ফ্রাঙ্কা ভিওলা: যার একটি ‘না’ বদলে দিয়েছে ইতালির আইন
পৃথিবীটা ইতিহাস গড়বারই জায়গা। আর যুগে যুগে হাজার হাজার মানুষ ব্যাভিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ইতিহাস গড়েছেন। সেসব ইতিহাস যেন আরো রসনায় মশলা মেশানোর মত ঝাঁঝালো হয়ে উঠে, যখন সে ইতিহাসের নেপথ্যে থাকে কোনো নারীর গল্প।
ইতালিতে এক সময় আইন ছিল কোনো ধর্ষক যদি ধর্ষিত নারীকে বিয়ে করে তবে তার অপরাধের ক্ষমা হয়ে যাবে। সেসময় সিসিলিয়ান সমাজে ‘ম্যাত্রিমোনিও রিপারাতোরে’ নামে এক প্রথার চালু ছিল, যার মানে হলো ‘পুনর্বাসনমূলক বিয়ে’। অর্থাৎ যে নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, দিনশেষে তাকে আবার ঐ ধর্ষককেই বিয়ে করতে হবে। নাহলে সমাজ সে নারীকেই ‘দন্না স্ভার্গগনাতা’ বা ‘দুশ্চরিত্রা নারী’ বলে ধিক্কার দিতো। আর এই জঘন্য আইনের বিরুদ্ধে প্রথম না বলেন ফ্রাঙ্কা ভিওলা। তিনি এই আমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং একসময় এই আইনের পরিবর্তনও ঘটান।
ফ্রাঙ্কা ভিওলা ছিল কৃষক বাবা বার্নার্দো ভিওলা এবং মা ভিতা ফেরার সংসারে বড় কন্যা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার কয়েক বছর পর, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে, ইতালির সিসিলি দ্বীপের আলকামো শহরে ফ্রাঙ্কার জন্ম। ১৫ বছর (১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ) বয়সে, ফিলিপ্পো মেলোদিয়া নামে স্থানীয় এক মাফিয়া সদস্যের সাথে ফ্রাঙ্কার বাগদান হয় । তবে সেটা বিয়েতে রূপ নেবার আগেই চুরির দায়ে জেলে যায় মেলোদিয়া।
হবু জামাইয়ের এমন পরিণতি মেনে নিতে না পেরে ফ্রাঙ্কার বাবা বার্নার্দো মেয়েকে পরামর্শ দেন, এই সম্পর্ককে আর না এগোতে। এই ঘটনার পরেই মেলোদিয়া জার্মানিতে চলে যায় । এর দু’বছর পর আরেক তরুণের সাথে ফ্রাঙ্কার বাগদান সম্পন্ন হয়। ততদিনে মেলোদিয়াও আলকামোতে ফিরে আসে এবং পুরনো সম্পর্ক জোড়া লাগাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। স্বভাবতই চাপ সৃষ্টি করে এই বাগদান ভেঙে তার সাথে সম্পর্ক জোড়া লাগাবার জন্য। এমনকি ক্রমাগত ফ্রাঙ্কার বাবা আর হবু জামাইকে হুমকি দিতে থাকে।
কিন্তু এতে কোনোরকম লাভ না হওয়ায়, নিজের আসল রূপে ফিরে মেলোদিয়া। অস্ত্রশস্ত্রসহ নিজের সঙ্গীদের নিয়ে ১৯৬৫-র ২৬ ডিসেম্বর ফ্রাঙ্কাকে তার বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সে। অপকর্মে বাধা দিলে ফ্রাঙ্কার মা ও ছোট ভাই মারিয়ানোকে মারধর করে।
সেখান থেকে মেলোদিয়া ফ্রাঙ্কাকে শহরের বাইরে তার বোন আর দুলাভাইয়ের খামারবাড়িতে নিয়ে রাখে। টানা আট দিন ধরে তার উপর অমানবিক শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালায়, সেইসাথে ক্রমাগত ধর্ষণও। উদ্দেশ্য একটাই, তাকে বিয়ে করা ছাড়া ফ্রাঙ্কার আর কোনো উপায়ও নেই এখন। কারণ তা নাহলে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী লোকে তাকেই ‘দুশ্চরিত্রা’ বলে ডাকবে। মেলোদিয়ার এই উদ্দেশ্যের প্রতি ফ্রাঙ্কা প্রতিবাদ জানাতো। এবং মুক্তি পেলেই তাকে অপহরণ আর ধর্ষণের দায়ে মেলোদিয়ার শাস্তির প্রতিজ্ঞা করতো।
অবশেষে ৩১ ডিসেম্বর ফ্রাঙ্কার বাবাকে ফোন করে মেলোদিয়া দুই পক্ষ সমঝোতায় এসে ফ্রাঙ্কার সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করার কথা বলেন। ফ্রাঙ্কার বাবা বার্নার্দো ভিওলা সামনাসামনি বিয়ের ব্যাপারে ইতিবাচক থাকলেও আড়ালে তিনি মেলোদিয়ার শাস্তির জন্য পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেন। ২ জানুয়ারি সাঙ্গোপাঙ্গোসহ মেলোদিয়া ধরা পড়ে আর ফ্রাঙ্কা মুক্তি পায়। ফ্রাঙ্কার বাবা তখন তাকে জিজ্ঞাসা করেন সে মেলোদিয়াকে বিয়ে করতে চায় কি না। ফ্রাঙ্কা দৃঢ়চিত্তে “না” বলে। এই একটি না ই পরবর্তীতে একটা ঘৃণ্য আইনের পরিবর্তন ঘটায়। তখন ফ্রাঙ্কার বাবা মেয়ের সম্ভ্রম রক্ষার্থে ও ন্যায্য বিচার আদায়ে সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সোচ্চার হয়ে উঠেন।
আর ফ্রাঙ্কা তখন শুধু মেলোদিয়াকেই বিয়েতে "না" করেনি, বরং দেশীয় আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ফলে ফ্রাঙ্কার পরিবারের উপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। শহরবাসী ফ্রাঙ্কার পুরো পরিবারকে একঘরে কর দেয়। সেই সাথে চলে নানা রকম হুমকি ধামকি।
গোটা ইতালির সবচেয়ে আলোচিত বিষয় তখন ফ্রাঙ্কার এই রুখে দাঁড়ানোর গল্প। মেলোদিয়ার পক্ষের আইনজীবীরা তো নির্লজ্জভাবে দাবি করে বসে, ফ্রাঙ্কার অপহরণের ঘটনাটা ফ্রাঙ্কা আর মেলোদিয়ার পরিকল্পনা ছিল, গোপনে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলার জন্য !
তবে এই কঠিন সময়ের পুরোটা জুড়ে ফ্রাঙ্কা পরিবারকে পাশে পেয়েছিল। অবশেষে সব সাক্ষ্য-প্রমাণ যাচাই বাছাই শেষে আদালত ফ্রাঙ্কার পক্ষেই রায় দেয়।
মেলোদিয়ার ১১ বছর আর তার সাত সহযোগীর প্রত্যেককে ৪ বছর করে সাজা হয়। মেলোদিয়ার সাজা পরে অবশ্য ১ বছর কমিয়ে আনা হয়েছিলো। অবশ্য মুক্তি পাওয়ার বছর দুয়েকের মধ্যেই মেলোদিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
ফ্রাঙ্কার জয় হলেও ইতালির সেই জঘন্য আইন কিন্তু বাতিল হতে সময় লেগেছিল ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। এমনকি ধর্ষণকে ‘নৈতিকতা বহির্ভূত কাজ’ এর বিধান বদলে ‘ব্যক্তির প্রতি অপরাধ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৯৯৬ সালে।
এত ঝড়ঝাপটা সহ্য করে ইতিহাস গড়া সেই ফ্রাঙ্কাও সুখের সংসার পেতেছেন। সেই ঘটনার পর ১৯৬৮ সালে জিউসেপ্পে রুইজি নামের এক পুরুষকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের ঘর আলো করে জন্মায় তিন সন্তান; দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মজার বিষয় হল, জীবনের ৭২ বছর বয়সে এসেও ফ্রাঙ্কা, আজও তার বহু ঘটনার স্মৃতিবিজড়িত সেই আলকামো শহরেই বাস করছেন।