Skip to content

২৯শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | মঙ্গলবার | ১৩ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পথের পাঁচালী

বাংলা সাহিত্যে "পথের পাঁচালী" অদ্বিতীয় এক উপন্যাস। এখনও পথের দেবতা যেন আমার মুখোমুখি বসে আমাদের অভিযুক্ত করে বেড়ায়। আর তখন যদি একে আমরা কোনোমতে চলচ্চিত্রায়ন করতে পারি তবে সেই পাঠকরাও আগ্রহী হয়ে উঠবে। 

সে সময় সিনেমার জগতে গ্রিক দেবতার মতো এক সুপুরুষের আবির্ভাব ঘটে। আনাড়ি এই যুবকের গায়ে বয়ে গেছে আরো দুই প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী ও সাহিত্যিকের রক্ত। কিন্তু অবাক করার ব্যাপার হল, সত্যজিতের "পথের পাঁচালী" আর বিভূতিবাবুর পথের পাঁচালীতে আছে আকাশ পাতাল তফাৎ। 

 
ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং বলে একটা টার্ম বহুদিন ধরে প্রচলিত। সিনেমায় হয়তো বইয়ের মতো এত বর্ণনা থাকবেনা, কিন্তু এখানে একজন ডিরেক্টর দর্শককে ভাবনার সুযোগ দিবে, অবাধ্য হওয়ার সুযোগ দিবেনা। একটি লেখাকে একেকজন একেক আঙ্গিকে বিচার করবে। সত্যজিৎ রায় সেভাবেই সাজিয়েছিলেন চিত্রনাট্য। কেউ যদি "শশ্যাঙ্ক রেডেম্পশন" কিংবা "গডফাদার" এর মত মুভি দেখে থাকে – একথা নিশ্চিত হয়েই বলা যায় তারা চলচ্চিত্রটিকেই সেরা বলবে। মূল বইগুলো সে তুলনায় মলিনই ঠেকে। মূলত একজন পরিচালক কিভাবে দর্শককে কিছু দেখাবেন সেটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। 

 

"পথের পাঁচালী" ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে একদম নতুন ঘরানার চলচ্চিত্র । যেন সত্যজিৎ এক্সপেরিমেন্ট করতে চাচ্ছিলেন। সেসময়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে রোমান্টিক মিউজিক্যাল খুব বেশিই দেখা যেতো। কিন্তু এই নতুন ঘরানার চলচ্চিত্র সমালোচকদের এত জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে একে সত্যজিৎ রায়ের "পথের পাঁচালী" বলতেও কেউ দ্বিধা করেনি। সুনীল সহ আরো অনেক সাহিত্যিকই নানা সময়ে একথাই বলেছেন বহুবার। তবে, কোনটা কোনটার চেয়ে ভালো একথা বলা যাবেনা। বলা যেতে পারে যে দুটোই অনন্য।
 

পরিচালক এবং শিশু প্রধান চরিত্র অনভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা নতুন কিছু দর্শকদের উপহার দিতে পেরেছিলেন। যেমনটা বহুবছর পর তারেক মাসুদ তাঁর "মাটির ময়না" বা "রানওয়ে" চলচ্চিত্র তৈরি করে প্রমাণ করবেন।

আর এই সাফল্যের পেছনে পরিচালক সত্যজিৎ রায় এবং সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্রের মুন্সিয়ানার কথা মানতেই হবে। মিত্র নিজে লাইটিং সিন, ক্যামেরার কাজ, মেস অন সিন চিত্রায়ণ করতে পেরেছিলেন। 
কিন্তু এই চলচ্চিত্রে এমন কি আছে যা সত্যিই চলচ্চিত্রটিকে অনন্য বলে চিহ্নিত করে? ভারতীয়দের কাছে "পথের পাঁচালী" উপন্যাস ক্লাসিক বলে খ্যাত হলেও বাইরের জগতে গল্পটা সাদামাটা মনে হবে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ম্যাজিকটাই এখানে, তিনি সামান্য গল্পটিকে এমনভাবে বর্ণনাময় করে তুলেছেন যে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু উপন্যাসে কখনো কখনো মনে হয়েছে তিনি সব চরিত্রে সমান গুরুত্ব দেননি। আর সত্যজিৎ যে চরিত্রদের গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন, তাদেরকেই রেখে দিয়েছেন তাঁর চলচ্চিত্রে। ফুটিয়ে তুলেছেন সিনেমার মধ্যে এক নিটোল গল্প। 

 

গল্পটা আসলে গ্রামীণ একটি ছেলের। তার দুষ্টু বড় বোন সংসারের দারিদ্রতা সত্ত্বেও নিজের খেয়ালী জগতে হারিয়ে থাকে। ব্রাহ্মণ বাবা মেরুদণ্ডহীন। নিজের প্রাপ্য বেতন চাইতে গেলেও তার দ্বিধাবোধ প্রবল। সংসারের প্রতি খেয়ালের চেয়ে গীত ও পুঁথিতে বেশি আগ্রহ। আর আছে এক পল্লিজননী। জননী তার সন্তানদের প্রতি যথেষ্ট দ্বায়িত্বশীল, কঠোর ও মমতাময়ী। এই দারিদ্রের মধ্যেও সংসার ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে নিপুণতার সাথে। তবে আপাতত আমরা একটা সুখী পরিবার দেখতে পাই। 
 
 
কিন্তু গল্পের ম্যাজিক না হয়ে এখানে দর্শকের চোখ দেখবে কিছু ম্যাজিক। সত্যজিৎ এক অবোধ বালকের দৃষ্টিতে পৃথিবীটিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেন আমরাও অবোধ বালক পথের দেবতার দিকে তাকিয়ে আছি। এই কাজটা সত্যিই বেশ কঠিন। এমনকি ভবিষ্যত জীবনের অনিশ্চয়তা ফুটিয়ে তোলার একটি দৃশ্য আমাকে সবসময় মুগ্ধ করে। আমি জানিনা আর কেউ এভাবে ভাবে কিনা, কিন্তু আমরা অপু আর দূর্গাকে কাশফুলের বনে দৌঁড়ুতে দেখি। আর আসতে থাকে একটা ট্রেন। সেই ট্রেন দিগন্তের নীল ঢেকে দিতে শুরু করে কালো ধোঁয়ায়। যেন অপুর জীবনের বিষন্নতা আগেই পরিচালক দেখিয়ে দিয়েছেন। 

 

এমনকি হরিহরের পিসির জীবন এবং খুঁটিনাটি বর্ণনা পুরো গল্পটাই এঁটে ফেলেছে। যেন এত বর্ণনার প্রয়োজন নেই। এত জটিল এবং শব্দের প্রয়োজন নেই। প্রকৃতির আলো, বাতাস, মানুষের মুখ, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলই যেন একেকটা গল্পের বর্ণনা দিচ্ছে। আমরা যে জীবনে বাস করি, সেই জীবনের একটি বাস্তব চিত্রই তুলে ধরে। শুধু রঙ লাগিয়ে দিলেই হয়ে যাবে। অবশ্যই মূল বই প্রশংসীয় অথচ গল্পটা ভিন্ন সময়, সংস্কৃতি ও মানুষের গল্প তুলে ধরে। সে যাই হোক, এই চলচ্চিত্র সমগ্র বিশ্বের মানুষের বুকের অতলে জমে থাকা অনুভূতির প্রতিনিধিত্ব করে।
 

 

এই চলচ্চিত্র সত্যজিৎ রায়কে অনেক পুরষ্কার এনে দিয়েছে। নিটোল এক গল্প ফুটিয়ে তোলা সহজ কাজ না।

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ