফিসার আহমেদ মঞ্জুরুল হক চৌধুরী পাভেল, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অঞ্জন চৌধুরী প্রমুখ। এই প্রদর্শনীতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান চারুকলার শিক্ষার্থীদের ২০০টির বেশি ছবি প্রদর্শন করা হয়।
আয়োজকরা জানান, সমগ্র সুনামগঞ্জের মধ্যে চারুকলায় পড়ছে হাতেগোনা কয়েকজন। সুনীল শুক্লা ছিলেন প্রথম যিনি সত্তরের দশকে পাশ করে বের হন। পরবর্তীতে ধ্রুব এষ, যিনি প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে এক নামে বিখ্যাত। রুনা শাহীন আরা লেইস, প্রথম মেয়ে হিসেবে যিনি নব্বইয়ের দশকে গ্রাফিকস ডিজাইন এ পড়েছেন। তবে যারাই এই বিষয়টি বেছে নিয়েছেন, তারা খুব আগ্রহ করেই নিয়েছেন এবং স্বাচ্ছন্দ্যে লেখাপড়াও করছেন।বর্তমানে বেশ কিছু শিক্ষার্থী চারুকলার বিভিন্ন শাখায় পড়ছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকেন শিক্ষার্থীরা। খুব একটা ছুটি পাওয়া যায় না। তাই চাইলেও একত্রিত হয়ে এমন প্রদর্শনীর আয়োজন সম্ভব হয়না। তবে করোনাকালীন এই সময়টাকে তারা কাজে লাগিয়েছেন। সবার পরিশ্রমের ফলে এই প্রথম জোট বেঁধে এমন আয়োজন করতে পেরেছে সুনামগঞ্জের চারুকলায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। এখন থেকে নিয়মিত এমন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে বলেই প্রত্যাশা তাদের।
১৯৭৪ সালে সার্কিট হাউসে একটি চিত্র প্রদর্শনী হয়েছিলো যার আয়োজন করেছিলেন শিল্পী সুনীল শুক্লা। সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে যায় সবকিছু। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সবক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। অতিমারী ছাপ ফেলে গেছে জীবনের সকল ক্ষেত্রে। সুনামগঞ্জের ছেলেমেয়েরা শিল্পের এই মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলবে বোঝা যাচ্ছে। তাদের এই আয়োজন আমাদের মুগ্ধ করেছে।
প্রদর্শনীর মন্তব্য বইটিতে সকলেই তাদের মন্তব্যে উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, এই আয়োজন না হলে তারা জানতেই পারতেন না সুনামগঞ্জের ছেলেমেয়েরা চিত্র শিল্পে এতোটা এগিয়ে আছে।
ইউনির্ভাসিটি অব ডেভেলাপমেন্ট অল্টারনেটিভ এর ড্রয়িং এন্ড পেইন্টিং বিভাগের শিক্ষার্থী শুভ্র তালুকদার বলেন, সুনামগঞ্জের মানুষ এখনো চারুকলা বিষয় নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখায় না বা এখনো বোঝে না। আমরা যারা এই বিষয় নিয়ে ঢাকায় পড়াশোনা করছি, আমরা খেয়াল করেছি আমাদের সুনামগঞ্জের শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুব কম। অন্যান্য জেলার শিক্ষার্থীর সংখ্যা এই বিষয়ে অনেক বেশী। তাই আমরা চেয়েছি এই উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকদের সবাইকে এই বিষয়ে জানাতে যে এই বিষয় নিয়েও পড়াশোনা করা যায়। আর আমরা এই প্রর্দশনীতে দেশের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীদের ছবিও রেখেছি। সেই সাথে সুনামগঞ্জের চিত্রশিল্পীদের ছবিও রেখেছি। আমরা চেয়েছি নবীণ-প্রবীণদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এটি সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক।
শিক্ষার্থী শুভ্র তালুকদারের আঁকা ছবি জাতির পিতা,পরিযায়ী পাখী দর্শকদের মন জয় করে। শুভ্রর আঁকা অত্যন্ত নিখুঁত। প্রদর্শনীতে আমার প্রায় প্রতিদিনই শুভ্রর ছবির সামনে অনেকটা সময় কেটেছে। সুযোগ থাকলে পরিযায়ী পাখী নিয়ে আসতাম। তন্দ্রা দাসের অর্ধায়বব তিন নারী, নাম ‘ত্রিনিটি’, দূর থেকে দেখলে ভারী জীবন্ত মনে হয়। উল্লেখ্য, এই ছবিটি কোন এক চিত্র সমঝদার ক্রয় করেছেন। তন্দ্রার অপর চিত্রটিও আমার খুব পছন্দ। একজন শিল্পীর নাম শুভ রায় যার চিত্রটির নাম ‘মুক্তিযোদ্ধা’।ঢাবির চারুকলার গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী রুনা শাহীন আরা লেইস বলে, ’আমরা যখন এই বিষয়ে লেখাপড়া করেছি, তখন মানুষ খুব একটা এই বিষয় সম্পর্কে জানত না। তবে এখন সুনামগঞ্জের অনেকেই চারুকলা নিয়ে পড়ছে। এই বিষয় জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ব্যাপারটা খুবই ভালো লেগেছে। এমন আয়োজন চারুকলার প্রতি আরো আগ্রহ বাড়াবে বলে মনে করি।
ইমরান হোসেন মাসুম নামের চিত্রশিল্পী তার ছবি আঁকার গল্প জানায় আমাকে। তাদের বাসা মাদ্রাসার পাশে হওয়ায় তাকে শৈশবে মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। তার বড় ভাই তার ছবি আঁকার আগ্রহ দেখে তাকে চারুকলায় পড়তে সহায়তা করেন। তবে এই পথ মসৃণ ছিলো না। বর্তমানে সে ইউডা তে পড়ে। তার মাধ্যম জল রং। বেশীর ভাগ ছবিতে প্রকৃতি প্রধান বিষয়। সুনামগঞ্জের প্রাকৃতিক দৃশ্যের সৌন্দর্য সে জল রংয়ে ফুটিয়ে তুলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ডিপার্টমেন্ট অব প্রিন্টমেইকিংয়ের শিক্ষার্থী তাফান্নুম কাগজী বলেন, করোনা মহামারী চলাকালীন এই সময়ে সব কিছুই বন্ধ ছিল। ক্লাস বন্ধ থাকায় কোন কিছুই করা যাচ্ছিল না। তাই হাতের কাছে যে উপকরণ পেয়েছি তা দিয়েই কাজ করেছি। তখন আমরা সুনামগঞ্জের যারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলাতে পড়াশোনা করি তাদের সবাইকে নিয়ে কিছু করা যায় কিনা চিন্তা করি। পরে দেখা গেছে আমাদের চিন্তা-ভাবনার সাথে অন্যদের চিন্তা-ভাবনাও মিলে গেছে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিই সুনামগঞ্জের শিক্ষার্থীসহ তরুণ প্রজন্মের জন্য কিছু একটা করতে হবে যাতে এই জনপদের মানুষ চারুকলা কি এবং কেন তা বুঝতে পারে এবং এই বিষয়ে আগ্রহ বাড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব গ্রাফিকস ডিজাইনে পড়াশোনা করা তাফান্নুম কাগজীর জমজ বোন ইরতিজা কাগজী বলেন, পৃথিবীতে ছবি দিয়েই অনেক কিছু বোঝানো সম্ভব। যেখানে হাজার হাজার লাইন লিখা দিয়ে অথবা গল্প বলে যেখানে মনের ভাব, আবেগ, অনুভূতি, কষ্ট, হাসি-কান্না বোঝানো লাগে সেখানে একটি ছবি সব কিছু একভাবে বোঝাতে সক্ষম। এমন অনেক দেশ আছে যেখানে আমাদের ভাষা বোঝে না তাদের কাছেও একটি ছবি এঁকে আমি কি বলতে চাই তা বোঝানো সম্ভব। মানে ছবির মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান করা যায়। তিনি বলেন, ‘আমি অনেকগুলো ছবি এঁকেছি। অনেকগুলো গান, কবিতা দিয়ে আমি ছবি এঁকেছি। এক একটি ছবিতে এক একজন চিত্রশিল্পীর আবেগ, অনুভূতি, প্রতিবাদ, কষ্ট, হাসি-কান্না প্রকাশ পায়। প্রদর্শনীতে ইরতিজা কাগজীর কাজই আছে ৭৯টি। পছন্দের গান শুনতে শুনতে, বিশেষ করে ‘বিটিএস’-এর গান তাঁর প্রচন্ড প্রিয়, কল্পনায় যে-চিত্র ভেসে উঠেছে তারই চিত্রায়ান করেছেন পোস্টার কালারে সঙ্গে কোলাজের মিশ্রণে এবং ‘অপ্রাকৃতপ্রকৃতি’কে কিংবা বলা যায় বিমূর্তকে মূর্তায়িত করতে করতে সিরিজটির নাম দিয়েছেন, ‘গল্প’।
জয়ন্ত কুমার তালুকদারের অসাধারণ একটি চিত্রকর্মের নাম ‘রাজকন্যা’। পিতার সঙ্গে কন্যার অন্তরঙ্গ মুহূর্তর চিত্রের পিভিসি এনগ্লোভিং (কাঠখোদাই) পদ্ধতির শৈল্পিক সৃষ্টি। পিতা শেখ মুজিবুর রহমান আর কন্যা শেখ হাসিনা। অসাধারণ এই চিত্রকর্ম ছিল প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষন। প্রদর্শনীতে খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী সুনীল শুক্লার আঁকা ‘অপরাজেয় বাংলা’ আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়ে আসি। সুনীল শুক্লার ম্যারিল্যান্ডের বাসায় বেড়াতে গেলে ২০১৮ তে ছবিটি শিল্পী আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির চারুকলার প্রশিক্ষক দীপেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী স্বপনের আঁকা হাসনরাজা, ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী রুনা শাহিন আরা লেইসের জামদানী মোটিফে টেরাকোটার কাজ, সিরিজ ‘ইভিল আই’ এর তিনটি ছবি প্রদর্শনীতে ছিলো।
প্রদর্শনীতে খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী সুনীল শুক্লা, হ্যারল্ড রশীদ, সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমির চারুকলার প্রশিক্ষক দীপেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী স্বপন, ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী রুনা শাহিন আরা লেইস, শুভ রায়, তারেক আমিন, জয়ন্ত কুমার তালুকদার ও রত্নাস্বর সূত্রধরের ছবি রাখা হয়। এছাড়া শিক্ষার্থী তাফান্নুম কাগজী, ইরতিজা কাগজী ও ঋতুরূপা তালুকদার সাথী, রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃণাল বণিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অরুণ দ্যুতি চক্রবর্তী ও জয় তালুকদার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌম্য রায় অমিত, ইউডার শিক্ষার্থী শুভ্র তালুকদার, ইমরান হোসেন মাসুম, কারিশমা দেবী মনি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তন্দ্রা কৃতী ও কান্তা সরকার, সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির অয়ন চৌধুরী, ঢাকা আর্ট কলেজের শিক্ষার্থী প্রান্ত চন্দের ছবি প্রদর্শন করা হয়।
১৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়েছে ‘অপ্রাকৃতপ্রকৃতি’ শিরোনামের এই চিত্র প্রদর্শনী। সুনামগঞ্জের মানুষেরা সত্তরের দশকে দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা শুনতেন। তাই একদিন এ শহরে দর্শকরা দর্শনীর বিনিময়ে গ্যালারীতে ছবি দেখতে আসবেন বলে আশা থাকলো। আশার কথা, প্রদর্শনীতে কিছু ছবি কিনেছেন কিছু চিত্রপ্রেমী দর্শক। মেয়র নাদের বখত এই আয়োজনের অন্যতম শক্তি ও সাহসদাতা। সুনামগঞ্জের চারুশিল্পীদের দলীয় প্রদর্শনীর শেষ দিনে সুনামগঞ্জ পৌর মেয়র নাদের বখত অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের সঙ্গে প্রদর্শনীতে বেশ কিছুটা সময় কাটান এবং চারুকলার শিক্ষকদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মিটিংয়ে অংশ নিয়ে প্রদর্শনী সম্পর্কে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন। এ সময় তরুণ শিল্পীদের পক্ষে শুভ্র তালুকদার নগরপিতাকে তার আঁকা প্রতিকৃতি উপহার দেন এবং সার্বিক সহযোগিতার জন্য সকল চারুশিল্পীরা তার প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।