শুধু শারীরিক নয়, মানসিক নির্যাতনেরও শিকার হতে হয় নারীকে
'কপাল খারাপ মেয়ে হয়েছে। অপয়া মেয়ে একটা ছেলে-শিশুর জন্ম দিতে পারলো না। মেয়েদের বেশি পড়াশোনা করানোর দরকার নেই। মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিন। বয়স বেড়ে গেলে কিন্তু বিয়ে হবে না। মেয়ে আবার চাকরি কেন করবে? মেয়ে সন্ধ্যার পর বাইরে কেন? মেয়ে ছেলেদের সাথে কেন মেলামেশা করছে? মেয়ে হয়ে ছেলেদের সাথে টক্কর নিতে কেন এসেছো? তুমি মেয়ে, সব কাজ তোমার জন্য না। দেখ ওই বাড়ির বউ চাকরি করছে, ছি! বাজে মেয়েদের মতো চলাফেরা করবে না। এসব কাপড় পড়তে পারবেনা। ভুলে যাবেনা তুমি একটি মেয়ে।' অনাকাঙ্ক্ষিত সত্যি হচ্ছে জন্মের পর থেকে জীবনের প্রতিটি ধাপে প্রতিনিয়ত এসব কথার শিকার হতে হয় প্রতিটি নারীকে।
মানসিক নির্যাতনের ধরনটা ব্যক্তিভেদে নানা ধরনের হয়। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে অনায়াসেই একটি মেয়েকে কটূক্তি করতে পারছে যে কেউ, কর্মস্থলে একজন নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করছেন তার সহকর্মী, নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতায় বাঁধা দিচ্ছেন পরিবার আত্মীয়স্বজন যে কেউ, তাড়াতাড়ি বিয়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করছেন স্বয়ং বাবামা, পুরুষত্ব দেখাতে বিকৃত আচরণ, ঘরের বাইরে কাজ না করতে দিয়ে স্ত্রীকে অকর্মণ্য প্রমাণ করা, সন্দেহপ্রবণতা ইত্যাদিভাবে স্ত্রীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলছে স্বামী। পারিপার্শ্বিক ভাবে নারী প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছে এসব মানসিক নির্যাতনের।
মানসিক নির্যাতন সমাজের সকল স্তরে একটি ব্যাধি বললে খুব একটা ভুল হবেনা। নারীর উপর মানসিক নির্যাতন দিনদিন এক মহামারীর আকার ধারণ করছে। শুধু নিম্ন শ্রেণির অজ্ঞ মানুষরাই নারীকে হেয় করে দেখে তেমন নয়। নারী নির্যাতনের শিকার হয় অফিসেও একগাদা উচ্চশিক্ষিত মানুষের কাছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগুরুদের সামনে। সোশাল মিডিয়ায়ও ছাড় পাচ্ছেন না নারীরা। এমনকি উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সদস্যদের কাছেও।
পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় অগ্রসর নারীদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা সর্বত্র। তবে মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে কোনো আইন রয়েছে তা বেশিরভাগ ভুক্তভোগীদেরই অজানা। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনে এ বিষয়ে মামলা করা গেলেও দেশে এ ধরনের মামলা করার হার তুলনামূলক অনেক কম। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ এর ধারা ৩ অনুযায়ী মানসিক নির্যাতনকে আইনত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এবং একে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেও গণ্য করা হয়েছে। এ ধারা অনুযায়ী 'মৌখিক নির্যাতন, অপমান, অবজ্ঞা, ভীতি প্রদর্শন বা এমন কিছু বলা, যা দ্বারা একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা হলে তা পারিবারিক সহিংসতার সংজ্ঞায় পড়বে। এছাড়াও কাউকে হয়রানি করা, তাঁর ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা, স্বাভাবিক চলাচল, যোগাযোগ বা ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা মতামত প্রকাশের উপর হস্তক্ষেপ করাও মানসিক নির্যাতন হিসেবে গণ্য করা হবে।’
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইন প্রণয়ন হলেও তা খুব একটা কাজে আসেনি এসব নির্যাতন রুখতে।যদি সচেতনতাই বৃদ্ধি না পায় তবে এসব আইন কতটা কার্যকর হবে? নারীদের প্রতি মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হলে সবার আগে সমাজ ও পরিবারের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সমাজে নারীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। নারী পুরুষের বৈষম্য দূর করতে হবে। সর্বোপরি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করলেই হয়তোবা দেখা যেতে পারে আশার আলো।