একজন সফল উদ্যোক্তা “খাদিরাণী”
মুক্তা আক্তার, পড়ছেন কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ এর উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষে। জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্বল্প সময়ে অল্প মূলধনে অল্প দিনের মধ্যেই কীভাবে একজন সফল এবং সার্থক উদ্যোক্তা হলেন? জীবনের সেই গল্প নিয়েই আমরা কথা বলেছি তার সাথে।
ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন মুক্তা যখন ৫ম শ্রেণিতে পড়তেন। তখনো তেমন করে বোঝা হয়ে ওঠেনি এই ধরণীকে। যতই বড় হচ্ছেন, ততই বুঝছেন বাবা হারানোর পর কি কষ্ট করতে হয়, জীবনে চলার পথে কত বাঁধা অতিক্রম করতে হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর চার ভাই, তিন বোনের বিশাল সংসার আগলে রেখেছেন মা রৌশনরা খন্দকার।
মুক্তা আক্তারের জন্ম সীমান্তবর্তী কুমিল্লার বিবির বাজারের গাজীপুর গ্রামে। যতই বড় হচ্ছেন পরিবারে বাবার চাহিদার ব্যাপারটা ঢের বুঝতে পারছেন মুক্তা। বাবারও স্বপ্ন ছিল মেয়ে বড় হয়ে কিছু করবে এবং সফল একজন উদ্যোক্তা হবে। আর বাবার এই স্বপ্নকে বুকে আগলে নিজেই স্বপ্ন দেখা শুরু করেন একজন উদ্যোক্তা হবেন। আটঘাট বেঁধেই নেমে পড়েন, উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য ক্লাস করেন উইতে। একমাস ট্রেনিং এর পর আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজেই নতুন কিছু করবেন বলে চিন্তা করলেন।কিন্তু এই ধরণীতে নারীদের বাঁধা- বিপত্তির শেষ নেই। গ্রামের কত লোকই কত কথা বলতে শুরু করল যে মেয়ে হয়ে ব্যবসা করবে! এসকল তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কে তোয়াক্কা না করে সমস্ত চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়েই ভাঙ্গা মনে ভাঙ্গা স্বপ্ন জোড়া দেওয়ার জন্য আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজের পথ চলা শুরু করেন।
য়তা করার জন্য ব্যবসা করবেন বলে ঠিক করেন। কিন্তু কি ব্যবসা করবেন, তা ভেবে উঠতে পারছিলেন না। একদিন নিজেই চিন্তা করলেন খাদি কাপড়ের বিজনেস করলে কেমন হয়? কুমিল্লা জেলার মেয়ে মুক্তা। তাই কুমিল্লার ঐতিহ্যে খাদি কাপড়কেই ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন। পরে তিনি ফেইসবুক ভিত্তিক একটি অনলাইন পেইজ খুলে ফেলেন আর তার নাম দেন খাদি রাণী। আর খাদি কাপড় সূক্ষ্ম ছিদ্র যুক্ত মিহি সূতা এবং তুলার বুননে তৈরি, ১০০%পরিবেশ বান্ধব, কোমল মোলায়েম, পরতে আরাম এবং ক্রেতার চাহিদার কথা চিন্তা করেই মুক্তা সকল প্রকার খাদি কাপড়ের বিজনেস করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন।
২০২০ সালের ৫ ই মার্চ নিজের টিউশনির ২৩৭০ টাকা দিয়ে অনলাইনে খাদি কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। অল্প দিনেই দারুণ সফলতা লাভ করে ৪-৫ লাখ টাকার প্রোডাক্ট সেল করেন। এক বছরের মাথায় তার মোট বিক্রি দাঁড়ায় ১২ লাখ টাকার উপরে। তার এই দারুণ অভাবনীয় সফলতা দেখে তার পরিবারের যেমন সমর্থন পাচ্ছেন তেমনি করে লোকজনের প্রশংসায়ও ভাসছেন। তার অর্জিত অর্থ এখন কাজে লাগছে পরিবারের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে। তিনি মনে করেন এ থেকে শান্তির বিষয় আর কি বা আছে?
মুক্তা আক্তার বলেন, ‘টিউশন করে নিজের পড়ার খরচ বহন করতাম। সেই টিউশনির টাকাকে পুঁজি হিসেবে কাজে লাগিয়েছি। শুরুতে আমার পরিবারের সাপোর্ট পাচ্ছিলাম না। লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ করতে হয়েছে অনলাইনে। এরপর যখন বিক্রি বাড়তে থাকলো; তখন পরিবার আমাকে সাপোর্ট দেওয়া শুরু করলো।
তিনি বলেন, ‘তবে এ ক্ষেত্রে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে ফেসবুক ভিত্তিক ই-কমার্স গ্রুপ। গ্রুপটি আমাকে সাধারণ থেকে অসাধারণ করে তুলেছে। সে কারণেই আজ সবাই খাদিরানী বলেই চেনে।’ এখন সে পুরো অঞ্চলে খাদি রাণী বলেই পরিচিত।
খাদি নিয়ে কেন কাজ শুরু করলেন এমন প্রশ্নের জবাবে মুক্তা বলেন, ‘খাদি প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। আমাদের কুমিল্লার ঐতিহ্য এভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী জোগান দিতে পারেন না তাঁতিরা। অনেকে কাজও বন্ধ করে দিয়েছেন। যদি এমন হতে থাকে, তাহলে অচিরেই খাদি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই কুমিল্লার ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে আমার এ উদ্যোগ।’
তিনি আরও বলেন, ‘খাদি নিয়ে কাজ করার জন্য প্রথমে কুমিল্লার তাঁতিদের সাথে কথা বলি। তাদের কারখানায় যাই। গিয়ে খুব হতাশ হই। খুব অল্প সংখ্যক তাঁতি কাজ করছেন। অনেকে বলেছেন, আপনারা কাজ দিলে করতে পারবো। কিন্তু তখনো আমি নতুন। বুঝতে পারছিলাম না যে, কি করবো। তবুও সাহস নিয়ে কাজ শুরু করলাম।’
তিনি মনে করেন, খাদি নিয়ে কাজ করলে অনেকের কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে। প্রান্তিক মানুষের অর্থনীতির স্বাধীনতা দিতে পারে। আর খাদি কাপড় শতভাগ পরিবেশবান্ধব। এ কাপড় তুলার তৈরি এবং সূক্ষ্ম ছিদ্রযুক্ত। তাই খাদি কাপড় স্বাস্থ্যকর। খাদি কাপড় টেকসই।’
মুক্তা বলেন, ‘খাদি কাপড় গরমে ঠাণ্ডা এবং শীতে উষ্ম অনুভূতি দেয়। সর্বোপরি এটি বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনবে। আমি খাদি নিয়ে কাজ করার পর কুমিল্লা থেকে মিনিমাম ৫০ জন উদ্যোক্তা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে খাদি নিয়ে কাজ করছেন। আমিও কিছু নবীন উদ্যোক্তাদের নানান ধরনের সহযোগিতা করছি কীভাবে কাজ করতে হবে এবং সফলতা অর্জনের নানা কৌশল রপ্ত করার টিপস দিচ্ছি। ফলে কুমিল্লার খাদি তাঁতিরা অনেকে এগিয়ে এসেছেন।’
খাদি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার পরিকল্পনা হচ্ছে- খাদিতে বিভিন্ন ধরনের ফিউশন আনা। শাড়ি, পাঞ্জাবি, থ্রি-পিস, কুর্তিসহ অনেক আইটেম নিয়ে কাজ করা এবং মেয়ে ছাড়াও ছেলেদের সার্ট, পাঞ্জাবি, পায়জামা ইত্যাদি নিয়ে আরও সফলভাবে কাজ করতে চাই যদিও আমি এখন থেকেই এসব নিয়ে কাজ করছি এবং আমার ফ্যাশন হাউজে খাদির এসব মালামাল ছাড়াও আরও অনেক দেশিয় পণ্য পাওয়া যায় চাহিদার উপর। সফলতার একটাই সূত্র, লক্ষ্য ঠিক করে লেগে থাকা আর পরিশ্রম করা। আর আমার একটি স্বপ্ন শো-রুম করে কাজ করা। আর সেটা আমি অতি শীঘ্রই করতে যাচ্ছি খাদি নিয়ে বিশ্ব দরবারে জায়গা করে নেওয়াটাই এ উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য বলে মনে করছেন কুমিল্লার খাদি রাণী খ্যাত সফল একজন উদ্যোক্তা বনে যাওয়া সফল এবং সার্থক নারী ব্যক্তিত্ব মুক্তা আক্তার।
নবীন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে আপনার কি ধরনের পরামর্শ থাকবে প্রশ্ন করায় মুক্তা আক্তার বলেন, আমি নিজেও একজন নবীন উদ্যোক্তা। তবে আমার স্বল্প সময়ের এই সফলতায় আমি সন্তুষ্ট। তবে আমার এই নগণ্য অভিজ্ঞতা থেকে নতুনদের জন্য প্রথমে আমার শুভেচ্ছা থাকবে। আমি মনে করি উদ্যোক্তা হয়ে সফলতা পেতে কঠোর পরিশ্রম এবং ধৈর্যের প্রয়োজন যেটা আমাকেও করতে হয়েছে। আর নবীনরা যদি সংঘবদ্ধ হয়ে দেশের ঐতিহ্যগত যেসকল প্রোডাক্টের চাহিদা বেশি এবং বাহারি সৌন্দর্যে ভরপুর এবং যে প্রোডাক্ট গুলো আমাদের নাড়ীর টানে সম্পৃক্ত, যা আবার ভিনদেশী চাহিদায় তলীয়ে যাচ্ছে শুধু ক্রেতার সামনে এর সৌন্দর্য উপস্থাপনের অভাবে সে সকল পণ্যের প্রসারে যদি নবীনরা কাজ করে এগিয়ে আসে তাহলে একদিকে যেমন নবীন উদ্যোক্তা সফল হবে তেমনি দেশের পণ্যও দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করার মতো এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে। এতে দেশও দারুণ পরিচিতি এবং এসব পণ্য রপ্তানিতে দারুণ সফলতা লাভ করবে।