‘তুরিন হর্স’ ও বেলা তারের সাক্ষাৎকার
বেলা তারের জন্ম ১৯৫৫ সালে মধ্য-ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরিতে। মাত্র বাইশ বছর বয়সে ‘সিনেমা ভেরিতে’ আঙ্গিকে নিজের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ফ্যামিলি নেস্ট [১৯৭৭] নির্মাণ করেন। প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের পর চলচ্চিত্র বিদ্যায়তনে [ফিল্মস্কুল] পাঠ গ্রহণ করতে যান। পরবর্তীকালে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে বদলেছেন। অনেকেই তাকে ‘মানবীয়-নৈরাশ্যবাদী’ নির্মাতা হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। ক্যারিয়ারের ৭ম চলচ্চিত্র ড্যাম্নেশন [১৯৮৮] নির্মাণ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেন। এখন পর্যন্ত তিনি ১৭টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
২০০৭ সালে তার দ্য ম্যান ফ্রম লন্ডন কান চলচ্চিত্র উৎসবে বেশ ইতিবাচক সাড়া পায়। ২০১১ সালের বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে তার তুরিন হর্স চলচ্চিত্রটি ‘শ্রেষ্ঠ বিচারকম-লি পদক’ অর্জন করে। এছাড়াও চার দশকের চলচ্চিত্রযাত্রায় তিনি আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননা অর্জন করেছেন। মার্কিন সমালোচক জোনাথন রোজেনবাম তাকে একজন ‘পার্থিব তারকোভস্কি’ নামে অভিহিত করেছেন। লম্বাদৈর্ঘ্যরে দৃশ্যধারণ [লংটেক শুটিং] এবং দার্শনিক ভাবধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে তিনি জগৎবিখ্যাত। অনেকের মতে, মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা গাস ভ্যান স্যান্টের পরের দিকের চলচ্চিত্রে বেলা তারীয় প্রভাব লক্ষ করা যায়।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে [বিসিটিআই] চলচ্চিত্র নির্মাণ পাঠকক্ষে, শিক্ষক জাহিদুর রহিম অঞ্জনের কাছে প্রথমবারের মতো তুরিন হর্স চলচ্চিত্রের অংশবিশেষ দেখি। পরে অঞ্জনদা’র কাছ থেকে চলচ্চিত্রটি সংগ্রহ করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাসায় গিয়ে পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রটি দেখার পর, এর প্রধান দুই চরিত্র বাবা এবং মেয়ের ক্রমাগত [প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশে গৃহবন্দি অবস্থায়] সিদ্ধ আলু খেয়ে যাওয়া দেখে, সেসময় আমি বেশ কিছু দিন সিদ্ধ আলু খাওয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি! ঘটনাটি উদ্ভট মনে হতেই পারে! আলু নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা যা-ই হোক, তুরিন হর্স একটি কিংবদন্তীতুল্য [মাস্টারপিস] চলচ্চিত্র তাতে কারও দ্বিমত থাকার কথা না।
১৮৮৯ সালে ইতালির তুরিন শহরে অবস্থান কালে বিশ্ববিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিৎসের [১৫ অক্টোবর ১৮৪৪-২৫ আগস্ট ১৯০০] জীবনে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার জের ধরে, বেলা তার এ মহান চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তুরিনের পথ দিয়ে যাওয়া সময় নিৎসে মহোদয় এক নির্মম ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। তিনি দেখলেন, একজন ঘোড়াগাড়িচালক তার আসনে বসে নিজের অনড় ঘোড়াকে নির্দয়ভাবে চাবুক মেরে যাচ্ছে। এ নির্মমতা দেখে, তিনি নিজেকে ঘোড়া এবং চাবুকের মাঝে ঠেলে দিলেন এবং পরক্ষণেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং চিরতরে স্বজ্ঞা হারান। এ ঘটনার পর, দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিৎসে আরও এগারো বছর বেঁচেছিলেন, এ সময় লেখালেখি করা দূরে থাক তিনি কথা পর্যন্ত বলতে পারেননি। এই অদ্ভুত ঘটনার প্রায় একশো বছর পর, বেলা তার এ ঐতিহাসিক গল্পটি শোনেন। গল্পটি বেলা তার’কে ভীষণভাবে ভাবিত করে তোলে।
বিগত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে, বেলা তারের সহ-চিত্রনাট্যকার লাজলো ক্রাজনাহরকাই, ফ্রেডরিখ নিৎসের স্বজ্ঞা হারানোর ঘটনাটি নতুনভাবে গল্প আকারে লিখেন। ক্রাজনাহরকাইয়ের গল্পটি যে বাক্য দিয়ে সমাপ্ত হয়, তুরিন হর্স-এর গল্পটি সেখান থেকে শুরু। ১৯৯০ সালে, তার এবং ক্রাজনাহরকাই মানিকজোড় তুরিন হর্স চলচ্চিত্রের সারাংশ রচনা করেন। কিন্ত সেসময় স্যাটানট্যাঙ্গো [১৯৯৪] চলচ্চিত্রের কাজ করতে গিয়ে তুরিন হর্স বাক্সবন্দি পড়ে রয়। অনেক পরে, দ্য ম্যান ফ্রম লন্ডন [২০০৭] নির্মাণের পরপর ক্রাজনাহরকাই তুরিন হর্স-এর সারাংশটিকে গদ্যাকারে লিখে ফেলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে চিত্রনাট্যকারদ্বয় কোনো প্রথাগত চিত্রনাট্য রচনা করেননি।
আগেই উল্লেখ করেছি, নির্মাতা বেলা তার, ফ্রেডরিখ নিৎসের স্বজ্ঞা হারানোর বিশেষ ঘটনাটি এ চলচ্চিত্রে চিত্রায়ন করেননি, তিনি দেখিয়েছেন ঘটনার পর বেচারা ঘোড়ার পরিণতি কি হয়েছিল। এই পরিণতি ঘিরে তার সমগ্র চলচ্চিত্রটি। চলচ্চিত্রের পর্দায় তুরিন শহরের এ ঘোড়া চরিত্রটি ছাড়াও, ঘোড়ার মালিক এবং তার একমাত্র কন্যা এখানে অন্যতম চরিত্র হিসেবে উপস্থিত রয়েছে। তবে নাটের গুরু নিৎসে মহোদয় অনুপস্থিত। চলচ্চিত্রের শুরুতে একজন সূত্রধরের কণ্ঠে ঐতিহাসিক গল্পটির সারাংশ সমেত ফ্রেডরিখ নিৎসের নাম উচ্চারিত হয়েছে কেবল, তাকে পর্দায় দেখা যায়নি।
এক আলাপচারিতায় নির্মাতা বেলা তার জানিয়েছেন, এটি কোনো নিছক নৈতিক চলচ্চিত্র নয়, বরং এর গুরুত্ব মানুষের অস্তিত্বে সমান, বাস্তবিক জীবনের মতোন। তিনি বলেছেন, “আমরা দেখাতে চেয়েছি মানুষের আটপৌরে শ্রমসাধ্য এবং শোচনীয় জীবন।” তার মহোদয় আরও বলেন, “শুরুর দিকে আমি ভাবতাম চলচ্চিত্র দিয়ে দুনিয়া পাল্টে দেবো। আস্তে আস্তে আমি বুঝতে শিখলাম, মানুষের সমস্যাগুলো জটিল থেকে জটিলতর। এসব ঠিক তুড়ি মেরে বদলানোর ব্যাপার না!” মানুষের বিচিত্র সব সমস্যার দায় মানুষের একা নয়, এ বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রকৃতিও এর জন্য দায়বদ্ধ। তাই বেলা তারীয় চলচ্চিত্র নৈতিকতার চেয়ে দার্শনিকতায় বেশি আগ্রহী।
২০০৮ সালে তুরিন হর্স-এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ছয় দিনের গল্প কাঠামোর জন্য ৩৫ দিনের দৃশ্যধারণ কর্মসূচি [শুটিং সিডিউল] ঠিক করা হয়। দৃশ্যধারণের জন্য হাঙ্গেরির প্রত্যন্ত গ্রামে অবকাঠামো তৈরি করা হয়। ঠিক প্রথাগত কোনো অস্থায়ী অবকাঠামো নয়, কাঠ এবং পাথর দিয়ে স্থায়ী ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়। কথা ছিল, সেবছর নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে দৃশ্যধারণ সম্পন্ন করা হবে। কিন্তু দৃশ্যধারণ করতে গিয়ে সব ঠিকঠাক থাকলেও দৃশ্যায়তনে [সেট] কাক্সিক্ষত প্রাকৃতিক পরিবেশ বিরাজ করছিল না। গল্পকাঠামোর দূর্যোগপূর্ণ ছয়দিনের দৃশ্যরূপ [ভিজুয়াল] নির্মাণের জন্য যে প্রাকৃতিক আবহাওয়া প্রয়োজন তা পাওয়া যাচ্ছিল না। পরবর্তীকালে যথাযথ পরিবেশে দৃশ্যধারণ শেষ করতে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময় নিতে হয়েছে। চলচ্চিত্রটি শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে মুক্তিলাভ করে।
বেলা তারীয় অন্যান্য বেশির ভাগ চলচ্চিত্রের মতো এটিও ‘সাদাকালো’ ফরম্যাটে নির্মিত। মাঝেমাঝে আমার কাছে মনে হয়, ‘সাদাকালো’ ফরম্যাট চলচ্চিত্রকে এক ধরনের শাশ্বত জীবন বাস্তবতার অবয়ব দেয়। যে শাশ্বত ‘জীবন’ এবং তার ‘মানুষ’ বেলা তারের প্রধান আরাধ্য বিষয়বস্তু। শত বছর আগে, ডি. ডব্লিউ. গ্রিফিথ যে গল্পময় ধ্রুপদী চলচ্চিত্র ধারার গোড়াপত্তন করেছিলেন, সময়ের ব্যবধানে যাদের হাত ধরে চলচ্চিত্র গল্পময়তা থেকে দার্শনিকতায় পূর্ণতা অর্জন করেছে, বেলা তার নিঃসন্দেহে তাদের একজন। বেলা তারীয় সাদাকালোতে আমি এমনই দার্শনিক অভিব্যক্তি খুঁজে পাই। যেখানে গল্পের চেয়ে চলচ্চিত্রের সূক্ষাতিসূক্ষ অনুষঙ্গসমূহ অভিব্যক্তি প্রকাশে অনেক বেশি অবদান রাখে।
বেলা তারীয় দৃশ্যধারণ, বিশেষ করে লম্বাদৈর্ঘ্যরে দৃশ্যধারণ [লংটেক শুটিং] আমাদেরকে অধিকতর বিশুদ্ধ বাস্তবতা অনুভব করার সুযোগ করে দেয়। তুরিন হর্স-এ লম্বাদৈর্ঘ্যরে [লংটেক] মাত্র ৩০টি দৃশ্য দিয়ে গোটা ১৪৬ মিনিটের চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। এসব দৃশ্যের গড় দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০০ সেকেন্ড বা পাঁচ মিনিট করে। এক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হয়েছে, একটা দৃশ্য যখন নিরবচ্ছিন্নভাবে লম্ব সময় ধরে ধারণ করা হয় তখন সে দৃশ্যের বাস্তবতাÑ সম্পাদনা করে জোড়া লাগানো বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি স্বভাবজাত এবং ঘনীভূত বাস্তবতা। এসব লম্বাদৈর্ঘ্যরে দৃশ্য [লংটেক শট] চলচ্চিত্রকে সময়গত শিল্প [টেম্পোরাল আর্ট] হিসেবে সুদৃঢ় অবস্থান দেয়। তুরিন হর্স নিয়ে আমার এ ক্ষুদ্রালাপ পাশ কাটিয়ে, এবার বেলা তারের মূল সাক্ষাৎকারে প্রবেশ করার পালা।
ইস্ট ইউরোপিয়ান ফিল্ম বুলেটিনের সম্পাদক এবং অন্যতম উদ্যোক্তা কন্সটান্টি কজমা ২০১১ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে বেলা তারের এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এ আলাপচারিতায় বেলা তারের চলচ্চিত্রদর্শন, নির্মাণশৈলী, চিত্রনাট্যতত্ত্ব, সম্পাদনাতত্ত্ব, চলচ্চিত্রভাবনা, সমালোচনা, দৃশ্যধারণ অভিজ্ঞতা, চলচ্চিত্রভাষা, অভিনয়শৈলী, শিল্পতত্ত্ব এবং হাঙ্গেরিয়ান চলচ্চিত্র নিয়ে স্বল্পপরিসর কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা উচ্চারিত হয়েছে। সে বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইইএফবি পত্রিকায় প্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারটি, এখানে ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষায় রূপান্তর করা হলো।
সাক্ষাৎকার
কন্সটান্টি কজমা : আপনার তুরিন হর্স চলচ্চিত্রের শুরুতে একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ১৮৮৯ সালে ফ্রেডরিখ নিৎসের সাথে ইতালিতে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা: নিৎসে একদিন কোথাও একটা যাওয়ার সময় পথিমধ্যে দেখলেন, একজন মেজাজ খারাপ ঘোড়াগাড়িচালক তার অনড় ঘোড়াকে নিষ্ঠুরভাবে চাবুক মারছে। এই পাষন্ডতা দেখে, নিৎসে মহোদয় নিজেকে ঘোড়া এবং চালকের মাঝে ঠেলে দিলেন। ঘটনাটি তাকে নিদারূণভাবে পীঁড়া দেয় এবং তিনি চিরতরে বাকরূদ্ধ হয়ে পড়েন। আমার জিজ্ঞাসা হচ্ছে, আপনি কোথাও নিৎসের ঘটনাটি দেখালেন না, অথচ এর বাচিক বর্ণনা শেষে চলচ্চিত্র আরম্ভ হয় ঘটনাটির পর থেকে, যেখানে নিৎসে নেই। তুরিন হর্স-এ আপনি আসলে কী দেখাতে চেয়েছেন? এর সাথে নিৎসের সম্পর্ক কী?
বেলা তার: খুব সহজ সম্পর্ক। এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমরা আসলে দেখতে চেয়েছিলাম ঐ ঘটনার পর ঘোড়াটির কি পরিণতি হয়েছিল! যদিও চলচ্চিত্রটিতে ফ্রেডরিখ নিৎসকে দেখানো হয়নি, তবে এর মূলে রয়েছেন নিৎসে মহোদয় এবং সেদিনের ঘটনার অন্তর্গত চেতনা।
কন্সটান্টি কজমা: আপনার আগেকার বেশির ভাগ চলচ্চিত্রই বর্তমানকে ঘিরে নির্মিত। এ চলচ্চিত্রটি অতীতাশ্রয়ী হয়ে নির্মাণের কারণ কী? এটা কি কোনো ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র?
বেলা তার: আমার অন্যসব চলচ্চিত্রের মতো এটিও সময়-নিরপেক্ষ। এ চলচ্চিত্রের সাথে ফ্রেডরিখ নিৎসের ১৮৮৯ সালের ঐ ঘটনার অন্তর্নিহিত যোগাযোগ আছে, তাই বলে এটা ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র নয়! এটা আমার কাজের ধরন। চলচ্চিত্রে আমি অযথা রদবদলের পক্ষপাতী নই, নতুবা এটি অতীতের জায়গায় বর্তমানের প্রেক্ষাপটেও নির্মিত হতে পারতো!
কন্সটান্টি কজমা: নিৎসের লেখায় নন্দনতত্ত্ব এবং শিল্পকলা সম্পর্কিত আলোচনা বরাবর গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি শিল্পকলাকে অভিব্যক্তি প্রকাশের অন্যতম নন্দনতাত্ত্বিক আঙ্গিক হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এবং শিল্পকলাকে নিছক তথ্য প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে নাকচ করেছেন। আপনি আপনার চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে শিল্প এবং তথ্যের এ ব্যাপারটি কীভাবে বিবেচনা করেন?
বেলা তার: আমার চলচ্চিত্রে তেমন তথ্য থাকে না। আমার চিত্রগ্রহণযন্ত্র [ক্যামেরা] পর্যবেক্ষকের মতো মুহূর্তের পারিপার্শ্বিকতা এবং জীবনের প্রতিক্রিয়া ধারণ করে। আমি দর্শকদের তথ্য দিতে চাই না, বাস্তবরূপ [ইমেজ] দেখাতে চাই। চিত্রগ্রহণযন্ত্রের একটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি আছে, যা দিয়ে আমরা শুধু বাস্তবতাই দেখাতে পারি। চলচ্চিত্র সাহ্যিত্যের মতো নয়। অক্ষিকাচের [লেন্স] সামনে যা আছে চলচ্চিত্র তা দেখাতে পারে। শিল্পকলা হিসেবে চলচ্চিত্রকে আলগা তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয় না।
কন্সটান্টি কজমা: কিন্তু, এখানে অক্ষিকাচের সামনে যা ঘটলো সেটা তো আপনার নির্ধারিত বানানো বাস্তবতা!
বেলা তার: হ্যাঁ। কারণ এটা প্রামাণ্যচিত্র নয়। আমরা এখানে এক ধরনের কাহিনীচিত্র নির্মাণ করেছি। এখানে অক্ষিকাচের সামনে একধরনের বানানো বাস্তবতা দেখালেও সেটা জীবনেরই প্রতিফলন। শিল্পকলা হিসেবে চলচ্চিত্রের এই অভিব্যক্তি বাস্তবরূপ-নির্ভর, তথ্য-নির্ভর নয়।
কন্সটান্টি কজমা: আপনার লেন্সের সামনে যা যা ঘটেছে তার কতটুকু আপনার নিয়ন্ত্রণে ছিল? ফ্রেডরিখ নিৎসে চরমভাবে বিশ্বাস করতেন, শিল্পকলা হচ্ছে শিল্পীর পুরাদস্তুর নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বাঙ্গীণ আকস্মিকতার সংমিশ্রণ। আপনার চলচ্চিত্রে আকস্মিকতার স্থান কতটুকু?
বেলা তার: আমার চলচ্চিত্রে আকস্মিকতার স্থান নাই। আমি চাই না আকস্মিকভাবে কিছু ঘটুক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি আমার চলচ্চিত্রের শুরু থেকে শেষ অব্দি জানি। চোখ বন্ধ করে চলচ্চিত্রটি দেখতে পাই। আমি আমার চিত্রনাট্য জানি, চলচ্চিত্রের পরিপার্শ্ব এবং চরিত্রদেরকে চিনি। তবে হ্যাঁ, চরিত্রের স্বাভাবিকতা এবং অভিনয়ের স্বতঃস্ফূর্ততার জন্য আমি অভিনয় শিল্পীদের যতটা সম্ভব কম নিয়ন্ত্রণ করি, তাদেরকে সুযোগ দেই। আমি আমার চিত্রগ্রহণযন্ত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে খুবই কঠোর।
কন্সটান্টি কজমা: আপনি যা চাইছেন তা যদি আগে থেকেই আপনার জানা থাকে, তাহলে আপনার চিত্রসম্পাদক [এডিটর] কী কাজ করেন?
বেলা তার: এই চলচ্চিত্রে আমার চিত্রসম্পাদকের আহামরি তেমন কাজ ছিল না, তবে এটুকু বলতে পারি, তিনি দৃশ্যধারণের সময় আমাদের সঙ্গে উপস্থিত থাকতেন। এতে করে এ চলচ্চিত্রের মেজাজ তিনি সম্পাদনা-ঘরে বসবার আগেই আত্মস্থ করতে পেরেছেন।
কন্সটান্টি কজমা: চিত্রনাট্যের ব্যাপারে কী বলবেন? লাজলো ক্রাজনাহরকাই আবারও আপনার সাথে কাজ করলেন, ইতিমধ্যে আপনারা অনেকগুলো চিত্রনাট্য একসাথে করেছেন। চলচ্চিত্রের দৃশ্যরূপ নির্ধারণে তিনি কি আপনার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন?
বেলা তার: না। লাজলো ক্রাজনাহরকাইকে চিত্রনাট্যের সাহিত্যিক বলা চলে। তিনি শুধু এর সাহিত্য ও সংলাপগত দিকগুলো দেখভাল করেন এবং আমি দৃশ্যরূপ নির্ধারণের কাজ করি। তুরিন হর্স-এর ক্ষেত্রে তিনি যা লিখেছেন, আমি সেটাকে চলচ্চিত্রিক ভাষায় রূপান্তর করে দৃশ্যরূপ দিয়েছি। এখানে চলচ্চিত্রিক ভাষাটা আমার। তার লেখনী আমাকে আবেগগতভাবে পথ দেখিয়েছে, কাক্সিক্ষত দৃশ্যরূপ খুঁজে পেতে সহায়তা করেছে।
কন্সটান্টি কজমা: তুরিন হর্স-এর চলচ্চিন্তা [আইডিয়া] কীভাবে এলো?
বেলা তার: সাধারণত কোনো চিত্রনাট্য লেখার আগে আমরা দু’জন বসি। কোনো একটা চলচ্চিন্তাকে ঘিরে কথা বলতে থাকি, ক্রাজনাহরকাই সেগুলো টুকে রাখেন এবং একটা সময় পর চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন। কিন্তু তুরিন হর্স-এর ক্ষেত্রে ঠিক চিত্রনাট্য নয়, তিনি একটা গদ্যগল্প বা উপন্যাস লিখেছেন!
কন্সটান্টি কজমা: এর চলচ্চিন্তা কখন জন্ম হলো?
বেলা তার: নিৎসের সেই ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর, ক্রাজনাহরকাই একদা একটি ছোট্ট গল্প লিখেছিলেন। এরপর ঘোড়াটির পরিণতি কী হয়েছিল? এমন একটা প্রশ্ন দিয়ে তিনি গল্পটি শেষ করেছিলেন। আমাদের চলচ্চিন্তা শুরু হয়েছিল ঐ প্রশ্নটি থেকে। আমাদের গোটা কাহিনি চলচ্চিত্রটি, সেই প্রশ্নের এক ধরনের উত্তর!
কন্সটান্টি কজমা: শুনেছি, এর মুক্তির তারিখ নাকি বারবার পরিবর্তন হয়েছে। এর পেছনে কি কোনো গুরুতর কারণ ছিল?
বেলা তার: হ্যাঁ। যেখানটায় চলচ্চিত্রের দৃশ্যধারণ করা হচ্ছিল, সেখানকার আবহাওয়া আমাদের প্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে ছিল না। আপনি জেনে থাকবেন, এটি একটি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাময় লাগাতার ছয়দিনের গল্পকাঠামো। কিন্তু গল্পের পরিস্থিতির অনুরূপ– দৃশ্যধারণ চলাকালীন একই রকম প্রাকৃতিক আবহাওয়া আমাদের দৃশ্যায়তনে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই কাঙ্ক্ষিত আবহাওয়ার অভাবে, আমাদেরকে অনেকবার দৃশ্যধারণ পেছাতে হয়েছে।
কন্সটান্টি কজমা: এসব সমস্যার কারণে, গল্পে কোনো পরিবর্তন আনা হয়েছিল কি?
বেলা তার: না, এগুলো একদমই ব্যবহারিক বাধা ছিল। এসব বাধা আমাদের গল্প বা আমার চলচ্চিন্তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। যে ধরনের দৃশ্যরূপ ভেবেছি, তার দৃশ্যধারণ করতে সময় নিয়েছি, তবুও গল্প পরিবর্তন করি নাই।
কন্সটান্টি কজমা: অপেশাদার অভিনয় শিল্পী নিয়ে কাজ করানোর ব্যাপারে আপনার বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। এই চলচ্চিত্রে কাক্সিক্ষত অভিনয় আদায়ের ক্ষেত্রে আপনি কি ধরনের পন্থা অবলম্বন করেছেন?
বেলা তার: এখানে আমার অভিনেতা-অভিনেত্রীগণ অভিনয় করেননি একদমই। আমি তাদেরকে অভিনয় না করে, চিত্রনাট্যে বর্ণিত কাজগুলো করতে বলেছি। একটা যথাযথ পরিপার্শ্ব তৈরি করে দিয়ে, আমি তাদেরকে একটা সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অবতীর্ণ করেছি। যে কারণে একজন বিশ্ববিখ্যাত অভিনেতা এবং একজন অপেশাদার সাধারণ নারী শ্রমিক একটা অভিন্ন পরিস্থিতিতে একই রকম আচরণ করেছেন। একই রকমভাবে কথা বলেছেন। এখানে এমন একটা বাস্তবিক পরিবেশে তৈরি করতে পেরেছিলাম, তারা একে অপরের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছেন। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাদেরকে অভিনয় না করতে সহায়তা করেছে।
কন্সটান্টি কজমা: একদা কোন এক জায়গায় বলেছিলেন, আপনি চান না দর্শক আপনার চলচ্চিত্র দেখার সময় অযথা সাতপাঁচ ভাবুক। চলচ্চিত্র সমালোচনার ক্ষেত্রেও কি একই ধরনের ইচ্ছা পোষণ করেন?
বেলা তার: আলোচনা-সমালোচনা জন্ম দেয়া আমার কাজ না। এটা ঠিক, কারও কাছে আমার চলচ্চিত্র ভালো লাগলে আমি খুশি হই, আবার কেউ অপছন্দ করলেও তাতে কিছু মনে করি না। এমন কি আমি সমালোচকদের প্রভাবিত করতে চাই না। আমি মনে করি, চলচ্চিত্র শেষে প্রক্ষেপণযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেলে আমার দায়িত্বও শেষ হয়ে যায়। চলচ্চিত্রটি কে কিভাবে নিবে, সেটা লোকের ব্যাপার!
কন্সটান্টি কজমা: চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে আপনি মূলত কী দেখাতে চান?
বেলা তার: আমি মূলত মানুষ দেখাতে চাই। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আসলে অনেক কিছু করার সুযোগ আছে, কিন্তু প্রথা এবং সমাজের চাপে আমরা সেগুলো করে উঠতে পারি না। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের মর্যাদা আছে এবং আছে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, আমার চলচ্চিত্রে ঘুরে ফিরে আমি এ কথাটুকইু বলতে চাই। বৈষম্যের দুনিয়ায় আমি মানুষকে মনে করিয়ে দিতে চাই, আমরা সবাই সমান মানুষ। যেহেতু আমি নিজে অন্যদের মতো একজন মানুষ, সেহেতু আমি কাউকে পর্যবেক্ষণের তাগাদা অনুভব করি না। চলচ্চিত্রে আমি ‘শাশ্বত মানুষ’ দেখাতে চাই।
কন্সটান্টি কজমা: প্রচলিত চলচ্চিত্রিক ভাষা ব্যবহারে আপনি বরাবরই আপত্তি দেখিয়েছেন। মূলধারার চলচ্চিত্রের সঙ্গে আপনার সমস্যা কী?
বেলা তার: এসব চলচ্চিত্র সব একই ধাঁচের হয় অ্যাকশন, কাট এবং অ্যাকশন, কাট! তারা শুধু মানুষের অ্যাকশন-কাট দিয়ে গল্প বলে যায়, কিন্তু অন্যভাবেও তো গল্প বলা যায়। যেমন ধরুন, একটা মানুষ কোথাও একটা বসে বসে অপেক্ষা করছে। কিচ্ছু না, মানুষটাকে অনড়ভাবে অনুসরণ করা যেতে পারে। এভাবে বাস্তবতার ভিতর থেকে হাজার রকমভাবে গল্পটা বলা যেতে পারে, কিন্তু মুলধারার নির্মাতারা বাস্তবিক জীবনকে অনুসরণ করতে বিরক্ত বোধ করেন। আমি সবসময়, চলচ্চিত্রের চেয়েও জীবনের কাছাকাছি কিছু একটা করে দেখাতে চাই।
কন্সটান্টি কজমা: আপনার কি হাঙ্গেরিয়ান চলচ্চিত্র বানান?
বেলা তার: আমি নিজেকে একজন গর্বিত হাঙ্গেরিয়ান মনে করি। নিজের দেশের জন্য কিছু করতে পারলে আমার ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু নিজেকে কখনও হাঙ্গেরিয়ান চলচ্চিত্রের মূল ধারার একজন হিসেবে ভাবি না। মূলধারার হাঙ্গেরিয়ান চলচ্চিত্রের চেয়ে আমার চলচ্চিত্র অনেক আলাদা। তবে আমি হাঙ্গেরিয়ান চলচ্চিত্র বানাই।
কন্সটান্টি কজমা: হাঙ্গেরিয়ান চলচ্চিত্রের বর্তমান অনুদান প্রথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আপনি একটা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। ব্যাপারটি একটু খুলে বলবেন?
বেলা তার: চলচ্চিত্রের অনুদান ব্যবস্থাপনাকে হাঙ্গেরিয়ান সরকার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। হাঙ্গেরিতে সরকার অনুমোদিত চলচ্চিত্র সমিতি থাকার পরেও, সরকার এই অনুদান ব্যবস্থাপনাকে আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতে আবদ্ধ করে ফেলেছে। অনেক আগ থেকে, অনুদান ব্যবস্থাপনার কাজ চলচ্চিত্র সমিতি কর্তৃপক্ষ যথাযথ গণতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালনা করে আসছিল। হাঙ্গেরিয়ান সরকার এখন হুট করে স্বেচ্ছাচারি আচরণ শুরু করেছে। আরও বেশ কিছু বিষয়ে আমরা হাঙ্গেরিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতাগণ উদ্বেগ বোধ করছি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রণয়ন করা গণমাধ্যম আইন, হাঙ্গেরিয়ান সাংস্কৃতিক চর্চাকে এক ধরনের বদছায়ায় আবিষ্ট করে রেখেছে। সব কিছু মিলিয়ে আমরা খুব চিন্তিত!
কন্সটান্টি কজমা: সবশেষে জানতে চাই, তুরিন হর্স-এর পর কী ঘটতে যাচ্ছে?
বেলা তার: এটি আমার জীবনের এক বিশেষ চলচ্চিত্র। আমি প্রায় চার দশক ধরে কাজ করে আসছি। আমি মনে করি, তুরিন হর্স-এ আমার দীর্ঘ চলচ্চিত্র সাধনা কাক্সিক্ষত নির্বাণ লাভ করেছে। এর দ্বারা আমার কার্যবৃত্ত সম্পূর্ণ হলো।