যাদুবাস্তবতার জগতে সামান্য “মানুষ” ফরেস্ট!
সেই সময়ে ফিল্মের জগতে শশাঙ্ক রেডেম্পশনের মতো একটা মুভির সাথেই যেন প্রতিযোগিতা চালাচ্ছিলো আরেকটি মুভি। ফরেস্টের মতো চরিত্র বিশ্বের কোন চলচ্চিত্রে আছে বলে আমার জানা নেই। আবার ফরেস্ট গাম্পের মতো আরেকটি মুভি খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। সোজা কথায়, ফরেস্ট গাম্প কমেডি ফিল্ম। নাকি ড্রামা অথবা যাদুবাস্তবতার গল্প? ফরেস্টকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টাই যেন দর্শককে পীড়া দেয়। কিন্তু ফরেস্ট গাম্প কমেডি ধাঁচের হলেও বেশ জটিল একটি গল্প। এটা কি একটা স্বপ্নের গল্প? কিন্তু কি হতে পারে সেই লক্ষ্য? সেটা জানার জন্যেও একদম শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে সকলকে।
ফরেস্টের গল্পটা সত্যি বলতে গেলে “অদ্ভুত।” কেন? কারণ ছোটবেলায় ফরেস্ট হাঁটতে পারবে কিনা তা নিয়েও ছিল সন্দেহ। কিন্তু এই গল্পের মধ্যে ফরেস্টের জীবনকে চিত্রায়ন করতে গেলে দুজন নারীর কথাই বলতে হবে। একজন ফরেস্টের মা, অন্যজন তার প্রেমিকা জেনি। একজন মানুষের জীবনে অন্তত দুজন নারীর প্রভাব ও আগলে রাখার গল্পটিকে অনেকেই হয়তো এড়িয়ে যান। সেই ছোটবেলায় মায়ের কাছেই জীবনের শিক্ষার হাতেখড়ি। জীবন একটা চকলেটের বাক্সের মতো। বাক্স খোলার আগমুহূর্ত পর্যন্ত বলা যাবেনা কি অপেক্ষা করছে।
যেন বলতে চাচ্ছে – জীবনে চকলেটের বাক্স নিয়েই ভাবার অবকাশ আছে। কারণ চকলেটগুলোকে আগলে রাখছে যে বাক্স, সেটাকেই যত্ন করে বাসায় নিয়ে খুলে দেখতে হবে। ফরেস্টের জীবনটা হয়তো এতটাও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠতো না – যদি না ওর মা আগলে রাখতো। এমনকি ফরেস্টকে জীবনের স্বাভাবিক সুতোর বেলুন ধরিয়ে দিতে গিয়েও তার মমতা চোখে পড়ার মতো। অনেকটা কমেডি ধাঁচে এগিয়ে গেলেও যে কোন দর্শক ওই মুহূর্তগুলোতে আবেগাপ্লুত হয়ে উঠতে বাধ্য।
ফরেস্টের জীবনটাও অদ্ভুত। স্কুলবাসে প্রথম চড়তেই সে বুঝেছিল জীবনটা তার এমন নিঃসঙ্গই থেকে যাবে। যেন ঐ বাসটাই সমগ্র পৃথিবী যেখানে ফরেস্টের মতো কেউ কখনো খাঁপ খাওয়াতে পারবেনা। আর তখনই তার পরিচয় হয় আরেক নারী, জেনির সাথে। জেনি! যাকে আপাতদৃষ্টিতে খুব পছন্দ করার কিছু নেই হয়তো – কিন্তু কেন যেন এই চরিত্রটি না থাকলে ফরেস্ট হয়তো ফরেস্ট হয়ে উঠতো না।
ফরেস্ট এমন একজন মানুষ যে পৃথিবীর জটিল বিষয়গুলো নিয়ে উত্তেজিত না। পৃথিবী বদলে যাওয়া রাজনীতি, বিখ্যাত ব্যক্তি, অসামান্য অর্জনগুলোও ফরেস্টের মাঝে আহামরি কিছু না। সামনে যা আছে, তা যেন খুবই স্বাভাবিক। অথচ এই ফরেস্টকেই আমরা দেখি যুদ্ধক্ষেত্রে তার সঙ্গীকে বাঁচানোর জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে। লক্ষ্য করি মানবীয় আবেগের প্রতি ফরেস্টের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া।
ফরেস্ট যেন এক যাদুবাস্তব চরিত্র। যাকে দেখানো হয়েছে ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় পাতায়। আধুনিক সিনেমার জটিল ও হেয়ালীপূর্ণ ভাবধারাই ফরেস্ট গাম্পকে আরো জটিল করে তুলেছে। যেমন জটিলতায় আমরা ভুগি জেনিকে নিয়ে।
জেনি যাকে ফরেস্ট প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলো – কখনও ফরেস্টকে ভালোবাসতে পারেনি। অথচ সেই ফরেস্টকেই সে আগলে রেখেছে বহুদিন, যার “দৌড়াও ফরেস্ট দৌড়াও” বাক্যেই ফরেস্ট প্রথম নিজের না হাঁটতে পারার প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে গেছে – সেই জেনিকেই বরং জটিল মনে হয়।
একদিকে ফরেস্ট আমেরিকার ইতিহাসের প্রতিটি পরতে পরতে যাত্রা করলেও জেনি যেন যাত্রা করে তার উল্টোদিকে। আমেরিকায় প্রবেশ করা কাউন্টার কালচারগুলোকেই জেনি যেন আঁকড়ে ধরে। বিদ্রোহী হয়ে উঠে হয়তো। আর এটাই হয়তো সবচেয়ে চমৎকার বিষয়। ফরেস্ট আর জেনি দুজনেই যেন আমাদের বর্তমান সংস্কৃতির পরতে পরতে যাত্রা করে বেড়ায়। একজন খ্যাতি, বিশ্বজোড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্জন আর অন্যজন সাইকাডেলিক, ভবঘুরে হতাশা, মাদকের জগত। এই দুই হেঁয়ালি চরিত্র যেন আমাদের পৃথিবীর সকল ভালো ও খারাপ বিষয়ের সহাবস্থান দেখিয়ে দেয় নিজ চোখে।
তবু জেনির বিশ্বাস ছিল তার শিকড় গাম্পের কাছেই। অথচ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি গাম্পকে জীবনের একমাত্র অবলম্বন হিসেবে। হয়তো জেনি ভাবছিল সে ফরেস্টের জীবনের বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। সেই অপরাধবোধ ও ফরেস্টের প্রতি মমতাবোধ থাকা স্বত্বেও তা স্বার্থপরতার দিকে রুপ নিচ্ছিল। অথচ আমরা জেনিকে ঘৃণা করতে পারিনা। কারণ জেনির কারণেই ফরেস্ট পূর্ণতা পেয়েছিলো শেষে।
তবু ফরেস্টের কাছে হয়তো মনে হয়েছিলো বিশ্বজোড়া খ্যাতির চেয়ে ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরতে পারলেই বরং মঙ্গল। ফরেস্ট শুধু একবার বলেছিল, আমি হয়তো এতটা বুদ্ধিমান নই, তবু আমি ভালোবাসতে জানি। তবে শেষ পর্যন্ত জেনিকে ফরেস্টের কাছেই ফিরতে হয়।
আসলে মানুষের জীবনে এমন একটি নিরাপদ আশ্রয় থাকাটা ক্ষতির কিছু নয়। বরং এই নিরাপত্তার সন্ধানেই নারীরা হয়তো অপেক্ষা করে। তবু হয়তো কখনো কখনো হারিয়ে ফেলে। প্রতিটি মানুষের জীবনে মা এবং তার প্রেমই হয়তো জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। এই জটিল গল্প হতাশার সুরে যেন আশার গল্প বলে। আবার কখনো বুক চাপা কষ্ট এনে দেয়। আসলে, এই গল্পকে ব্যাখ্যা করতে গেলেও হেয়ালির জগতে হাবুডুবু খেতে হয়।