করোনায় বইয়ের বাজার
যতই ইন্টারনেট দুনিয়া কাঁপাক, বইয়ের প্রতি প্রেম এখনো তরুণদের মধ্যে দেখা যায়। প্রিয় লেখকের সৃজনশীল বই পড়তে এরা যেন মুখ উঁচিয়ে থাকে। এছাড়া শিক্ষা খাতে তো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসই বই।আর এসবের চাহিদা মেটাতে সারাবছর ধরেই বইয়ের বাজারে ভিড় লেগেই থাকে। সেই সাথে প্রকাশনা গুলোর ব্যস্ততাও আর থামবার নয়।
কিন্তু আজকের বিশ্ব পুরোপুরি থমকে আছে কোভিড -১৯ আক্রান্ত হয়ে। অন্যান্য খাত গুলো অনেকটা সচল করা হলেও, শিক্ষাব্যবস্থা এখনো থেমে আছে। সেই সাথে থেমে গেছে প্রকাশনা শিল্প গুলোও। বই বাজারে আজ ভিড় নেই। অনেক বিক্রেতা খুলছেন না দোকান। ৮ মার্চ বইমেলা শেষ হওয়ার পরপরই দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়।সারাদেশে জারি করা লকডাউন। অথচ বইমেলার পরবর্তী এই সময়ে প্রকাশনীগুলোর নতুন বই ছাপায় চলে দারুণ ব্যস্ততা। সারাদেশে বই পাঠানো ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের ব্যবসা চলে জমজমাট। এবছর আর তা হয়নি। হুট করে যেন অন্ধকার নেমে আসে। এমনটা হবে কেউ কোনোদিন ভাবেনি, এমন দশাও কেউ আগে কখনো দেখেনি। ধস নেমে আসে বইয়ের বাজারে। প্রকশনা শিল্পের ব্যবসা প্রায় ৯০ শতাংশ কমে আসে।
সীমিত আকারে কর্মসংস্থান গুলো খুলে দিলেও বইয়ের বাজারের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। অনেক বিক্রেতা দোকান খুলে সারাদিন বসে থাকলেও ক্রেতার দেখা নেই। নীলক্ষেতের মোড় অনেকটাই ফাঁকা। ঢাকা শহরে প্রায় আড়াই হাজারের মত ছাপাখানা রয়েছে। ব্যবসার এই মন্দা পরিস্থিতিতে দুর্বিপাকে পড়েছেন সে সমস্ত ছাপাখানার মালিকরাও। শ্রমিকের বেতন বন্ধ। গুদামঘরে অযত্ন অবহেলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে কাগজ ও অন্যান্য সামগ্রী। ছোট বড় দোকানে ধুলো জমা পরিবেশে পড়ে আছে কয়েক লক্ষাধিক মূল্যের বই।
গত ৩১ মে থেকে প্রকাশনা সংস্থাগুলোর শো-রুম খুললেও তাতে সার্বিক পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। ইতোমধ্যেই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকায়। সব মিলিয়ে অভাবনীয় দুর্দিন নেমে এসেছে প্রকাশক থেকে শুরু করে বই বিক্রেতা, ছাপাখানার মালিক, পরিবহনকারী, মুদ্রণ, বই বাঁধাইকর্মী সকলের জীবনে। কেউ কেউ টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে গেলেও কেউ বাধ্য হয়ে বিক্রি করেছেন দোকান কিংবা কেউ ছেড়ে দিয়েছেন ব্যবসা।
বই যেহেতু আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নয় এবং বিলাসী দ্রব্য হিসেবেও এর তেমন কোনো কদর নেই তাই লকডাউন শেষে অন্যান্য ব্যবসা সচল হলেও প্রকাশনা ব্যবসা সচল হতে হয়তো অনেকটাই সময় লেগে যেতে পারে। করোনা পরিস্থিতি যদি আরো কয়েকমাস স্থিতিশীল হয় তবে এই ক্ষতির পরিমাণ ঠিক কত অংকে পৌঁছাবে তা যেন কল্পনার অতীত। তবুও প্রকাশকরা আশায় বুক বাঁধছেন যেন ২০২১ সালের বই মেলা যথা সময়েই হবে। আর করোনা কালীন এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার একটা বড় সুযোগ হতে পারে বইমেলা। কেননা সারাবছরের অর্ধেক বই মেলাতেই বিক্রি হয়।তবে চিন্তার বিষয় ক্ষতি পোষাবার তাগিদে বইয়ের মূল্য না জানি গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতাকেই না ছাপিয়ে যায়।
শত আশংকার মধ্য দিয়েও কিছু কিছু প্রকাশনা অনলাইনে বিনামূল্যে ই-বুক প্রকাশের কাজ করছেন। তবুও ভরসা চিরাচরিত কাগজের বই ছাপানোতেই। কারণ এতে শুধু লেখক আর প্রকাশকের বাইরেও অনেকের জীবিকা জড়িত রয়েছে। তাই প্রকাশনা গুলো এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে। কর্মী সংখ্যা কমিয়ে, গুদামঘর ছেড়ে দিয়ে বইয়ের সংগ্রহশালা হিসেবে বাড়ী কিংবা অফিসকে ব্যবহার করছেন।
নিকষ কালো রাতের শেষে নতুন সূর্য উঠবে এমনটাই তো চিরন্তন ঘটনা। সীমিত আকারে হচ্ছে ২০২১ এর বইমেলা। সেই আশায় এখনো অপেক্ষায় থাকা প্রকাশনা গুলো স্বপ্ন দেখেন একদিন সব মেঘ কেটে যাবে। হয়তো কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকবে সকলের প্রচেষ্টায় সচল হয়ে উঠবে অন্যান্য খাতগুলোর সাথে প্রকাশনা শিল্পও। বই বাজার হবে আবার জমজমাট।