Skip to content

২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | মঙ্গলবার | ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘সাহিত্যে নারীর আবেগকে আমি গুণ হিসেবে দেখি।’

আপনার লেখালেখির শুরুটা কবে থেকে?

 

আমার লেখালেখি ছিল দুই ধরনের। যেমন, ছাত্রজীবনে আমি সৃজনশীল লেখা লিখতামÑ কবিতা, গল্প ও উপন্যাস লিখেছি। যদিও সেগুলো বই-আকারে বের হয়নি। খাতায় লিখতাম, বেশিরভাগ লেখা মুক্তিযুদ্ধের সময় হারিয়ে গেছে।

 

প্রবন্ধ লেখালেখিতে আগ্রহ হল কিভাবে?

 

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরপরই নাটক লিখতে শুরু করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের অধীনে চৌদ্দটা হলে নাটকের প্রতিযোগিতা হয়েছিল, আমি তাতে অংশ নিই। সেলিম আল দ্বীনের নাটকটি প্রথম, আল মনসুরের দ্বিতীয় আর আমারটি তৃতীয় হয়। সেই নাটকে আমি অভিনয়ও করি। সিরিয়াস সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ লেখার শুরুটা তখনই।

 

‘বিষ্ণু দে-র কবিমানস ও কাব্য’ শীর্ষক গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলাদেশে আমার জানা মতে বিষ্ণু দে-কে নিয়ে আপনার কাজটাই বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বশীল। এরপর আপনি ত্রিশের অন্যান্য প্রধান কবিদের নিয়েও কাজ করেছেন। এটা কি আপনার ভালোলাগা থেকে?

 

ত্রিশের দশকের কবিদের কবিতা আমি খুব করে পড়তাম। জীবনানন্দ দাশ আমার প্রিয় কবি। রবীন্দ্রনাথ যদি হন আমার প্রাণপুরুষ, জীবনানন্দ আমার হৃদয়পুরুষ। যখন আমি একাকী মুহূর্তে থাকি, তখন আমার সঙ্গী হোন জীবনানন্দ।

 

বিষ্ণু দেও নিশ্চয় আপনার খুব প্রিয় কবি? অন্তত তাঁর ওপর আপনার কাজের পরিধি দেখে সেটিই অনুমেয়।

 

খুব বেশি প্রিয় না। তাঁর ওপর আমি কাজ করতে বাধ্য হয়েছি, কারণ আমার শিক্ষক বিষয়টা দিয়েছেন। উনি বললেন, তুমি যেহেতু কঠিন বিষয় নিয়ে লেখো, বিষ্ণু দে দুর্বোধ্য কবি, তাঁর কবিতা নিয়ে কাজ করো। এরপর কাজের সূত্র ধরে বিষ্ণু দের সঙ্গে আমার যোগাযোগও হয়। তাঁর চিঠি আছে আমার কাছে।

 

সাক্ষাৎ হয়েছিল কি?

আমি একবার কলকাতায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। ঘরময় কেবল পুতুল আর পেয়ন্টিংস। নিজের আঁকা সত্তরটা ছবি আছে তাঁর। আর ছিল গানের রেকর্ডস। তিনি এগুলো না শুনলে কবিতা লিখতে পারতেন না। ছবির আঙ্গিক ও গানের আঙ্গিক মিশিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন।

 

আপনার প্রবন্ধে নিজস্ব একটা সৃজনী আছে, যে কারণে সমসাময়িক প্রাবন্ধিকদের মধ্যে আপনাকে সহজেই আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। আপনি ক্লাসিক গদ্যঢঙে প্রতিটা প্রবন্ধের বিষয়বস্তু বিশ্বসাহিত্যের আলোকে পর্যবেক্ষণ করেন। পাশাপাশি সাহিত্যতত্ত্ব ও নন্দনতত্ত্বের দিকটিও উঠে আসে। এই স্ট্যাইলটা আপনি কিভাবে পেলেন?

 

যখন আমি পশ্চিমা সাহিত্যতত্ত্বগুলো পড়তাম, তখন আমার মনে হত, ওরা তো আমাদের সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে ভাবছে না! কিন্তু আমরা যখন আলোচনা করি তখন আমরা ওদের সাহিত্যত্ত্বগুলো নিয়ে ভাবছি। সে জন্যে আমাদের সাহিত্যতত্ত্বগুলো আরোপ করার সময় আমি ওদের যে তত্ত্বগুলো আমাদের জন্যে প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে, সেগুলো আমি ব্যবহার করেছি। সাহিত্যের বাইরে আমার প্রিয় বিষয় হল জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থ বিজ্ঞান। এছাড়া দর্শন, বিজ্ঞান, অর্থনীতি এসব পাঠ থেকে সাহিত্য বিশ্লেষণে আমার নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়ে থাকবে। আমি মনে করি সাহিত্য জীবনের পূর্ণাঙ্গ জিনিসকে ধরে। কাজেই সামগ্রিক দিক টেনে সাহিত্যকে বিশ্লেষণ করতে হবে।

 

আর একটা আমার আপত্তি আছে। তুমিই কেবল বলোনি। সকলেই প্রায় আমাকে বলেন। আমার লেখা পড়লে বোঝা যায় না, এটা কোনো নারীর লেখা। তখন আমি আপত্তি করে বলি, পুরুষের লেখা নারীর লেখা বলে আলাদা কিছু নেই। সবকিছুই লেখকের লেখা।

 

‘সাহিত্যে নারীর আবেগকে আমি গুণ হিসেবে দেখি।’

 

আপনার এই কথা ধরেই একটা প্রশ্ন তবে করি। সম্প্রতি নোবেলজয়ী লেখক ভিএস নাইপল ঢাকা ঘুরে গেলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একটি প্যারা পড়েই বলে দিতে পারি, লেখক নারী না পুরুষ। কারণ নারীরা ভীষণ আবেগী হন। বিশ্ব সম্পর্কে তাদের ধারণা খুবই সংকীর্ণ। নিশ্চিত করেই নারীরা তার গৃহের একক কর্তা নন, এই বিষয়টা তাদের লেখালেখিতে প্রভাব ফেলে থাকতে পারে।’ আপনি তবে এক্ষেত্রে কি মনে করেন?

তাঁর সঙ্গে আমি একমত নই। একমত নই এই কারণে যে, আবেগ কোনো ফেলনা জিনিস নয়। আবেগকে আমি গুণ হিসেবে দেখি। নারীর পরিসর যেহেতু ছোট করে রাখা হয়েছে, তাই তাদের অভিজ্ঞতা প্রসার লাভ করেনি। পুরুষরা নানা কথা বলে নারীদের সৃজনশীল কাজ থেকে দূরে রেখেছে। একটা সময় তো নারীদের পুরুষের নাম নিয়ে লিখতে হত। বর্তমানে দাঁড়িয়ে আমি নারীর লেখা, পুরুষের লেখা এইসব বিভেদ করতে চাই না।

 

দৃষ্টিভঙ্গি বদলেও তো ভাবা যায় কেউ যদি আবেগটাকেই লেখার সম্পদ মনে করেন। এবং পুরুষের লেখায় আবেগের ঘাটতি থাকার কারণে দুর্বল বলে চিহ্নিত করেন, তাহলে তো তাকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারবো না।

 

সাহিত্যে কমবেশি আবেগ থাকবেই। পুরুষরা বহির্জগতে সভ্যতার আদি থেকে বিচরণ করছে, ওদের মেরুদণ্ড সেইভাবে বিকশিত। আর নারীরা যেহেতু সৃষ্টি করছে, সন্তানের জন্ম দিচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে তাদের প্রাণের আবেগ কাজ করছে। নারীদের কোষগুলোও সেইভাবে বিকশিত হয়েছে। এখন যে উত্তরাধুনিক সাহিত্যতত্ত্ব এসেছে, এখানে বলা হচ্ছে, যুক্তি হল একটা দ্বীপের মতো আর আবেগ হল একটা সমুদ্র্রের মতো। মর্ডানিজম যে যুক্তি এনেছে সেটা তো এখন মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে। যুক্তি দিয়ে মানুষ যুদ্ধ বাধাচ্ছে। কাজেই যুক্তির ব্যর্থতা এখন আমাদের সামনে উঠে এসেছে। নারীরা যে ডোমেস্টিক বিষয়ে লেখেন, তারও একটা গুরুত্ব আছে। এটা কেবল আবেগময় লেখা নয়, তারও একটা অভিজ্ঞতার লেখা। এই অভিজ্ঞতা বাদ দিয়ে সমাজ নয়।

 

নারী সাহিত্যিকদের প্রতি পুরুষ পাঠক বা সমালোচকদের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে আঙুল তুলে কানাডীয় নারীবাদী কথাসাহিত্যিক মার্গারেট অ্যাটউড বলেছেন, ‘কোনো নারী লেখক বদমেজাজী বা বাজে স্বভাবের পুরুষ চরিত্র দাড় করালে তাকে পুরুষবিদ্বেষী হিসেবে আখ্যায়িত করা হতে পারে। পুরুষের আত্মমর্যাদায় তখন বাধে। আবার নারী লেখক যদি আদর্শ কোনো পুরুষ চরিত্রের কথা তুলে ধরেন, অন্য পুরুষরা তাকে ‘দুর্বল’ বলে চিহ্নিত করে থাকেন।’ আপনি কি তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারছেন?

 

কিছুটা তো বটেই। নারী লেখকদের নানবিধ সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। নারী লেখকরা যদি নারীচরিত্রকে বদমেজাজি বা পুরুষসুলভ করে উপস্থাপন করে, তাতেও নেতিবাচক সমালোচনা হয়।

 

বাংলাদেশে তো বটেই, গোটা বাংলা সাহিত্যেই নারী লেখকরা তুলনামূলকভাবে কথাসাহিত্যে এগিয়ে। কবিতা ও প্রবন্ধসাহিত্যে বেশ পিছিয়েÑএর কারণ কি হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

 

এটা ইউরোপেও ঘটেছে। এর কারণ নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। কবিতা সুবিধা মতো সময় বের করে লেখা যায় না। এটা লেখার জন্য একটা আবেগ বা ভেতর থেকে সায় প্রয়োজন হয়। আমার কবিতা লিখতে ইচ্ছে হল আর তখন পরিবারে কারো জন্যে ভাত রান্না করতে হচ্ছে। কিন্তু উপন্যাসের ক্ষেত্রে সুবিধা মতো সময় বের করে লেখা যায়। এটা একটা কারণ হতে পারে। নিবিড় মনোযোগ ও অনুধ্যানের বিষয় কবিতা, সংসারে নারীরা সেই সময় পান না। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, নারীরা নিজের কথাটি আত্মপ্রকাশ করতে পারে না। কোনো পুরুষকে ভালো লাগলে মুখে বলা যায় না। যৌনতার কথা তো নারীরা মুখেই আনতে পারবেন না। কবিতা তো সত্য কথা দাবি করে। আর কবিতায় কবির পারসনা কথা বলে। তাই নারীদের অন্য চরিত্র নির্মাণ করে নিজের কথাগুলো বলার জন্যে কথাসাহিত্যে যেতে হয়। আর প্রবন্ধ খুব সংগ্রামের কাজ। অনেক পরিশ্রম করতে হয়। অনেক নারী লেখকের প্রবন্ধ লেখার দক্ষতা থাকলেও সংসার-চাকরি সামলে সময় করে উঠতে পারেন না।

 

‘সাহিত্যে নারীর আবেগকে আমি গুণ হিসেবে দেখি।’

বিশ্বসাহিত্যে নারীকে তো দেখা হয়েছে, নির্মাণ করা হয়েছে, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। এটা কতটা অথেনটিক বা নির্ভরযোগ্য?

 

এটা অথেনটিক এই কারণে যে, পুরুষরা যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নারীচরিত্র নির্মাণ করছেন, নারীরা সেটা পাঠ করে তেমনই হতে চান। আমি ছোটবেলায় শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত পড়ে রাজলক্ষী হতে চেয়েছি। আর নারী নিজে কি সেটা আবিষ্কারের পালাটা তৈরি হয়েছে রবীন্দ্রনাথে এসে। যখন রবীন্দ্রনাথের কুমুদিনী বলছেন, নারীর এমন কিছু আছে যা সন্তানের জন্যও হারানো যায় না, এই সত্য উচ্চারণ তো একজন পুরুষ লেখকের কাছ থেকে এসেছে। ইবসেনের ডলস হাউসের সেই নোরা তো পৃথিবীর অবদমিত নারীদের সামনে আদর্শিক নারী চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘নারী’ প্রবন্ধে বলেছেন যে, আগামী শতাব্দি হবে নারীদের। বিশ্বের কর্মক্ষেত্রে তাদের ডাক পড়বে, তারা যেন সে ডাক অবহেলা না করে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, সে কর্মক্ষেত্রে আসার আগে নারী যেন হাজার বছরের যে কুসংস্কার তার মনের মধ্যে আছে, সেগুলো ফেলে দিয়ে আসে। আমি কিন্তু সেই ফেলে দিয়েই এ পর্যায়ে এসেছি। যেমন, আমার দুটি কন্যা সন্তান আছে। কোনো ছেলে সন্তান নেই বলে অনেকেই বলেন, আপনার খারাপ লাগে না? আমি তাদের দৃঢ়ভাবে বলি, আমি আনন্দিত যে আমার দুটি মেয়ে সন্তান আছে। আমার এই জীবনদৃষ্টি থেকেই আমি লিখি।

 

আধুনিক বাংলা কবিতায় মিথ ও মিথতত্ত্ব এবং প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতার নন্দনতত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছেন। এক্ষেত্রে আপনার নিজস্ব কোনো ভিউপয়েন্ট ছিল কিনা?

 

আমার সব সময় লক্ষ্য থাকে এতদিন যা বলা হয়েছে, তার বাইরে কিছু বলার। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই কাজটি করা। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের কবিতায় আমি সমাজ পরিপ্রেক্ষিতে এবং মানস পরিপ্রেক্ষিতে নান্দনিক দিকটা বের করে আনতে চেয়েছি। আর মিথের আগ্রহটা আমার বরাবরই ছিল। এমএ থিসিস করার সময় আমি বিশ্বের বহুদেশের পুরাণ পড়ে ফেলি। বিশ্বপুরাণের একটা বেসিক ধারণা সেই পাঠ থেকে তৈরি হয়। আর আমার লেখায় পুরাণ-প্রসঙ্গ আসে কারণ আমাদের জীবনের সঙ্গে এর একটা গভীর সম্পর্ক আছে। মিথ হল একটা অভিজ্ঞান। মিথের আলোয় আমরা সত্যকে উপলব্ধি করি। যত মিথ পড়া যাবে তত অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞানে, চিন্তায় জীবন ভরে উঠবে। মানুষের কল্পনা তখন অনেক বিচিত্র আর বড় ছিল। এখন মানুষের কল্পনার ক্ষেত্রটা ছোট হয়ে এসেছে।

 

ইংরেজি সাহিত্য তো বটেই বিশ্বসাহিত্যে মিথের যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, বিনির্মাণ করা হয়েছে সেভাবে বাংলাদেশের সাহিত্যে মিথ নিয়ে কাজ করা হয়নি। এটা আমাদের সাহিত্যের অপূর্ণতা কিনা?

 

মিথ অবশ্যই সাহিত্যের প্রিয় বিষয়। কবিতার ভালো উপাদানও। শামসুর রাহমানসহ আমাদের প্রধান কবিদের কবিতায় মিথ আছে। তবে বর্তমানে কবিরা মিথ নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তারা আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছেন, কিন্তু ক্ল্যাসিক ঐতিহ্য নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

 

এর একটা কারণ হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের প্রজন্মের লেখকদের ভেতর বাংলাদেশের মিথ নিয়ে একটা কনফিউশন তৈরি হয়েছে। যে সমস্যাটা কলকাতার ক্ষেত্রে হয়নি। ভারতবর্ষের মিথটা হয়ে গেছে হিন্দুধর্মের মিথ। ফলে সচেতনভাবে অনেক বাঙালি মুসলমান কবি এটা পরিহার করছেন। আবার মুসলমানদের যে মিথ সেটাকে মিথ হিসেবে অ্যাড্রেস করলে সমস্যা হতে পারে ভেবে কেউ তা করছেন না। এই সমস্যা থেকেই হয়ত আমাদের কবিরা মিথ নিয়ে কাজ করছেন না। যতটুকু করছেন তাও গ্রিক মিথ নিয়ে। গ্রিক মিথ নিয়ে কাজ করলে ধর্মীয় সেনসিবিলিটি কাজ করছে না।

 

এটা তুমি ঠিক বলেছো। হিন্দু ধর্মে মিথটাই ধর্ম। কিন্তু ইসলামের যে ঐতিহ্য বা লেজেন্ড সেটা অবিশ্বাস কিংবা বিনির্মাণের সুযোগ নেই। এটার কারণে হয়ত মুসলমান কবিদের ভেতর মিথ নিয়ে কাজ করার প্রবণতা কমে আসছে। মুসলমান কবিদের আরো অনেক ক্রাইসিসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

 

কবির উপন্যাস নিয়েও আপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বই আছে। রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এঁদের বাইরেও বাংলা সাহিত্যে প্রায় সব কবিই কমবেশি কথাসাহিত্য রচনা করেছেন। আপনার পঠনপাঠনে কথাসাহিত্যে কবির শক্তি এবং দুর্বলতা কিভাবে ধরা পড়েছে?

 

শক্তি হলো চরিত্রের অভ্যন্তরে আবেগ দিয়ে প্রবেশ করার ক্ষমতা। কবিদের উপন্যাস খুব কাব্যময় হয়। কথাসাহিত্যে কাব্যময়তাকে কারো কারো কাছে দোষের মনে হলেও, আমি গুণ হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। আর দোষনীয় হল, কবিদের অভিজ্ঞতার পরিসীমা কম। তাদের উপন্যাসে বিস্মৃত সমাজ আসছে না। মানিক-তারাশঙ্কর-মহাশ্বেতা দেবীর মতো কথাসাহিত্যিকদের উপন্যাসের মতো বিস্মৃত ক্যানভাস জীবনানন্দ দাস, বুদ্ধদেব বসুর মতো কবিদের উপন্যাসে মেলে না।

 

 

আপনার বিভিন্ন প্রবন্ধে উত্তর উপনিবেশিক সাহিত্যতত্ত্বের কথা এসেছে। আমি একটা বিষয় জানতে চাই, দুশো বছর ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিলাম আমরা। কিন্তু যেভাবে আফ্রিকার সাহিত্যে কিংবা ভারতের সাহিত্যে কলোনিয়াল ইম্প্যাক্ট নিয়ে উপন্যাস লেখা হয়েছে,  আমাদের সাহিত্যে সেভাবে হয়নি। এর কারণ কি থাকতে পারে?

 

এটার কারণ হতে পারে ইতিহাসের ব্যাপক ক্যানভাস ধরে কাজ করার মতো করে আমাদের লেখকরা নিজেদের তৈরি করতে পারেননি। আমাদের লেখকদের ইতিহাস চেতনার জায়গা থেকে অনেক বড় বড় কাজ করার সুযোগ থেকে গেছে। কেবল ব্রিটিশ উপনিবেশ নয়, মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও এখনো কোনো মহাকাব্যিক উপন্যাস লেখা হয়নি, যেটা পড়ে আমরা টোটাল মুক্তিযুদ্ধটাকে পাবো। সামগ্রিক ইতিহাসটা আসবে।

 

আমার যেটা মনে হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারতের জন্য নতুন করে কোনো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যাকে হিস্ট্রি অব দ্য মোমেন্টস বলি, তৈরি হয়নি। যে কারণে একজন ভারতীয় লেখক ইতিহাসের দিকে পিছন ফিরে তাকালে প্রথমেই দেশভাগ এবং বৃটিশ উপনিবেশটা চোখে পড়ে। কিন্তু সমসাময়িক একজন বাংলাদেশি লেখক পিছন ফিরে তাকালেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধটা দেখতে পান, এরপর ১৯৪৭ দেশে একটা জাতীর স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস সামনে চলে আসে। যে কারণে আমাদের লেখকরা এই সময়টা নিয়ে লিখতে বেশি অনুপ্রেরণা বোধ করায় ব্রিটিশ কলোনিয়াল গ্রেটার ভারতের কথা আর লেখার সুযোগ করে উঠতে পারেন না। সাম্প্রতিক ইতিহাসটা মনের ভেতর এখনো দগদগে ক্ষত সৃষ্টি করে রাখায় আমরা ভারতবর্ষের ইতিহাস একটা নৈর্ব্যক্তিক জায়গা থেকে এখনো দেখতে পারছি না।

 

এটা তুমি ঠিক বলেছো। এখন পর্যন্ত আমরা আমাদের ইতিহাস বলতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-কেই বুঝি। যে কারণে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সেই সময়ের যখন আমাদের ইতিহাসটা গোটা ইতিহাসের সঙ্গে মিশে যাবে। তখনই হয়ত আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও বড়ধরনের সাহিত্যসৃষ্টি পাবো।

 

আপনার সাহিত্যভাবনা উত্তর-আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বও এসেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উত্তর-আধুনিকা কতটা প্রাসঙ্গিক?

 

পাশ্চাত্যের উত্তর-আধুনিকতা এসেছে আধুনিকতার পর্যায়কে পার করে। আধুনিকতার বিকাশ শেষ হয়ে যে নয়া সংকটের সৃষ্টি হয়েছে ইউরোপে, সেটি এখানে হয়নি। আমাদের এখানে তো বুর্জোয়া এলিট শ্রেণি এখনো তৈরি হয়নি। তাই এখানে সাহিত্যে যে উত্তর-আধুনিকতা এসেছে সেটা জীবনাচরণ, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে আসেনি, এসেছে পাঠের ভেতর দিয়ে।
 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ