নতুন বছরের আতঙ্ক বাসাভাড়া
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আইরিন। একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন তার স্বামী মাহফুজ। বিয়ের পরপরই আগে ঢাকায় আসেন আইরিন। চাকরিও পেয়ে যান সে সময়ই। ঢাকার বুকে স্বামী ও সন্তানসহ একটি দুই বেডরুমের ভাড়া ফ্ল্যাটই মাথার গোজার একমাত্র ঠাই। দুইজনের আয়ে এতদিন কোন রকমে কেটে গেছে এই দম্পতির। আয়-ব্যয় মিলিয়ে সঞ্চয় খুব বেশি না থাকলেও চলে যেত। তবে বিপত্তির শুরু করোনা আক্রমণের পর থেকেই।
একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করায় হঠাৎ করেই উপার্জন কমে যায় এই দম্পতির। সেই প্রভাব পড়ে তাদের এতদিনের সাজানো ফ্ল্যাটের উপর। কয়েকমাস যেতে না যেতেই ছাড়তে হয়েছে বাসা। পরে এক বন্ধুর সঙ্গে ভাগাভাগির ভিত্তিতে ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। এখন দুই বন্ধু মিলে রাজধানীর রামপুরায় বসবাস করছেন। ভাড়া ফ্ল্যাটে ভাগাভাগি করে থাকলেও শুধু চাকরির বেতনে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
নতুনকে ঘিরে বরাবরই সকলের একটু আয়োজন উত্তেজনা থাকে। প্রত্যেকটা বছর শেষেই সকলে আশায় থাকেন আগামী বছর শুভবার্তা নিয়ে আসবে। পুরনো বছরের যত খারাপ বা ভোগান্তির দিন ছিল আগামী বছরে তার সব রেশ কেটে যাবে। একই সাথে এমন সব আশার আলোর সাথে মিশে থাকে আতঙ্কও। 'বাসা ভাড়া' মোটামুটি মধ্যম আয়ের শ্রেণি পেশার সকলের কাছেই একটা আতঙ্কের নাম।
এই গল্প তাদের একার না। ঢাকা শহরে লেখাপড়া, চাকরি বা জীবিকার তাগিদে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে বসবাস করেন। হিসেব মতে, প্রায় ২ কোটি লোকের বাস এই শহরে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ভাড়া বাসায় থাকেন। যারা কেউ শিক্ষার্থী, কেউ সরকারি বা বেসরকারি চাকরি করেন, কেউ বা ছোটোখাটো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। আর জীবিকার তাগিদে এদের থাকতে হয় বাসা ভাড়ায়। যেখানে আয়ের সিংহভাগই চলে যায় বাসা ভাড়া হিসেবে। এরপর বছরের ছয় মাস পার হতেই বাড়িওয়ালারা নানা তালবাহানায় বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য উদ্বেগ হয়ে থাকেন। বছর শেষ হতে না হতেই বাড়িয়ে দেন বাসা ভাড়ার অংক।
করোনাকালে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত অনেকের চাকরি চলে যাওয়া কিংবা ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রামে চলে গেছেন লাখ লাখ মানুষ। এখনো তারা ফিরতে পারেননি। যারা আছেন তারাও বেঁচে থাকার লড়াইয়ে দিনাতিপাত করছেন। ভাড়াটিয়াদের অভিযোগ, করোনা শেষ না হলেও বাড়িওয়ালারা নতুন বছর থেকে বাড়িভাড়া বাড়ানো হবে বলে তাদের জানিয়েছেন। এভাবেই রাজধানীতে বসবাসকারী বহু ভাড়াটিয়া এমন সমস্যায় ভোগেন।
নতুন বছরের শুরুতেই কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ভাড়ার বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেন ভাড়াটিয়াদের উপর। এ নিয়ে হিমসিম খেতে হয় মধ্যম আয়ের মানুষদের। বাসা ভাড়া মিটিয়ে সংসারের বাকি খরচ মিটাতে পরতে হয় বিপাকে। অনেকে এই খরচ মিটাতে বাড়তি আয়ের জন্য চাকরির পরেও অন্য কাজ করে থাকেন। অনেকেই কিছু কম ভাড়ায় বাসা পাওয়ার জন্য অফিস বা কর্মক্ষেত্র দূরে হওয়া সত্ত্বেও ভেতরের দিকের গলিতে বাসা নিয়ে থাকেন। অনেকে আবার ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকেন। অনেকে সাবলেট ভাড়া দিয়ে থাকেন। সাবলেট ভাড়া দেওয়ার পর আবার তাদের জন্যও নতুন বছর এলেই বাড়ানো ভাড়া।
বাসা ভাড়া বাড়িয়ে বাড়িওয়ালারা নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। আর এ কারণেই নতুন বছর মানে ভাড়াটিয়াদের কাছে একটা আতঙ্ক। অথচ ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ২০০৭ সালে ঢাকা শহরের ৭৭৫টি এলাকায় ১০টি রাজস্ব আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, কাঁচাবাড়ি, পাকা ঘর, সেমি পাকা, মেইন রোডের তিনশ ফিট ভেতরে এবং বাইরে পাঁচ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত প্রতি স্কয়ার ফিট ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু কোন বাড়িওয়ালাই এ নীতি মানেন না। এছাড়া বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ এ সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। আইনের ১৬ ধারায় বলা হয়েছে, বড় কোন ধরনের নির্মাণকাজ বা পরিবর্তন আনা ছাড়া বাসার মালিক দুই বছরের মধ্যে মূল ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারবে না। অথচ এসব কিছুই মানছে না বাড়ীওয়ালারা। আর যাঁতাকলে পড়ে আতঙ্কে ভুগছেন ভাড়াটিয়ারা।