ধর্ষকদের আতঙ্কের নাম ছিলো- ফুলন দেবী!
বর্তমানে সারাদেশ জুড়ে ধর্ষণের খবরে একাকার। ভাইয়ের কাছে বোন ধর্ষন, শিক্ষক এর কাছে ছাত্রী ধর্ষন, বাবার কাছে মেয়ে ধর্ষন, স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষন। ক্রমাগত বেড়েই চলছে ধর্ষণের সংখ্যা। বিভৎসকর এ সংখ্যা দেখতে দেখতে ক্লান্ত এবং আতংকিত পুরো জাতি। যুগ যুগ ধরে ধর্ষণের মতো এমন ঘৃণ্য এবং পাশবিক ঘটনার শিকার হয়ে আসছে নারী সমাজ, তারা শিকার হচ্ছে কোনো না কোনো ঘৃণ্য, নিকৃষ্ট পুরুষের লালসার।
তেমনি এক নারী ছিলেন ফুলন দেবী। তবে তিনি ধর্ষণের পর অন্যসব নারীদের পথ বেছে নেন নি। তিনি আত্মহত্যার পথও বাছেননি বা লোকলজ্জার ভয়ে ঘরে লুকিয়ে থাকার পথও বেছে নেননি। বরং পরবর্তীতে তিনিই হয়ে দাড়িয়েছিলেন ধর্ষকদের জন্য যমদূত। ' দস্যু রানী ' নামে পরিচিত ছিলো এই নারী।
উত্তর প্রদেশের জালৌন জেলার অন্তর্গত ঘোড়া কা পুরয়া নামক স্থানে এক মাল্লা সম্প্রদায়ে ১৯৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন ফুলন দেবী। মাল্লা সম্প্রদায়কে নিম্ন বর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। মাত্র ১১ বছর বয়সে ৩০ বছরের পুট্টিলাল নামক এক ব্যক্তির সাথে ফুলনের বিয়ে হয়। পুট্টিলাল ছিলেন একজন অসৎ চরিত্রের লোক । ফুলনের সঙ্গে তিনি বলপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন ও শারীরিক অত্যাচারের মতো ঘটনা ঘটিয়ে আসছিলো।
অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে ফুলন বাবার বাড়িতে ফিরে যান। কিন্তু ভারতীয় সমাজ তার গায়ে অসৎ চরিত্রের তকমা লাগিয়ে দেন । ১৯৭৯ সনে মায়াদিন চুরির অভিযোগে ফুলনকে গ্রেপ্তার হয়। ফুলনের তিনদিন কারাবাস হয়। কারাবাসে তিনি আইনরক্ষকের হাতে ধর্ষণের শিকার হন।
কেউ কেউ বলেন ডাকাতের দল ফুলন দেবীকে অপহরণ করেন আবার অন্য এক প্রবাদ মতে তিনি স্বেচ্ছায় ডাকাতের দলে যোগদান করেন। সেই ডাকাত দলের দলনেতা বাবু গুজ্জর কয়েকবার ফুলনদেবীকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। কিন্তু সে দলের দ্বিতীয় দলনেতা বিক্রম মাল্লার প্রতিবাদ করে এবং বাবু গুজ্জরকে হত্যা করে।
অবশেষে বিক্রম তাকে বিবাহ করে ও পত্নীর মর্যদা দেন। অতঃপর ডাকাত দলটি ফুলনের প্রথম স্বামী পুট্টিলালের গ্রামে লুন্ঠন করে। ফুলন পুট্টিলালকে টেনে নিয়ে এসে জনসমক্ষে শাস্তি দেয় ও খচ্চরের পিঠে উল্টো করে বসিয়ে নির্জন স্থানে নিয়ে এসে বন্দুক দিয়ে প্রহার করে । প্রায় মৃত অবস্থায় পুট্টিলালকে ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় কম বয়সের বালিকা মেয়ে বিবাহ করা পুরুষদের জন্য সাবধানবাণী স্বরূপ একটি পত্র রেখে যায় তারা।
বিক্রম মাল্লার কাছে বন্দুক চালনার প্রশিক্ষন নিয়েছিল ফুলন দেবী। এরপর উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশ বসবাসকারী উচ্চ বর্ণের লোকদের গ্রামে লুন্ঠন, ভূস্বামীদের অপহরণ, রেল ডাকাতি ইত্যাদি বিভিন্ন অভিযান চালানো শুরু হয়। চম্বল উপতক্যায় এই ডাকাতের দল আত্মগোপনে থাকতো । বিক্রম মাল্লার অপরাধ জগতের গুরু ছিলো শ্রীরাম নামের ডাকাত সম্প্রদায়ের এক ডাকাত। তাকে কারারুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে বিক্রম। মুক্তি পাওয়ার তাকে দলের ভার বহন করার জন্য আহ্বান জানান। শ্রীরাম ছিলেন নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ। শ্রীরাম বিক্রেমকে হত্যা করা সুযোগের সন্ধানে ছিল। কিছুদিন পর শ্রীরাম বিক্রমকে হত্যা করে ও ফুলনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
শ্রীরাম ফুলনকে উলঙ্গ প্রায় অবস্থায় এক গ্রামে নিয়ে যায় ও ঘোষণা করেন যে ফুলন দেবী বিক্রমকে হত্যা করেছে। ফুলনকে শাস্তি দেওয়ার জন্য গ্রামবাসীদের আদেশও করেন। শাস্তিস্বরুপ প্রথম শ্রীরাম ফুলনকে ধর্ষণ করে। তারপর এক এক করে বহু ঠাকুরে তার উপর যৌন ও শারীরিক নির্যাতন করে। ৩ সপ্তাহের অধিক সময় তার উপর অমানুষিক অত্যাচার করা হয়। ২৩দিন পর ফুলন নিজেকে ঠাকুর সম্প্রদায়ের গ্রাম বেহমাই এ নিজেকে আবিস্কার করে। অবশেষে এক ব্রাহ্মণ ব্যক্তির সাহায্যে ফুলন বেহমাই থেকে পলায়ন করেন।
ফুলনের দুঃখের কাহিনী শুনে বাবা মুস্তাকিন নামক এক ডাকাতের নেতা তাকে নতুন একটি ডাকাতের দল গঠন করতে সাহায্য করে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ফুলন তার উপর অত্যাচারকারীদের সন্ধান আরম্ভ করেন । যার মধ্যে প্রধান ছিলেন শ্রীরাম ও তার ভাই লালা রাম। অবশেষে সন্ধান পান যে, শ্রীরাম বেহমাই গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। ফুলনকে নির্যাতিত করার ১৭মাস পর, ১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রয়ারী তারিখে ফুলন তার উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বেহমাই গ্রামে প্রবেশ করে। কিন্তু পুরো গ্রাম খুজেও তাদের সন্ধান পাননি। পরে ডাকাতের দল গুলি করে গ্রামের ২২ জনকে হত্যা করে। তবে জানা যায়, নিহত সবাই ধর্ষণের সাথে জড়িত ছিলো না। এটিই হচ্ছে কুখ্যাত বেহমাই হত্যাকাণ্ড বা বেহমাই গণহত্যা।
বেহমাই হত্যাকাণ্ডের জন্য সেই সময়ের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ভি.পি. সিং পদত্যাগ করার জন্য বাধ্য হয়েছিলেন এবং ফুলনদেবীও জনপ্রিয় হয়ে উঠেন দস্যুরাণী নামে। যদিও ফুলন ছিলেন ডাকাত কিন্তু তার মন ছিল মায়া, মমতায় ভরা। সেই সময়ে উত্তর প্রদেশের শহরগুলিতে দূর্গাদেবীর বেশে ফুলনের মূর্তি বিক্রি হতো।
বেহমাই হত্যাকান্ডের ঘটনায় পুরো ভারত জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পুলিশি হামলায় তার দলের অনেক সদস্য নিহত হয় কিন্তু তাকে ধরতে পারেনা পুলিশ। একপর্যায়ে পুলিশ তার বাবা-মা কে গ্রেপ্তার করলে কিছু শর্তসাপেক্ষ বেহমাই হত্যাকাণ্ডের প্রায় দুই বৎসর পর ১৯৮৩ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় ৮০০০ জন দর্শকের উপস্থিতিতে ফুলন আত্মসমর্পণ করেন। দেবী দুর্গা ও মহাত্মা গান্ধীর ফটোর সন্মুখে তিনি বন্দুকটি রেখে আত্মসমর্পণ করেন।১১ বছর কারাবাস শেষে ১৯৯৪ সনে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।
কারামুক্তির পর তিনি ধীরে ধীরে পা রাখেন রাজনৈতিক জীবনে। ১৯৯৬ সনে সমাজবাদী পার্টি ফুলনকে মির্জাপুর আসনের জন্য টিকেট প্রদান করে। ভারতীয় জনতা পার্টি ও বেহমাই হত্যাকাণ্ডে নিহত হওয়া ঠাকুরের পত্নীরা ঘোর বিরোধ করা সত্বেও তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হন। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সনের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ফুলন পরাজিত হলেও ১৯৯৯ সনে মির্জাপুর লোকসভা নির্বাচনে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন।
২০০১ সনের ২৫ জুলাই তারিখে নয়া দিল্লিতে ফুলন দেবীকে হত্যা করা হয়। তার দেহরক্ষীও আহত হয়। সেই সময়ে তিনি সংসদ থেকে বের হয়ে আসছিলেন। হত্যাকারীরা তাকে গুলি করে অটোরিক্সায় উঠে পালিয়ে যায়। এভাবেই শেষ হয় ফুলন দেবীর অধ্যায়। যিনি নারীদের মাথা উচু করে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন। বারবার বিচার না পেয়ে নিজেই নিয়েছিলেন নিজের প্রতিশোধ। বাল্যবিবাহ, ধর্ষন রোধে রেখেছিলো যুগোপযোগী ভুমিকা।
বেশীরভাগ অপরাধ তিনি নির্যাতিত মহিলা ও বিশেষকরে নিম্ন শ্রেনীর মহিলাকে ন্যায় প্রদানের জন্য সংঘঠিত করেছিলেন। তাই তখনকার দিনে ধর্ষকও নারী নির্যাতনকারীদের কাছে এক আতঙ্কের নাম ছিলো ফুলেন দেবী।