মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম
মুক্তিযুদ্ধের এক বীরত্ব গাঁথা নাম হলো ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এই বীর নারী। নারী হয়েও তিনি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যিই অসাধারণ। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক খেতাবপ্রাপ্ত দুইজন নারী মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে তিনি একজন। অন্যজন হলেন তারামন বিবি। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহসিকতার সাথে তাঁরা শত্রুর মোকাবিলা করেছেন। জীবন বাজি রেখেছেন দেশের জন্য, মাতৃভূমির জন্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় সিতারা বেগমের বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম এ টি এম হায়দার ও ছোট ভাই এ টি এম সাফদার ছিলেন রণাঙ্গনে। আজ আমরা ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম বীরপ্রতীক এর সম্পর্কে জানবো।
১৯৪৬ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন সিতারা বেগম৷ তাঁর বাবার নাম মোহাম্মদ ইসরাইল এবং মা হাকিমুন নেসা। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী। কিশোরগঞ্জেই কাটে তাঁর শৈশব। তিন বোন ও ২ ভাইয়ের ভেতর তিনি ছিলেন তৃতীয়। কিশোরগঞ্জ থেকে মেট্রিক পাশ করার পর হলিক্রস কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ১৯৭০ সালে সেনা মেডিকেলে লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দেন সিতারা৷ এসময় তাঁর বড় ভাই এটিএম হায়দারও সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন৷ স্বাধিকার আন্দোলনের সময় কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাক সেনারা যখন দেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে তখন সিতারা বেগম ও তাঁর ভাই মেজর হায়দার কিশোরগঞ্জে ছিলেন ছুটিতে। এর মধ্যেই তাঁর ভাইয়ের ছুটি শেষ হওয়ায় তিনি মার্চেই চলে গিয়েছিলেন। সিতারার একমাসের ছুটি ছিলো। কিন্তু মার্চ মাসে হত্যাকাণ্ড শুরুর পর কুমিল্লা কম্বাইন্ড মেডিকেল হসপিটাল- সিএমএইচ থেকে তিনটা-চারটা টেলিগ্রাম আসতে থাকে তাঁকে সেখানে যোগ দেয়ার জন্য৷ ময়মনসিংহ সিভিল সার্জনের কার্যালয়সহ বেশ কিছু কাছাকাছি স্টেশনের উল্লেখ করে কাজে যোগ দিতে বলা হয়৷ কিন্তু তিনি সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানান। কিছুদিন পর তারা বড়বাগ গ্রামে গিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। সিতারা বেগম শুধু দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ খুঁজছিলেন। এর মধ্যেই জুলাই মাসের শেষ দিকে তিনি তাঁর ভাই হায়দারের চিঠি পান। তাঁর ভাইয়ের কথামতো তাঁরা পরিবারসহ ভারতে পাড়ি জমান। সাত দিন সাত রাত পর তারা সিলেট সীমান্ত দিয়ে টেকেরঘাটে পৌঁছান।
অন্যদিকে ডা. জাফর উল্লাহ ও দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনা অনুযায়ী আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের শরণার্থীদের সেবা প্রদানের জন্য আগরতলার মেলাঘরে নির্মিত হয়েছিলো বাংলাদেশ হাসপাতাল। প্রায় ৪০০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালে চিকিৎসা কর্মীর অভাবে প্রথমদিকে চিকিৎসা সেবা প্রদান একটু কঠিন ছিলো। এখানে এসে আহতদের চিকিৎসা প্রদানের কাজ শুরু করেন সিতারা। প্রায়ই রোগীদের ওষুধের জন্য আগরতলা ও উদয়পুরে যেতে হতো ডা. সিতারা বেগমকে। পরবর্তীতে আগস্টের শেষে ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম এই হাসপাতালের সিও হিসেবে দায়িত্ব নেন। তাঁর আন্তরিক পরিশ্রম, আত্মনিবেদন ও পরিকল্পনায় হাসপাতালটি এক অনন্য হাসপাতালে উন্নীত হয়। বাংলাদেশ হাসপাতালের একমাত্র নারী চিকিৎসক ছিলেন সিতারা বেগম। হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারও ছিলো। রোগীর জন্য প্রতিটি বিছানা তৈরি হতো বাঁশের চারটি খুঁটির ওপর মাচা বেঁধে। বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থী রোগীর সংখ্যাই ছিলো বেশি, যাদের অধিকাংশই হয় ম্যালেরিয়া বা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত অথবা গুলিবিদ্ধ, আহত।
সিতারা বেগম এই হাসপাতালের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। দিন-রাত সেবা করে গেছেন আহতদের। এরপর ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ হাসপাতালে থাকা অবস্থায় রেডিও মাধ্যমে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার খবর জানতে পারেন। তারপর তিনি তাঁর কিছু অসুস্থ রোগীকে কুমিল্লা সিএমএইচে ভর্তি করান।
মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদানের কারণে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে 'বীরপ্রতীক' খেতাবে ভূষিত করেন। একই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার পান্ডে ঢাকায় এলে তাঁকে ‘সাহসী নারী’ আখ্যা দেন। ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম ১৯৭২ সালের অক্টোবরে চিকিৎসক ও মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আবিদুর রহমানকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির এক মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে। ১৯৭৩ সালে এই পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চলে যান।
তাঁদের মতো সাহসীদের জন্যই আমরা এই স্বাধীন বাংলা পেয়েছি। অপার সাহসিকতার সাথে তাঁরা শত্রুর মোকাবিলা করেছেন। তাঁদের এই অবদান আমরা কখনোই ভুলতে পারবোনা। তাঁদের প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।