কন্যাশিশু পরে, আপাতত উন্নয়ন চাই!

এমন একটি অমানবিক দৃশ্যের ভেতর দিয়ে শুরু হয় ভারতীয় পরিচালক প্রকাশ ঝাঁর ছবি মাতৃভূমি, যার ইংরেজি সাবটাইটেল, ‘এ নেশন উইদাউট উইমেন’।
এরপর সিনেমার গল্প এগোতে থাকে। আমরা উপস্থিতি হই ভবিষ্যতের এক গ্রামে। মেয়েশিশু খুন হতে হতে নারী-শূন্য হয়ে পড়েছে গ্রামটি। বিপত্নীক রামসারানের পাঁচ ছেলের মধ্যে বড় ছেলের জন্য বিয়ের পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। এরপর একদিন পাশের মাঠে এক বাবা তার মেয়েকে গ্রাম থেকে বাঁচিয়ে গোপনে বসবাস করার খবর আসে রামসারানের কাছে। রামসারান তার বড় ছেলের জন্য যায় ওই বাবার কাছে। বাবা প্রথমে রাজি না হলে চাষের জমি, নগদ টাকা আর হালের গরু দিয়ে রাজি করানো হয়। আসবার সময় রামসারান বলে- আমাদের সময় মেয়ের বিয়েতে ছেলেকে এসব (টাকা-জমি) দিতে হতো, আর এখন মেয়ের বাপকে দিতে হচ্ছে! কালকি নামের ওই মেয়েকে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাড়ি তোলে রামসারান।
সবচেয়ে ছোটছেলের সঙ্গে কালকিকে বিয়ে দিয়ে ঘরে তুললেও আসলে তাকে আনা হয় পুরো পরিবার এমনকি গ্রামের অন্যসব পুরুষদের জন্যও! কালকির বাবা কালকি ছোটো বলে রামসারানের বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে আপত্তি তোলে। এরপর সে ছোট ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলেও তার অজান্তেই সে মেয়ের বিয়ে দেয় একগ্রাম পুরুষের সঙ্গে! কালকিকে বাড়ি তুলেই কে কতরাত কালকির সঙ্গে থাকবে সেই ভাগাভাগিতে বসে রামসারানের পাঁচ ছেলে। রামসারান নিজের নামও প্রস্তাব করে সেই ভাগাভাগিতে। বাবা হিসেবে ছেলের বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে সে-ই প্রথম রাত্রিযাপন করে। এরপর শুরু হয় কালকিকে পালাক্রমে ধর্ষণ। প্রায় গ্রামসুদ্ধ মানুষ একটা অল্পবয়সী মেয়েকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে চলে। কালকিকে ভালোবাসার অপরাধে রামসারানের এক ছেলেকে হত্যা করে অন্য ছেলেরা। কালকি অন্তঃসত্ত্বা হলেও ধর্ষণ চালিয়ে যাওয়া হয়। পরে অন্তঃসত্ত্বার খবর প্রকাশ পেলে পিতৃত্বের দাবি তোলে প্রায় সবাই। শেষ পর্যন্ত বাবা রামসারানের দাবির কাছে চুপ মেরে যায় ছেলেরা। পিতৃত্বের দাবি নিয়ে দুই মহল্লার বিবাদ বাধে। বিবাদ থেকে হানাহানি-খুনোখুনি। এরইমাঝে কালকি সন্তান প্রসব করে, কিন্তু কন্যসন্তান।
আপনার কি মনে হয়, এই সিনেমার কাহিনীর সঙ্গে আমাদের দেশের সমকালীন সমাজ বাস্তবতার কোনো মিল আছে? হয়ত নেই। আমাদের দেশে মেয়েশিশুর ভ্রুণহত্যার বিষয়টি তেমন একটা ঘটে না। বরং দেখা যায় অনেক বাবা-মা তাদের প্রথম সন্তান হিসেবে কন্যা সন্তান কামনা করেন। প্রথম সন্তান ছেলে হলে অনেকে দ্বিতীয় সন্তান নেন মেয়ে সন্তানের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য। তাহলে এই সিনেমার গল্প বলা কেন?
গল্প বলছি অন্য কারণে। একটা পরিসংখ্যান আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কদিন থেকে খুব দেখছি। এ বছর প্রথম ছয় মাসেই সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩১ জন নারী ও শিশু। যাদের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৬ জনকে। এদের মধ্যে ৩৯৯জন শিশু, মৃতের সংখ্যা যেখানে ১৬জন। গতবছর সারাদেশে ৯'শ ৪২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এবছর প্রথম ছমাসের হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি গত বছরের চেয়ে এ বছর ধর্ষণের ঘটনা প্রায় দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। বেড়েছে শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ এবং ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার সংখ্যা। হঠাৎ ছয় মাসে এমন কী হলো যে এতো বেশি ঘটছে এই ঘটনা? এমন প্রশ্ন আমরা করতেই পারি।
মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আয়েশা খানম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বাচ্চাদের আমরা ভয়ে অ্যাকুরিয়ামের মধ্যে রেখে দিচ্ছি, তাদের এতোটাই নিরাপদে রাখতে চাইছি যে তারা স্বাভাবিকভাবে বড়ই হতে পারছে না। অথচ বাচ্চারা তো প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াবে। কিন্তু সেই পরিবেশটা তাদের দিতে পারছি না। অন্যদিকে পরিবারেও তারা নিরাপদ না। মামা, চাচা, ফুফা কারও কাছেই নিরাপদ না। এটা কেন হবে? কেন সমাজের এই পরিবর্তন?’
এই প্রশ্নোগুলোর সরল উত্তর আর আমাদের জানা নেই। আমরা অনেক কিছু সরলীকরণ করে ফেলেছি। গ্রামীণ যুবসমাজ ধর্ষণ-হত্যা করলে বলি, সমস্যা মাদকে কিংবা পারিবারিক শিক্ষায়। শহরের যুবসমাজ ধর্ষণ-হত্যা করলে বলি, সাংস্কৃতিক অবক্ষয় কিংবা নৈতিক শিক্ষার অভাব বা পর্নো আসক্তি। দিনমজুর/শ্রমিক ধর্ষণ-হত্যা করলে বলি, সমাজে সুস্থ বিনোদনের অভাব, পতিতাপল্লির সংকট। মাদ্রাসার শিক্ষক ধর্ষণ-হত্যা করলে বলি, সমস্যা পশ্চাতমুখী ধর্মীয় শিক্ষায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ধর্ষণ-হত্যা করলে বলি, সমস্যা পাশ্চাত্যমুখী অইসলামিক শিক্ষায়। আর একটা কমন সমস্যার কথা বলি—নারীর পোশাকে সমস্যা, চলনে সমস্যা। কখনো সরাসরি আমরা বলি না, সমস্যা পুরুষের। পুরুষের চরিত্রের ঐতিহাসিক সমস্যা এটা। নারী আদিম, প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক সকল যুগে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে, হচ্ছে। নারী ঘরে বাইরে শিক্ষালয়ে প্রার্থনালয়ে কর্মস্থলে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে, হচ্ছে। কারণ আমরা সমস্যা খুঁজেছি নৈতিক শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, প্রতিষ্ঠানে, মাদকে, নারীর শরীরে, নারীর পোশাকে, নারীর চলবে।
সমাজের সকল শ্রেণি ও পর্যায়ভুক্ত কোনো না কোনো পুরুষ যখন ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন মাদ্রাসা শিক্ষা, আল্ট্রা-আধুনিকতা, মাদকদ্রব্য, পর্নোগ্রাফি, নৈতিক শিক্ষার অভাব, সাংস্কৃতিক অবক্ষয় নারীর খাটো পোশাক—এসব অজুহাত দাড় করিয়ে লাভ হবে না। সমস্যা পুরুষের চরিত্রে, পুরুষের মননে। হাজার হাজার বছর ধরে পুরুষ ধারণাটি কতগুলো ভুল ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তার বাড়াবাড়ি রকমের অহংবোধ। কিন্তু একবারেও ভাবে না, কোনো না কোনো মাতৃগর্ভ থেকেই তাকে জন্ম নিতে হয়। প্রকৃতির মতোই শক্তিমান একজন মা। পুরুষ শক্তি খোঁজে তার পেশীতে, বাহুতে। কে বেশি শক্তিশালী, একজন মানুষ, না একটি বৃক্ষ? কে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ একপাক্ষিকভাবে নির্ণয় করেছে নিজেকে।
মানুষ মানে পুরুষ। পুরুষ নারীকে এখনো সৃষ্টির সেরা জীব মনে করে না। কারণ তাদের পুরুষ চিরকালীন পবিত্রগ্রন্থে নির্ণয় করে দিয়েছে, নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে পুরুষ সৃষ্টির অনেক পরে তাকে সঙ্গ দিতে। এখানেই শেষ না, বলা হয়েছে, নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে পুরুষের শরীরের বাকা হাড় দিয়ে। সৃষ্টিকর্তা চাইলে ইভকে আদমের মতোই স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু সৃষ্টিলগ্নেই পুরুষ নারীর ভবিষ্যৎ সৃষ্টিকর্তার নাম দিয়ে নির্ধারণ করে ফেলেছে। এখন নারীরাও চাইলে এটা খণ্ডন করতে পারেন না। এতে নারীর ধর্ম থাকে না। নারী থাকবে পুরুষের অধীনে। এই সৃষ্টিকর্তাকে আবার আবিষ্কার করেছে পুরুষই। ফলে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে পুরুষের প্রতিনিধি হিসেবে পুরুষ সৃষ্টিকর্তাকে পেয়েছে নারীরা। নারীরা কেন সৃষ্টিকর্তাকে আবিষ্কার করেনি? এ প্রশ্নের এক ধরনের উত্তর আমি দিতে পারি। নারীরা প্রকৃতিতুল্য। প্রকৃতির মতো ঐতিহাসিকভাবেই নারীর ভেতর ভণ্ডামি কম। নারী অসৎ মিথ্যাবাদী হতে পারে। কিন্তু নারী কোনো ধর্মপ্রবক্তা হয় না, নারী কোনো হিটলার হয় না। পুরুষের পৃথিবীতে তাকে টিকে থাকার প্রশ্নে কিছুটা হিংস্র, অন্যায়-প্রবণ হতে হয় বটে, ছলনা করতে হয়, কিন্তু চূড়ান্ত ভণ্ড তাকে হতে দেখি না। ফলে তার মেধা ও শক্তি নিয়ে পুরুষের মনে প্রশ্ন জাগে। কারণ পুরুষ কখনই বৃক্ষত্বকে শক্তিশালী জ্ঞান করতে শেখেনি। এই যে হাজার হাজার বছর ধরে পুরুষ ধারণাটি কতগুলো ভুল ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেটাকে এখন ভাঙতে হবে। কিন্তু কাজটা কিভাবে হবে? এই প্রশ্ন আমাকে কেউ করলে সরল উত্তর দিতে পারব না।
কেউ কেউ হয়ত সামাজিক আন্দোলনের কথা বলবেন। দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বন্ধ করতে বৃহৎ সামাজিক আন্দোলন নিশ্চয় দরকার আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেই আন্দোলন হবে কিভাবে? এটা তো সম্ভব নয়, মানুষ আর সব অপরাধ (ঘুষ, দুর্নীতি, প্রশ্ন-ফাঁস, ঋণখেলাপি, ধর্মীয় ভণ্ডামি, মাদক চোরাচালান ইত্যাদি) ঠিকই করবে কেবল ধর্ষণ করবে না? সমাজের অন্য অপরাধ কি আরেকটি অপরাধকে উসকে দেয় না? (সমাজের অধিকাংশ মানুষ যখন কোনো না কোনো ভাবে অসৎ, সুবিধাবাদী, দুর্নীতিগ্রস্ত সেখানে বৃহৎ সামাজিক আন্দোলনে অংশ নেবে কারা?) আমরা চাই ধর্ষকের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। কিন্তু যেখানে প্রভাবশালী মহল থাকে যারা নির্ধারণ করে তাদের লোকজনের শাস্তি হবে কিনা, সেখানে ধর্ষকও যে কোনো না কোনো মহলের বাঁধা লোক না, সেটা আমরা নিশ্চিত হবো কেমন করে?
এমন অনেক জটিল হিসাব আমাদের সামনে চলে আসে। আমরা খাতা কলম নিয়ে বের হওয়ার পথ খুঁজি একটা অচল সমাজ ব্যবস্থা থেকে। কিন্তু এর মধ্যে যে পিতামাতার শিশুসন্তান চলে যায় ধর্ষকের ক্ষণিক মুহূর্তের পাশবিক উন্মাদনার শিকার হয়ে, তার বাবা-মাকে বলতে শুনি, আপনারা কন্যাশিশুদের সাবধানে রাখুন। পারলে মেয়েশিশুকে ভ্রূণ থাকতে হত্যা করুন, যাতে তাকে এভাবে মরতে দেখতে না হয়। তখন তাদের আহ্বান শুনে আমার সদ্য অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে বলতে হয়, আমাদের দ্বিতীয় সন্তানও ছেলে হোক। মেয়েশিশুর স্বপ্ন আমাদের পূরণ না-হোক। অন্তত এদেশের এই বাস্তবতায় আর মেয়েশিশু প্রত্যাশা করতে পারি না আমরা।
দেশ যখন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। পদ্মাসেতুর পিলার দেখি টেলিভিশন খুললে, রাজধানীর জ্যামে আটকে থেকে দেখি মেট্ট্রো রেলের কাজ চলছে, উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, তখন আমরা ঘরে বসে ভাবি কন্যাশিশুর জন্য দেশ এখন তৈরি না। আমরা অবশ্যই উন্নয়ন চাই। যখন আর কোনো উন্নয়নের প্রয়োজন হবে না, তখন নিশ্চয় সমাজ রাষ্ট্র প্রশাসন আমাদের কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাববে। তখন আমরা দেখবো বাড়ি বাড়ি ফুল ফুটেছে কন্যাশিশুর। কিন্তু ভয়টা এখানেই, তার আগে দেশটা যেন ‘মাতৃভূমি’ নামক সেই সিনেমার মতো না হয়ে যায়!
[অনন্যা আর্কাইভ থেকে]