Skip to content

৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | সোমবার | ২২শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফ্যাশন রাজধানী প্যারিস মাতাচ্ছেন বাংলাদেশী মেহনাজ!

বাংলাদেশী তরুণী আইদা মেহনাজ।  স্নাতক সম্পন্ন করেছিলেন বায়োকেমিস্ট্রিতে। কিন্তু, বিশেষ টান ছিল ফ্যাশনের উপর। সেই ঝোঁক থেকেই ধীরে ধীরে পৌঁছলেন সাফল্যের উচ্চশিখরে। বর্তমানে শীর্ষ এক ব্র্যান্ডের দায়িত্ব নিয়ে ফ্যাশনের রাজধানী প্যারিস দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ২৬ বছরের মেনহাজ। তবে ফ্যাশন ডিজাইন নয়, তাঁর ক্ষেত্র ফ্যাশন কমিউনিকেশন।

মাত্র এক বছর আগে প্যারিসের বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এসমদ থেকে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন অ্যান্ড লাক্সারি ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করেছেন তিনি। ২০১৯ সালেই মাস্টার্সের ফাইনাল ইয়ারের ছয় মাসের ইন্টার্নশিপের জন্য যোগ দেন থিয়েরি মুগলার নামের এক বিখ্যাত ব্র্যান্ডে। এরপর অবশ্য স্পেশালাইজেশন করেছেন ব্র্যান্ড কমিউনিকেশনে। অন্যদিকে ইন্টার্নশীপ শেষ হওয়ার পরও থিয়েরি মুগলার নামের ওই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান তাকে ছাড়েননি। 

তিনি জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের ব্র্যান্ড ইমেজ অ্যান্ড কমিউনিকেশনস কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেন। প্রায় টানা দুই বছর তার  দক্ষতা দিয়ে সকলের মন জয় করে নেন মেহনাজ। আর তার পুরষ্কারস্বরুপ নতুন বছরে পদোন্নতি দেয়া হয় তাকে। তিনি এখন সিনিয়র ব্র্যান্ড ইমেজ অ্যান্ড কমিউনিকেশনস কো-অর্ডিনেটর। 

অতিমারির এ সময়েও সচল ছিল ব্যবসা। প্যারিসে একটি সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন তিনি। এর একটা হোটেল সেকশনও আছে। সেখানে একটা রুম ভাড়া করে বিভিন্ন মৌসুমের সব পোশাক তিনি নিয়ে এসে রেখে দেন। এরপর বাড়ি বসেই সব কাজ করেন। বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ, তারকাদের সঙ্গে যোগাযোগ, ফটোশুটের জন্য মডেল নির্বাচন থেকে ফটোশুট সবই তিনি করেছেন এভাবে। 

এসময়ে ভিন্নধর্মী বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার সঞ্চার করেন তিনি। যেমন গেল সেপ্টেম্বরের প্যারিস ফ্যাশন উইকে সংগ্রহ উপস্থাপন সরাসরি না করে ফ্যাশন ফিল্ম করে ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে দেখানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যে কাজ মোটেই সহজ ছিলো না। কারণ, অন্য মডেলদের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্যারিসে নিয়ে এসে শুট করা গেলেও করোনা মহামারীর কারণে সুপার মডেল ও শো স্টপার বেলা হাদিদকে নিউইয়র্ক থেকে আনা সম্ভব ছিল না।

তাই ব্রুকলিনে একটা স্টুডিও করে তাঁর পা থেকে মাথা স্ক্যান করে থ্রি-ডি ইমেজ করা হয়। এ জন্য ৫০০ ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। আর লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস আর জার্মানিতে অ্যানিমেশনের কাজ হয়। কিন্তু সেটা মনঃ পূত না হওয়ায় ২৮ সেপ্টেম্বরের নির্ধারিত শো বাতিল করে পরে প্রচার করা হয়। আর এই ফিল্মে বেলাকে সেন্টর হিসেবে দেখানো হয়। যেসব সেলেব্রিটি স্বাভাবিক সময়ে ফ্রন্ট রো আলো করেন, তাঁদের সবার বাসায় পোশাক পাঠানো হয়। তারা সেই পোশাক পরে ছবি তুলে পোস্ট দেন ফিল্ম প্রিমিয়ারের আগে। আর এভাবেই পুরো প্রক্রিয়া শেষ করা হয়।

করোনাকালেও ব্যর্থতাকে দূরে রাখার প্রয়াস ছিলো শতভাগ। অতিমারির এ বছরেও ২০২০ সালে ২০টি আন্তর্জাতিক ফ্যাশন সাময়িকপত্রের প্রচ্ছদে এসেছে মুগলারের পোশাক। এই তালিকায় রয়েছে ‘ভোগ’, ‘হারপার বাজার’, ‘এল’সহ আরও পত্রিকা। এ ছাড়া ‘ভোগ’ তাদের বডিস্যুট নিয়ে আলাদা ফিচার করেছে। এর বাইরে গেল বছর এমটিভি ভিডিও অ্যাওয়ার্ডে টপ টেনে থাকা তিনজন ডুয়া লিপা, কার্ডি বি আর বিয়ন্সে পরেন তাদের পোশাক। মুগলারকে ফ্যাশনের প্রত্যাবর্তনকারী ব্র্যান্ড এবং আলটিমেট পপস্টার ব্র্যান্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ‘ভোগ’ সমায়িকী। গর্বের ব্যাপার হচ্ছে এর পুরো নেতৃত্ব দেন মেহনাজ।  তার নেতৃত্বে কমিউনিকেশন টিমের তৎপরতায় চলমান অতিমারির মধ্যেও  সাফল্য ধরে রাখেন তাঁরা। 

গেল বছর পপ তারকাদের বাইরে তিনি কাজ করে থাকেন বেলা হাদিদ আর ডেবরা শ’র মতো সুপার মডেল আর কণ্ঠশিল্পী আরিয়ানা গ্রান্ডের সঙ্গেও। এ ছাড়া অন্য মডেল ও সেলেব্রিটিরা তো আছেই। এমনকি তাঁর কর্মদক্ষতায় খুশি হয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাঁকে ফুলের বুকে পাঠিয়েছেন বলেও জানান তিনি। 

তার সাফল্যমণ্ডিত কাজের একটি গল্প শোনা যাক তবে- 

ব্রিটিশ কণ্ঠশিল্পী ও গীতিকার ডুয়া লিপার নাম নিশ্চয়ই মোটামুটি আমরা সবাই শুনেছি । তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেসব ড্রেস পরে থাকেন তা কখনো রেডি-টু-ওয়্যার কালেকশন থেকে নিয়ে নেন, তো কখনো আবার তাঁর জন্য কাস্টমমেড করে দিতে হয়। গেল নভেম্বরে লন্ডনের একটি শোর জন্য তেমনই একটি পোশাক তাঁর প্রয়োজন। তাই আগে থেকে পাঠানো হয় বেশ কয়েকটি ডিজাইনের স্কেচ। ডুয়ার স্টাইলিং টিম  সেই ডিজাইনগুলো থেকে একটি পছন্দ করে। এরপর শুরু হয় নকশা অনুযায়ী পোশাক তৈরির কাজ। তারপর প্যারিস থেকে সেই পোশাক লন্ডনে পাঠিয়ে ফিটিং দেখা হয়। জুমে পুরো বিষয়টি মনিটর করা হয় প্যারিস থেকে। এরপর প্রয়োজনীয় পরিমার্জন শেষে মূল পোশাক পাঠানো হয় লন্ডনে। 

কিন্তু হঠাৎই  শোয়ের আগের দিন ডুয়ার স্টাইলিস্ট ফোনে জানান, পরার সময় এক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে ড্রেসটি। তাই রাতারাতি সেটা ঠিক করে দিতে হবে। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। কিন্তু বসে থাকলে তো চলবে না। তাই প্যারিস থেকে একজনকে এক টুকরা কাপড়সহ প্লেন ভাড়া করে পাঠানো হয় লন্ডনে। সেখানে গিয়ে তিনি পোশাক মেরামত করে দেন। এবং অবশেষে সেই পোশাক পরে মঞ্চ মাতান ডুয়া লিপা।

 আর পুরো এই  ঘটনার পেছনে থেকে ডুয়া লিপা এবং তাঁর টিমের সদস্যদের সঙ্গে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ রেখে পুরো বিষয়টি সুনিপুণভাবে  সামলেছেন আইদা মেহনাজ। এ যেন তার দৃঢ়তার পরিচয়। 

এবার চলুন জানা যাক মেহনাজ এর  ফ্যাশন জগতে আসার পেছনের গল্পঃ

আইদা মেহনাজ  নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োকেমিস্ট্রিতে স্নাতক করেছেন। কিন্তু উচ্চতর শিক্ষায় তিনি নিয়েছেন ফ্যাশন কমিউনিকেশন। 
 নর্থ সাউথে পড়ার সময়ই তিনি মডেস্ট ফ্যাশন নিয়ে অ্যাডভোকেসি করা শুরু করেন। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যেমন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে নিয়মিত যোগাযোগ করেছে তার সঙ্গে। ২০১৫ সালে ইন্দোনেশিয়া ফ্যাশন উইক চলাকালে তিনি আমন্ত্রিত হন বক্তা হিসেবে। 

ঢাকায় থাকার সময়েই তিনি ফ্যাশন কমিউনিকেশন নিয়ে কাজ করতেন। নিজের ব্লগে লিখতেন, ভিডিও করতেন। এরই মাঝে খণ্ড কালীন কাজ শুরু করেন ফ্যাশন ব্র্যান্ড সেইলরে। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময় তাঁকে সহায়তা করেছে।

ফ্যাশন কমিউনিকেশন নিয়ে পড়ার জন্য তিনি নিউইয়র্ক ও প্যারিসে দুটো করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করেন। একাধিকবার ইন্টারভিউ দিয়ে বেশ কঠিন পথ পার করে তিনি এসমদে সুযোগ পান।  সেখানে দুই বছর পড়াশোনা করেন তিনি।  তখন ২০১৭ সালে তিনি প্রথম প্যারিস ফ্যাশন উইকে দেখেন কেনজোর শো। 

পড়াশোনা চলাকালীন সময়ই তিনি ইন্টার্ন করেন শীর্ষ সারির প্রেস এজেন্সি কেসিডিতে। এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় তাঁর সুযোগ হয় বালমেঁ, ইসাবেলা মারান্ত, ভ্যালেন্তিনো, গুচি ও রিক ওয়েন্সের মতো একাধিক ফ্যাশন ও কসমেটিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করার। ফলে প্রত্যেকের ব্র্যান্ড ইউনিভার্স আর তাদের বৈশিষ্ট্য, অনন্যতা, ব্র্যান্ড ডিগনিটি ও কালচার জানার সুযোগ হয়। যে অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে কাজে লাগে তার। 

সম্প্রতি মডেস্ট ফ্যাশন কাউন্সিল তাঁকে রিজিওনাল ডিরেক্টর মনোনীত করেছে।
 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ