ভাষা আন্দোলনে নারীর ভূমিকা
বাঙালী জাতির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন হলো অন্যতম গৌরবময় ঘটনা। পাকিস্তানিদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে এটিই ছিলো বাঙালীর প্রথম আন্দোলন। এই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। রক্তের বিনিময়ে মাতৃষাভার সম্মান প্রতিষ্ঠা করে যায় বাংলা মায়ের সন্তানেরা। রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, শফিউরসহ নাম না জানা আরো অনেকেই জীবন দিয়েছিলেন বাংলা ভাষার জন্য। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে কেবল পুরুষরাই নয়, নারীরাও অবদান রেখেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমরা অধিকাংশই এ বিষয়ে জ্ঞাত নই।
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির দিন সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারি ছিলো। কিন্তু বাংলার সাহসী সন্তানেরা এই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলের সিদ্ধান্ত নেয়। পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে তারা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। বেলা সোয়া এগারটায় মিছিলে পুলিশেরা অক্রমণ চালায়। প্রথমে কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে ও এরপর গুলিবর্ষণ করে মিছিলের মধ্যে। এতে শহীদ হন অনেকেই। এছাড়াও অনেক ছাত্র-ছাত্রী গ্রেপ্তার হয় সেদিন। জানলে অবাক হবেন যে সেই মিছিলের প্রথম সারিতে মেয়েরা ছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশস্থলটির বাইরে পুলিশ লাঠি দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছিল। অনেকে লাঠির ওপর দিয়ে লাফিয়ে এবং নিচ দিয়ে বের হয়ে গেলেও মেয়েরা তা করেননি। টানাটানি করে সেই ব্যারিকেড ভেঙ্গে দিয়েছিলেন তারা। সেদিন পুলিশের লাঠিতে আহতও হয়েছিলেন অনেক ছাত্রী।
শুরু থেকেই ভাষা আন্দোলনের সাথে নারীরা জড়িত ছিলো। এরপর বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না পাওয়া পর্যন্তু পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও থেমে থাকেননি। ১৯৪৭-১৯৫১ এই চার বছরের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা ছিলো মাত্র ৮০-৮৫ জন। আবার আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন আরো কম সংখ্যক। কিন্তু আন্দোলনের জন্য দরকার ছিলো আরো বেশি ছাত্রীর। আন্দোলনের কাজের পাশাপাশি আরো ছাত্রী সংগ্রহ করার কাজও করতেন তাঁরা। বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে গিয়ে ছাত্রীদের আন্দোলন সম্পর্কে বলতেন তাঁরা। আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে তাদের বুঝিয়ে বলতেন। এভাবেই একসময় একটি বিশাল সংখ্যক নারী ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন।
আজ আমরা এমনই কিছু সাহসী নারী সম্পর্কে জানবো।
রওশন আরা বাচ্চু : ১৯৩২ সালে মৌলভীবাজার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন রওশন আরা বাচ্চু। বরিশাল বি.এম. কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যয়নরত ছিলেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবিতে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। ২১ শে ফেব্রুয়ারির দিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত হলে মেয়েদের যে দলটি প্রথম বের হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে তিনি ছিলেন সেই দলে। মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে তিনি আহত হন। পরবর্তীতে তিনি কুলাউড়া গালর্স স্কুল, ঢাকার আনন্দময়ী গালর্স স্কুল, নজরুল একাডেমীসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন তিনি।
ড. সুফিয়া আহমদ: সুফিয়া আহম্মদ এর জন্ম ফরিদপুর জেলায়। তিনি রাজমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রথম সারিতে ছিলেন তিনি। পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙ্গার নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠির আঘাতে সুফিয়া আহম্মদ আহত হন। পরবর্তীতেও তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপিকা হিসাবে যোগদান করেন।
হামিদা রহমান: বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন হামিদা রহমান। ১৯৪৮ সালে পুনরায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আসলে ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হামিদা রহমানের নেতৃত্বে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” ধ্বনিতে একটি মিছিল বের হয়েছিলো। এর কারণে পরবর্তীতে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানাও জারি হয়।
ড. হালিমা খাতুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী ছিলেন ড. হালিমা খাতুন। ১৯৩৩ সালের আগস্ট মাসে বাগের হাট জেলার বাদেকা পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় তিনি আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের লক্ষ্যে তিনি প্রস্তুতিমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২১ শে ফেব্রুয়ারির সকালে তাঁর দায়িত্ব ছিল পিকেটিং করা। পরবর্তীতে তিনি খুলনা গালর্স কলেজ, রাজশাহী কলেজ ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেছেন।
শামসুন নাহার আহসান: ’৫২ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারির দিন তিনিও ছিলেন মিছিলে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করার সময় পুলিশের আক্রমণের মুখে তিনি তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে বের হয়ে আসেন। পুলিশের টিয়ার গ্যাস ও লাঠি পেটার মধ্যে দিশেহারা হয়ে পড়েন শামসুন নাহার। আহতও হন তিনি। এরপর পাশে একটি কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। এ সময় কাঁটাতারের বেড়ায় আটকা পড়ে তার শরীর আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
লায়লা নূর: লায়লা নূরের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১ অক্টোবর কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গাজীপুর গ্রামে। ১৯৪৮ সাল থেকে বায়ান্নর সব আন্দোলনেই তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৫৫ সালে ২১ শে পালনের সময় গ্রেফতার হন তিনি। এরপর কারাগারে নির্যাতনের শিকারও হতে হয় তাকে। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন তিনি।
ড. শরিফা খাতুন: জন্ম তৎকালীন ১৯৩৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ফেনী মহকুমার শশ্মদ ইউনিয়নের জাহানপুর গ্রামে। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ইডেন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়তেন। উমা গার্লস স্কুলের ছাত্রী থাকাকালীন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দু’একটি মিছিলেও তিনি অংশ নেন। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে ২১ শে ফেব্রুয়ারি পালনে মিছিলের মধ্যে তিনি গ্রেফতার হন। কারাগারে ছিলেন কিছুদিন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে পড়তেন। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময়ও তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।
এছাড়াও ড. সুফিয়া আহমদ, বোরখা শামসুন, মমতাজ বেগম, সুরাইয়া হাকিম, সুরাইয়া ডলি, দৌলতুন্নেসা খাতুন সারা তৈফুর, জুলেখা হক, চেমন আরা প্রমুখ অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ভাষা আন্দোলনে। দেশ ও জাতির দুঃসময়ে সামনের দিকে এগিয়ে এসেছেন এসব সাহসী নারী।