মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কামাল
লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন বাংলাদেশে আজ আমরা বাস করছি। এই স্বাধীনতার পিছনে রয়েছে অনেক রক্ত, অনেক ত্যাগ, অনেক প্রাণ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে একদিকে বাংলায় হয়েছে নির্বিচার গণহত্যা আর অন্যদিকে হয়েছে সাহসী এক দলের মায়ের ভূমি উদ্ধার করার স্বাধীনতা যুদ্ধ। বলা হয়ে থাকে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু সংখ্যাটা আসলে আরো বেশিই। মুক্তিযোদ্ধাদের এই ঋণ আসলে আমরা কখনোই শোধ করতে পারবোনা।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অস্ত্র হাতে সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছেন কেবল তাঁরাই যে মুক্তিযোদ্ধা তা নয়। যুদ্ধের পিছনেও আরো অনেক ব্যক্তি যুদ্ধের সাথে জড়িত ছিলেন যাঁদের অংশগ্রহণ যুদ্ধের জয়কে আরো এগিয়ে নিয়ে এসেছে। তাঁদের ছাড়া হয়তো বিজয় সম্ভবি ছিলোনা। যুদ্ধে কেবল যে পুরুষরাই নয় নারীরাও জীবন বাজি রেখে সাহসের সাথে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এরকম অনেকর কথাই আমরা জানিনা। এমন একজন সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধা হলেন সুলতানা কামাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন এবং অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে সুস্থ করে তুলেছেন। আজ আমরা তাঁর সম্পর্কে জানবো।
১৯৫০ সালের ২২ জানুয়ারি ঢাকায় জন্ম সুলতানা কামালের। তিনি দেশবরেণ্য প্রখ্যাত ও জনপ্রিয় কবি ও নারী নেত্রী বেগম সুফিয়া কামালের মেয়ে। পিতা কামাল উদ্দীন আহমদ খান ছিলেন হিসাবরক্ষক। তিনি একজন সাহিত্যকও ছিলেন। তাঁর পরিবারিক ডাকনাম হলো ‘লুলু’। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় লীলা নাগের নারীশিক্ষা মন্দির থেকে। এরপর তিনি আজিমপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং হলিক্রস কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। পারিবারিক কারণে শিক্ষা জীবন থেকেই তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন।
এরপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত হন। মুক্তিবাহিনী ও বাংলাদেশের পক্ষে হয়ে তিনি বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকেন। প্রথমদিকে তিনি ঢাকায় নিজ বাসায় থেকে কাজ করলেও পরবর্তীতে ঝুঁকি বাড়ায় তাঁকে পাড়ি জমাতে হয় ভারতে। কিন্তু তাঁর কর্মকান্ড থেমে থাকেনি। ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। অপারেশন সার্চলাইট এর মাধ্যমে ২৫শে মার্চ রাতে শুধু ঢাকা শহরেই ৭০০০ নিরস্ত্র বাঙালীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকবাহিনী। সুলতানা কামাল এসব নারকীয় গণহত্যার তথ্য বিবরণ দেশের বাইরে পাঠানোর কাজ করতে থাকেন। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক অবস্থান গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালান তিনি। এছাড়াও তাদের বাসায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখা, অর্থ সংগ্রহ, সংরক্ষণের কাজ করা হতো। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল ছিলো তাদের বাড়িটি। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেয়ার কাজগুলোও করা হতো সেখান থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায়ই আনাগোনা ছিলো তাঁদের বাসায়। এসব কর্মকান্ডের কারণে তাদের বাসাটি মুক্তিযোদ্ধাদের কেন্দ্রস্থল হয়ে দাঁড়ায়। এসব কর্মকান্ড তাঁর মা সুফিয়া কামালের তত্ত্বাবোধনে সম্পন্ন হতো।
কিন্তু জুন মাস থেকে এসব খুব ঝঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর স্কোয়াডন লিডার হামিদুল্লার বাড়ির কাজের ছেলেকে ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। এর কিছুদিন আগেই হামিদুল্লাহকে সীমান্ত পার করারো হয় তাঁদের মাধ্যমে। পাকিস্তানি বাহিনীর নজর পড়ার সঙ্কা তৈরী হয়। তাই সুলতানা কামাল ও তাঁর বোন সাঈদা কামাল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যান। কিন্তু ভারতে গিয়েও তাঁদের কর্মকান্ড বন্ধ রাখেননি সুলতানা। তাঁরা দুই বোন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বাংলাদেশ হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী নার্স হিসেবে চিকিৎসা দিতে শুরু করেন সুলতানা ও সাঈদা। মুক্তিযুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করার জন্য হাসপাতালটি গড়ে তোলা হয়েছিলো। এখানে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় তাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। পরবর্তীতে হাসপাতালে আরো নারী চিকিৎসক ও নার্স এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় যোগ দেন।
বাংলাদেশ হাসপাতালে যোগ দেয়ার সময় সুলতানার কোনো নার্সিং প্রশিক্ষণ ছিলোনা। কিন্তু ছিলো অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও দেশের প্রতি ভালোবাসা। এই শক্তি ও ভালোবাসা দিয়েই তাঁরা সুস্থ করেছেন হাজারো আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি দেশের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর মতো অনেক নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। দেশ স্বাধীন হলে তিনি ঢাকায় নিজ বাসায় ফিরে আসেন। বর্তমানে তিনি দেশের একজন মানকাধিকারকর্মী হিসেবে জীবন অতিবাহিত করছেন।
তিনি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে পাকসেনার সাথে সরাসরি যুদ্ধ করেননি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। একজন নারী হয়েও তিনি যে সাহসিকতার ও দেশপ্রেমের প্রমাণ রেখেছেন তা সত্যিই অসাধারণ। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের গর্ব। তাঁর জীবন থেকে পরবর্তী প্রজন্মের দেশপ্রেম ও সাহসিকতার শিক্ষা নেয়া উচিত। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি চিরদিন অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।