গোরস্তান বা কবরস্থান এবং জীবন্ত মানবকূল
আমি জানি যে, সবার ঘ্রাণশক্তি এক রকম নয়। একেকজন একেক ভাবে বিভিন্ন বস্তুর ঘ্রাণ পেয়ে থাকেন। তবে এটাও সত্য গোলাপের ঘ্রাণ কারো কাছে পোলাও এর ঘ্রাণের মতো লাগবার কথা নয়। বড়জোড় কম আর বেশি এমন তারতম্য ঘটতে পারে ব্যাক্তি বিশেষের ঘ্রাণশক্তি অনুযায়ী।
তাই আমার লেখা নামক বস্তুটির ক্ষেত্রে আমি ঘ্রাণ মূলক ব্যাখ্যাটা প্রায় সময় আগেই দিয়ে দিতে পছন্দ করি যাতে কারো কষ্ট করে লেখার আমেজ ,রস ঘ্রাণ চিপড়ে নিংড়ে বের করতে না হয়। শিরোনাম দেখে বিভ্রান্ত হবার কিছু নেই। এই লেখাতে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি, নারীনীতি, পুংনীতি, সমরনীতি কোনো পদের ঘ্রাণ নেই। লেখাটাকে সম্পূর্ণ তরল সাদা পানির সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যার আসলে কোনোই ঘ্রাণ নেই। তো ঘ্রাণের ইতিহাস শেষ আসি ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা, সেগুলো বিশ্লেষণ অর্থাৎ আমার মোটা মাথার যুক্তি প্রদান মূলক কিছু কথায়।
খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন যদি করি,
“ মানুষ কেন কবরস্থানে যায়?”
আমার মতো ঘেলুকমতি পাবলিক জোরে অতি উৎসাহে বলে উঠবে,
“ কি করতে আবার, মারা গেলে শেষ ঠিকানা! এইটা একটা প্রশ্ন হলো!”
কিন্তু যাদের মাথা একটু উন্নতমানের তারা পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন,
“ জ্বী আপনি কোন মানুষদের কথা বলছেন? জীবিত না মৃত?”
এই হলো তো কেল্লাফতে! বেচারা প্রশ্নদাতা বেকুব হলে বোকার মতো চেয়ে থাকবে। আর প্রশ্নদাতা খেলোয়াড় টাইপ হলে তো দারুণ মজা পাবে। কারণ প্রশ্ন এবং উত্তর ব্যাপারটা অনেকটাই দাবা খেলার মতো। দুই পক্ষই শক্তিশালী হলে, জমে খুব। থুক্কু কবরস্থান থেকে হুট করে ইনডোর গেমে ঢুকে গিয়েছি, ঠিক আছে বেরিয়ে আসি।
মৃত মানুষ অবশ্যই কবরস্থানে যাবে এটাই নিয়ম কিন্তু জীবিত মানুষও যায়। কি প্রয়োজনে যায় সেটার ব্যাখ্যাতে না গিয়ে আমি নিজে গত পাঁচ বছর কেন যাই বলছি। দুইটা কবরস্থানে আমার যাতায়াত ছিল আর আছে, একটা জুরাইন কবরস্থান আরেকটা মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান। গত পাঁচ বছরের ভিতর আমার এমন কাছের কেউ কেউ সেখানের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন যে, আমার যাওয়াটা আমার মন খারাপের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আমি এটাও জানি মৃত ব্যাক্তিদের জন্য প্রার্থনা করতে তার কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোটা জরুরী কিছু নয়। যেকোনো জায়গা থেকে সেটা করা সম্ভব। কিন্তু আমার তাদের জন্য মন খারাপ হয়। আমি একান্তে চুপচাপ তাদের কাছে গিয়ে নিজের মতো করে সময় কাটাতে, নিজের মনকে ঠিক করতে ভালবাসি। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
গত পাঁচ বছরে আমি বহুবার শুনেছি, মেয়েমানুষের কবরস্থানে যাওয়াটা গুনাহ। আমি নিজে কোন জ্ঞানী বা পণ্ডিত বা এই বিষয়ে তীক্ষ্ণ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যাক্তি নই। তবে অভিজ্ঞতা আমাকে বাস্তবতা শিখিয়েছে। কিছু প্রশ্ন আসতেই পারে, অসুস্থ ব্যক্তি হোক পুরুষ বা মহিলা, তাকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে কি পুরুষ , নারী বিবেচনা করবেন নাকি এগিয়ে যাবেন? মৃত ব্যক্তিদের গোসল বা ধরে এক স্থান থেকে অন্যত্র নিতে পর্যাপ্ত মানুষ নেই তখনোও লাশ ফেলে রাখবেন পুরুষ, নারী বিবেচনা করে নাকি এগিয়ে যাবেন? নারীদের পায়ে হেঁটে কবরস্থান যাওয়াটা মহাপাপ। বিজ্ঞ মানুষেদের মতামত শুনতে শুনতে আর না মানতে মানতে আমি যে পাপের বোঝা বানিয়েছি ,সেখানে আশাই করা যায় না আমি কোনোদিন জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তি পাবো কিনা! কিন্তু আমি যখন মারা যাবো, পায়ে হাঁটার ক্ষমতা আর থাকবে না তখন খাটিয়াতে করে সেই কবরস্থানে আমাকে চিরকালের জন্য রেখে আসাতে কোনো বাঁধা নেই।
তাহলে যা দাঁড়াচ্ছে, এই নারী শরীরে যতক্ষণ আত্মা নামক বস্তুটি থাকবে ততদিন আপনি কবরস্থান নামক স্থানের জন্য অভিশাপ! যেইমাত্র কোনো নারীর আত্মাটা দেহছাড়া হলো ব্যস সাথে সাথে সে কবরস্থানের জন্য হালাল হয়ে গেলো। কিন্তু আত্মার একটা ক্ষুধা আছে, সেটাকে অস্বীকার করার মত কঠিন কোনো সঠিক ধর্ম পৃথিবীতে আছে কিনা আমার জানা নেই।
উঁহু! আমাকে গালি দিবেন না। আমি স্বীকার করছি। আমি ইসলাম ধর্মের অনুসারী কিন্তু শক্ত ঈমানদার নই। সব থেকে বড় ব্যাপার হলো মিথ্যা কম বললেও ১০০% সত্যবাদী নই এবং দিনের ভিতর বহুবার পাপ চিন্তা করি ও অনেক সময় সত্য মিথ্যা মিশিয়ে একটা জগাখিচুড়ি বানানোর চেষ্টা করি, যা সব থেকে মারাত্মক। ইসলামের পরিপূর্ন বিধানগুলো মানতেও প্রতিনিয়ত ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছি। কখনো অনুতাপ হয় কখনো অনুতপ্ততা অনুভব করি না। তাই আমি জানি আমার এই বিষয়ে কথা বলাটা ঠিক মানাবে না। কিন্তু অই যে, আত্মার ক্ষুধা! আত্মাটা আমার তাই আমার অনেক প্রিয় সে আর তাকে তো আমি অভুক্ত রাখতে পারি না। তাই বলাটা খুবই উচিৎ মনে করছি। তবে আমার মতো এমন মানুষ যে এই জগতে এক পিছ আছে এটা ভাবার কারণ নেই। আমার মতো আমার থেকে উন্নত এবং অনুন্নত পাপীও এই জগতে বিপুল পরিমাণে আছে। যারা নিজেদের পাপ মুক্ত করার চেয়ে এমন সব বিষয় নিয়ে লাফালাফি করে যে সেগুলো নিয়ে লাফানোটা এমন জরুরী কিছু নয়। সেই প্রসঙ্গে পরে আসি।
একটা সহী হাদিস উল্লেখ করছি যা ইমাম তিরমিজি (রহঃ) তার প্রসিদ্ধ সুনানে (১০৫৬) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বলছেন, “ মহানবী (সঃ) কবর জিয়ারতকারী নারীদের ওপর অভিশাপ করেছেন।“ কি আমার কথা ঠিক আছে? এই হাদিস পর্যন্ত আটকে থাকতে আমাদের অনেক আরাম লাগে। আমি আসলেই পুরুষ সমাজকে একক ভাবে কখনোই দোষারূপ করি না নারীদের কোণঠাসা করার ব্যাপারে। এই সমাজে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ নারী আছেন যারা নিজেরা নারী হবার পরও অন্য নারীদের কোণঠাসা করার জন্য উসখুস করতে থাকেন। তারা কিন্তু একটু বিবেচক হলেও পারেন। একটু আলতু ফালতু দিকে সময়ে নিজেদের না নিয়ে গিয়ে কিছু পড়ালেখা করে নিজেদের আত্মিক উন্নয়ন করতে পারেন। কারণ এই হারামের কাহিনী আমি সব নারী নামক বেকুব কিছু মানুষের কাছেই বারে বারে শুনেছি। এবার ইসলাম ফাইনালি কি বলছে মন দিয়ে জানুন।
যে হাদিসটা আমরা জানলাম সেটা ছিল ইসলামের একদম প্রথম যুগের হাদিস। এটার অনেক সুন্দর যুক্তিও ছিলো। কারণ নারীরা মানসিকভাবে একটু বেশি দূর্বল তাই কবরস্থানে গিয়ে কান্নাকাটি করতে পারেন আবার নিরাপত্তাজনিত কিছু ব্যাপারের দিকে নজর রেখে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কি হলো?
মুস্তাদরাকে হাকিম (১৩৯৬) এ পাওয়া যায়, “হজরত আলী (রাঃ) বলেছেন,” নবী (সাঃ) কন্যা হজরত ফাতেমা (রাঃ) প্রতি জুমাবারে তার চাচা হজরত হামজা (রাঃ) এর কবর জিয়ারত করতেন। সেখানে নামাজ পড়তেন, কান্নাকাটি করতেন।“
এছাড়াও মুস্তাদরাকে হাকিম (১৩৯২), সুনানে বায়হাকি (৬৯৯৯)তে বলা হয়েছে, নবী (সাঃ) পত্নী হজরত আয়েশা (রাঃ) উনার ভাই আবদুর রহমান ইবনে আবু বকরের কবর জিয়ারত করতেন। তাহলে এত পাপ হলে এমন বিদূষী নারীগণ কিভাবে নারী হয়ে কবর স্থানে গিয়ে কবর জিয়ারত করতেন? ভেবেছেন বা কোনো ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন কি? না করলে আমি বলি আপনি শুনুন দয়া করে।
একদিন আয়েশা ( রাঃ )কে কবরস্থান থেকে ফিরতে দেখে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবি মুলাইকা জিজ্ঞেস করলেন?
“ নবী (সাঃ) কি নারীদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেন নি?
উত্তরে আয়েশা (রাঃ) বললেন,
“ হ্যাঁ নবী (সাঃ) নিষেধ করেছিলেন নারীদের কবর জিয়ারত করতে কিন্তু পরবর্তীতে কবর জিয়ারতের আদেশ করেছিলেন।“
এখন এই প্রসঙ্গে আমরা যদি ইমাম তিরমিজি (রহঃ) এর মতামত জানতে চাই তাহলে তিনি ইসলামী স্কলারদের মতামতের উপর ভিত্তি করে লিখেছেন,
“ নারীদের কবর জিয়ারত অভিশাপ এটা ইসলামের প্রথম যুগের হাদিস। পরবর্তীতে যখন নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়ে কবর জিয়ারতের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে তখন সেই অনুমতি নর এবং নারী নির্বিশেষে সবার জন্যই দেওয়া হয়েছে।“
এখানে খেয়াল রাখার ব্যাপার একটাই আছে, সেটা হলো ইসলামি আচরণ বিধি মোতাবেক সেখানে সবাইকে অবস্থান করতে হবে, এইটুকুই।
ওই যে বলছিলাম যা অন্যকে কোণঠাসা করা যাবে অথবা একটু অহেতুক উত্তেজনা তৈরি করে দৃষ্টি আকর্ষণ হবে তাই নিয়ে লাড়াচাড়া দিতে খুব ভালবাসি। আসল ব্যাখ্যা সুন্দর ব্যাখ্যা যা সবাইকে শান্ত করতে পারে, জানলেই মুখটা কালো প্যাঁচা টাইপ হয়ে যায়। মিন মিন করে সেটাকেও ভুল প্রমাণ করে আবার উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাই। এই পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে শুধুমাত্র মানুষের কল্যাণ আর শান্তির জন্য প্রবর্তন হয়েছে। আর যদি বলেন সৃষ্টিকর্তার কথা তিনি এতোটাই শক্তিশালী যে, কিছু পথভ্রষ্ট মানুষ তাঁকে ছোট করার এক বিন্দু ক্ষমতাও রাখে না। তাঁরা এক জাতের বেকুব আর তাঁদের সাথে মাঝে মাঝে আমরাও বেকুব হয়ে পড়ি। আর সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত সম্মানিত দূতগণ যারা এসেছিলেন এই পৃথিবীতে মানুষদের সঠিক পথ দেখাতে তাঁদের সকল দায়িত্ব স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা নিয়েছেন বলেই আমরা জানি। তাহলে কোনো ছাগুর দল কোথায় কি করলো সেটা নিয়ে অস্থির হবার কিছুই নেই। কারণ এতে ধর্ম ও তাঁর সঠিক অনুসারীদের কোনই ক্ষতি তারা করার ক্ষমতা রাখে না।
মানুষ হিসেবে আমাদের সবার স্বাধীন মতামত প্রদানের অধিকার আছে। যিনি নাস্তিক তিনিও মানুষ হিসেবে সম্মানিত। যিনি ধর্ম মানেন কিন্তু পালন করেন না তিনিও সম্মানিত। কারণ সবাইকেই কিন্তু আপনার সৃষ্টিকর্তাই সৃষ্টি করেছেন যা আপনার বিশ্বাস। ঝামেলা হচ্ছে কিছু মানুষ নিয়ে যারা ধর্ম মানেন, অনুসরণ সবই করেন কিন্তু ধর্ম নিয়ে সঠিক জ্ঞান চর্চা না করে কুসংস্কারচ্ছন্ন হয়ে থাকতে ও করে রাখতে ভালবাসেন।
আসুন না আমরা যে যার নিজস্ব ধর্মকে ঠিকঠাক মতো জানি, চর্চা করতে শিখি। আত্মাকে অভুক্ত না রাখি। জীবনটা অনেক ছোট কিন্তু বেশ সুন্দর তাই এটাকে অহেতুক আর জটিল না করি।
লাজ্বাতুল কাওনাইন
প্রভাষক,
আহসানিয়া মিশন কলেজ, ঢাকা।
প্রবন্ধ ও গল্পকার