শিল্পের খনন: লেখকের দায়
যে লেখক বক্তব্য আড়াল করেন না বা সোজাসুজি বিষয়ে প্রবেশ করে সমস্যা তুলে ধরে বিশ্লেষণ করেন তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন নেই। অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক কিংবা বিজ্ঞানমনস্ক লেখক সরাসরি নিজের বিষয়ের কথা বলেন। তবুও লেখকের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বারবার। কেননা, যাঁদের নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তাঁরা সৃজনশীল। তাঁদের জগৎ ভিন্ন, প্রকাশ ভিন্ন, আঙ্গিক ভিন্ন। তিনি মেধা এবং মননের সমন্বয়ে গড়েন শিল্পিত ভুবন। তাঁর সৃষ্টিশীল অনুভব মানুষের গভীর এবং সূক্ষ্মতম অন্তরকোণ স্পর্শ করে। তাকে হাসিয়ে, কাঁদিয়ে অভিভূত করে ভিন্ন মানুষ করে ফেলে। এজন্যই সৃষ্টিশীল লেখকের দায়ভাগ অনেক। তাঁদেরকে সমাজ-সচেতন মানুষের জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে হয় নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে ‘কলম-পেষা মজুর’ বলেছিলেন। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হয় না। ‘মজুর’ শব্দ দিয়ে লেখকের প্রকাশ ঠিকমতো আসে না। মজুর বলতে আমরা যে ব্যক্তিটিকে বুঝি তার সঙ্গে একজন লেখকের ব্যবধান অনেক। সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং মানবিক দিকটি লেখকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। কলম-পেষা মজুর হয়েও তিনি সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন নাও করতে পারেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় খোয়া-ভাঙ্গা যে মজুরটির জীবন ব্যর্থ বলেছেন সে বলা অত্যন্ত আপেক্ষিক। কেননা ব্যর্থতার সংজ্ঞা প্রতিটি মানুষের কাছে ভিন্নভাবে প্রতিভাত। আমি ‘কলম-পেষা মজুর’ রাস্তার ধারের লোকটির জীবন-দর্শন না জেনেই তাকে ব্যর্থ বলি কিভাবে? ঐ ইট-ভাঙার মধ্যেই তার কাছে জীবনের কোনো অর্থ সত্য হতে পারে, ঐ ইট-ভাঙা তার কাছে শিল্পিত কারুকাজ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ঐ শব্দ তার কোনো গ্লানি ধুয়ে দিতে পারে, ভরিয়ে তুলতে পারে কোনো অপূর্ণ স্বপ্ন। তার ভাবনা একজন কলম-পেষা মজুরের জীবনদর্শনের সঙ্গে না মিললেই কি তাকে ব্যর্থ বলতে হবে? না এত সীমিত নয় জীবনের পরিসীমা, এত ক্ষুদ্র নয় বৃহত্তর জীবনযাত্রা। দিগন্ত-ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষাই মানুষের বড় অহংকার। কে জানে ঐ লোকটি মিছিলের প্রথম ব্যক্তি হবে কি না? কে জানি তিনি এমন একজন শহীদ হয়ে একটি দেশের স্বাধীনতাকে সক্রিয় করে তুলবেন কি না? কে জানে তার জন্য একটি বিশেষ দিবসের স্মৃতি-তর্পণ একটি জাতিকে গৌরবের শীর্ষে পৌঁছিয়ে দেবে কি না? ঠিক একইভাবে লেখকের জীবনও কোনো অর্থেই নিরর্থক নয়। যিনি বটতলার উপন্যাস রচনা করে লক্ষ পাঠকের মনোরঞ্জন করেন তারও মূল্য আছে। পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা এবং সুস্থ বিনোদনের ভিত যদি একজন লেখক গড়ে তুলতে পারেন সেটাই বা কম কি? সুতরাং নিরর্থক শব্দটি দ্ব্যর্থক। এক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুক্তি অচল। লেখক শুধু কলম-পেষা মজুর নন। শুধু পরিশ্রমে তাঁর ঘাটতি পোরে না, চাই মেধা এবং প্রজ্ঞার বাড়তি সুবাস।
চড়া গলায় মানবতার জয়গান গাইলেই কি লেখকের কলম-পেষা সার্থক হয়ে উঠবে? না কি অনাগতকালের পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করার জন্য তাঁকে আরো কিছু কারুকাজ যুক্ত করতে হবে যার ওপর নির্ভর করে রচনাটিকে বলা যায় কালোত্তীর্ণ? যেসব রচনা আবহমানকালের মানবজাতির সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়? যে কারণে তিনি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে হয়ে ওঠেন বিশ্বের? আনাতোল ফ্রাঁস গোর্কির সম্পর্কে বলেছিলেন, গোর্কি শুধু রাশিয়ার নন, গোর্কি সমগ্র পৃথিবীর। সুতরাং লেখকের কর্তব্য নিয়ে বাকবিতণ্ডা অনাবশ্যক। এ এমন এক দায়িত্ব যাকে নিয়মের নিগড়ে বাঁধা যায় না। এ হলো প্রমিথিউসের আগুন চুরি, যা অন্তর-প্রেরণা থেকে উৎসারিত। যে প্রজ্ঞা তাঁর সম্বল, তা দেশকাল মানে না, ইতরবিশেষ জ্ঞান করে না, তা ন্যায় এবং সত্যের পক্ষে লৌহকঠিন। যিনি এ দায়িত্ব পালনে অক্ষম, তাঁর ভূমিকা গৌণ। যিনি পারেন মহাকাল তাঁকে স্মরণ করে।
সঙ্গত কারণেই লেখকের এ বোধ স্বতঃ-উৎসারিত। এ বোধ আরোপিত নয়, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এ বোধ কারো স্কন্ধে চাপিয়ে দেওয়া যায় না।
বাংলা ভাষার উন্মেষ যুগে চর্যাপদের কবিরা, যতোই তান্ত্রিক সিদ্ধা হোন না কেন, সমসাময়িক কালকে উপেক্ষা করেননি। তাঁরা প্রতীকের মাধ্যমে ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণদের নিপীড়ন, অত্যাচারের কথা বলেছেন, নিজেদের দারিদ্র্য পীড়িত সমাজের কথা বলেছেন।
যেমন :
১. রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ
২. আপনা মাংসে হরিণা বৈরী
৩. হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেসী
প্রতীকের আড়ালে যেসব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তার পেছনে লেখকের দায়িত্ববোধ কাজ করেছে এমনটি বিশ্বাস করার কারণ নেই। তাঁদের রচনা জীবনসঞ্জাত, মাটি এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা আপ্লুত। এই অনুভব এতো বেশি আন্তরিক এবং সহজাত ছিল যে তাঁরা নিজের সময়কে উপেক্ষা করে শুধুই শিল্পের জন্য শিল্প তৈরি করেননি।
আরো পরে মধ্য যুগে ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল কাব্যে’ ঈশ্বরী পাটনী দেবী অন্নপূর্ণার কাছে বর চেয়েছিল এভাবে :
প্রণমিয়া পাটুনি কহিছে যোড় হাতে।
আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে॥
তথাস্ত বলিয়া দেবী দিলা বর দান।
দুধেভাতে থাকিবেক তোমার সন্তান॥
না, খুব সহজে সন্তানদের দুধেভাতে রাখা যায় না বলেই দেবীর কাছে এই ক্ষুদ্র প্রর্থনা করিব। সমাজের নিপীড়ন, বঞ্চনা, শোষণ কবিকেও ব্যাকুল করে। তিনি বর চান, কোথাও প্রতিবাদ করেন কিংবা সংগ্রাম করে ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হন। গোর্কি চেয়েছিলেন One family under one sky। এখানে ভারতচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর কোনো পার্থক্য নেই। এই চাওয়ার মধ্যে দেশ-কালের সীমানা নেই। এই একটি জায়গা সব দেশের লেখকের মিলনের কেন্দ্রবিন্দু। ভাষা ভিন্ন হয়, আঙ্গিক ভিন্ন হয়, প্রকাশ ভিন্ন হয়, কিন্তু মূল সুর এক। কখনো এ সত্য উচ্চারিত হয়েছে ছদ্ম আবরণে, কখনো সরাসরি। লেখক কৌশল অবলম্বন করেন মাত্র, কিন্তু সত্যকে অস্বীকার করেন না।
১৯৬৬ সালের পি.ই.এন. কংগ্রেসে পাবলো নেরুদা বলেছিলেন, ‘Speak in the name of those who cannot write, if the poet did not make himself the spokesman of the human condition, what else was there for him to do.’
উপর্যুক্ত বক্তব্যকে সত্য বলে মেনে নেয়ার পর প্রশ্ন জাগে human condition-এর সংজ্ঞার উপর। এই সংজ্ঞার ব্যাখ্যা একজন লেখকের কাছে তাঁর সামাজিক অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় human condition যে রকম, সমাজান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তেমন নয়, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এর সংজ্ঞা একদম ভিন্ন। প্রশ্ন হলো মানুষের স্বপক্ষে সোচ্চার হবার মতো অধিকার কি লেখকের থাকে? ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার লেখকের বিবেক কি তাঁর সরকারের দাবার ঘুঁটিতে পরিণত একটি দরিদ্র দেশের জনগণের পক্ষে সক্রিয় হয়? সমাজতান্ত্রিক দেশের লেখক কি অন্য দেশের ওপর তাঁর সরকারের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারেন? দারিদ্র পীড়িত ক্ষুধায় কাতর যেসব দেশের শাসকগোষ্ঠী human condition-এর ন্যূনতম চাহিদার নিচু স্তরে জীবনযাপন করে সে দেশের লেখক কি করে বুঝবে কিভাবে human condition-এর spokesman হতে হয়?
আসলে লেখকের চারপাশে এ অদৃশ্য নিগড় আছে। এই নিগড় রাষ্ট্রীয় কাঠামোর। ইচ্ছে করলেই যা কিছু করার অধিকার যেমন নেই, তেমন যা কিছু লেখার স্বাধীনতাও নেই। নেই বলে সোয়েকার্নোর আমলে ইন্দোনেশিয়ার ঔপন্যাসিক মুখতার লুবিস এগারো বছর জেল খেটেছিলেন। আফ্রিকার কালো আদম বেঞ্জামিনের ফাঁসিতো সেদিনের ঘটনা। এতো নিপীড়নের পরও লেখক সত্য ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার হন বলেই তিনি জাতির বিবেক। এই দায়িত্ব লেখককে পালন করতে হয় বিভিন্নভাবে। চেকোশ্লোভাকিয়ায় রাশিয়ান আগ্রাসনের পর ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি ফ্রান্সে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত কুন্ডেরার উপন্যাস ‘দ্য জোক’-এ লুই আরাগঁ যে ভূমিকা লিখেছেন, তা পৃথিবীজোড়া আলোড়ন তুলেছিল। ফরাসি কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আরাগঁ ঘোষণা করেছিলেন তিনি আর সোভিয়েতের মাটিতে পা রাখবেন না। অবশ্য পরবর্তীকালে তিনি এ কথা রক্ষা করতে পারেননি। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো সোভিয়েতের বিরুদ্ধে তিনি কুন্ডেরার পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন।
আলজেরিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন জাঁ পল সার্ত্র। তাঁর এই ভূমিকা বিশ্বব্যাপী জনমত গঠনে সহায়ক হয়েছিল এবং দ্য গল সরকার বাধ্য হয়েছিল আলজেরিয়ার স্বাধীনতা দিতে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সপক্ষে International Tribunal গঠন করেছিলেন ব্রাটান্ড রাসেল। বিশ্ব জনমত গঠনে যা অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল। এই একই কারণে কডওয়েল পেরেছিলেন স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শহীদ হতে। কারণ লেখক জানেন দেশকে দোর্দ- প্রতাপে শাসন করা যেমন দেশপ্রেমের লক্ষণ নয়, সমাজব্যবস্থার ত্রুটির স্বরূপ উদঘাটনও তেমনি দেশদ্রোহিতা নয়। বক্তব্যের স্বাধীনতাই এ দুয়ের সমীকরণ ঘটায়। সরকারি আদেশ নির্দেশ উপদেশ কোনো সৃষ্টিশীল ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সেজন্যই নেমে আসে নিপীড়ন। সমসাময়িক যুগে নিপীড়িত এবং অত্যাচারিত হয়েও বহু প্রতিভা ইতিহাসে অমরতা লাভ করেছে।
সোলজেনিৎসিন লেখককে স্বদেশের ‘দ্বিতীয় সরকার’ বলে অভিহিত করেছেন : For a country to have a great writer is like having another Government. That is why no regime has ever loved great writers, only minor ones. (The first circle)। কোনো সরকারেরই গৌণ লেখককে ভালোবাসার কারণ নেই যদি সেই লেখকের মেরুদণ্ড শক্ত থাকে। তিনি প্রধান লেখক না অপ্রধান সেটা বড় কথা নয়। প্রশ্ন হলো তিনি যা বলেছেন কতটা সততার সঙ্গে বলেছেন। সততার সঙ্গে বলতে না পারাটাই লেখকের জন্য অগৌরবের। প্রধান লেখকেরা স্তম্ভ হন, অপ্রধান লেখকরা হন ইতিহাসের বহমান স্রোত। সেই স্রোত থেকেও খারিজ হয়ে যান বিবেক বর্জিত লেখকের দল।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের রাজনীতির লেখকরা কি কোনো সচেতন ভূমিকা পালন করতে পারছেন? ১৯৬২ সালে জন কেনেডির আমলে সুইডিশদের মনোভাব ছিল আমেরিকার অনুকূলে। তখন জন স্টেইনবেককে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলে সমালোচকরা মন্তব্য করেছিলেন যে, Steinbeck deserved great honor as a man, not as a writer। এই অপমান কি শুধু স্টেইনবেকের না কি সব লেখকের?
স্টেইনবেক অবশ্য বলেছিলেন তাঁকে কেন পুরস্কার দেওয়া হলো তা তিনি বুঝতে পারলেন না তবে অর্থ পেয়ে তিনি খুশি হয়েছেন। নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য একথা বলা। অর্থ কোনো লেখকের জন্যই শেষ কথা নয়।
প্রেসিডেন্ট কেনেডির হত্যা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহণে সুইডেন মার্কিনের বিপক্ষে চলে যায়। সুতরাং সোভিয়েতের পক্ষ অবলম্বনের জন্য ১৯৬৫-তে শোলোকভকে নোবেল পুরস্কার দেয়। শোলোকভ সোভিয়েতের অনুমোদিত লেখক। তাঁর প্রখ্যাত সাহিত্যকর্ম কোয়াইট ফ্লজ দ্য ডন এবং ভার্জিন সয়েল আপ্টার্সড তিরিশ বছর আগে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৭ সালে লাতিন আমেরিকার সাহিত্য সমালোচক গুয়েতেমালার মিগুয়েল অস্টুরামকে পুরস্কার দেওয়া হয়। এ সময় সুইডিশ একাডেমির সেক্রেটারি ড. এন্ডারসন ওস্টারলিং লাতিন আমেরিকার প্রশংসা করেন এবং আমেরিকার সমালোচনা করেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা এই যে প্রখ্যাত Jorge Luis Borges-এর নাম পুরস্কার তালিকায় থাকা সত্ত্বেও অস্টুরামকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বলে তিনি আহত হয়েছিলেন।
নোবেল পুরস্কারের ইতিহাস থেকে আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। কিন্তু প্রয়োজন নেই। লেখকরা রাজনীতির শিকার হচ্ছেন, অপমানিত হচ্ছেন এবং যথাযোগ্য মূল্যায়নের অভাবে তাঁদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এতকিছুর পরও বিশ্বের লেখককুল নোবেল পুরস্কারের বিরুদ্ধে তেমনভাবে সোচ্চার নন। কেন? এর বিরুদ্ধে কি লেখকদের কোনো দায়িত্ব নেই? সবাইতো জানেন পুরস্কার লেখকের মূল্যায়নের শেষ মানদ- নয়। তবু এতোকিছুর পরও কেউ কেউ থাকেন যিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিবাদ করেন। নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেননি জর্জ বার্নাড শ। আর জাঁ পল সার্ত্র? তিনি যে ভাষায় এবং যে যুক্তিতে এই পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তা একটি দৃষ্টান্ত। তারপরও কথা থাকে। প্রতিবাদ একযোগে প্রবল না হলে তা খুব কার্যকরী হয় না। একটি দুটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে না। তাই এই পুরস্কারটি নিয়ে চলছে রাজনীতির এমন ছিনিমিনি খেলা।
লেখকের দায়িত্ব অনির্দেশিত বলেই সীমানা টানা নেই। এ কারণেই যে দায়িত্ব বৃহৎ দেশের লেখকদের পক্ষে পালন করা সম্ভব, সে দায়িত্ব কোনো অনুন্নত দেশের লেখকের পক্ষে পালন করা অসম্ভব। একজন সার্ত্রই পারেন আলজেরিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার হয়ে ফরাসি সরকারে টনক নড়াতে। বাংলাদেশের কারো পক্ষে এমনটি সম্ভব নয়। উন্নত দেশের লেখকরা যে সুযোগ-সুবিধা পান, অনুন্নত দেশের লেখকদের তেমন সুযোগ নেই। বাংলাদেশের একজন লেখকের সমস্যা ফুটপাথে মৃত মানুষ কিংবা ভূমিহীন কৃষক, জাপানের লেখকের সমস্যা আণবিক বোমা কিংবা কালো বৃষ্টি, দক্ষিণ আফ্রিকার লেখকের সমস্যা বর্ণবাদ, আমেরিকার লেখকের সমস্যা তারকাযুদ্ধ কিংবা চাঁদে বসতি, সোভিয়েতের লেখকের সমস্যা সাইবেরিয়ার ভূগর্ভে পারমাণবিক বিস্ফোরণ। তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় লেখকের দায়িত্ব?
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সমস্যা আরো প্রবল। এদের ঘাড়ের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো অনড় সামরিক শাসন, তাকে বিব্রত থাকতে হয় নিজের অস্তিত্বের প্রশ্নে। আজকের দিনে তৃতীয় বিশ্বের লেখকদের শেকড়সন্ধানী অনুপ্রেরণা বৈরী সময়কে অতিক্রম করতে চায়, অতিক্রম করতে চায় মিলিটারি এ্যারিস্টোক্রেসির বদৌলতে বন্দুকের শাসন। কেননা এই শাসন-উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মূল্যবোধের অবক্ষয়। যে অবক্ষয় সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে ঢুকিয়ে রাখে কালো থাবা। যার নিষ্পেষণে পদদলিত হয় সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা। এই আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রমূর্ত রাখার দায়-দায়িত্ব লেখকদের। যে জন্য লেখক হন নীলকণ্ঠ। একই সঙ্গে অমৃত এবং হলাহল কণ্ঠে ধারণ করার দক্ষতা তাঁকে ইতিহাসে অমর করে।
শিল্পের দাবি কঠিন, লেখকের দায়ও বড় শক্ত। এই শক্ত দায় কতভাবে, কত পদ্ধতিতে পালিত হবে, একজন সৃজনশীল মানুষই তার উপায় নির্ধারণ করতে পারেন। অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রবক্তা ছিলেন সার্ত্র। তিনি ব্যক্তির স্বাধীন সত্তায় বিশ্বাস করতেন। বলেছেন, ব্যক্তি কেবল তার নিজের কাছেই দায়বদ্ধ, অন্য কারো কাছে নয়। কারণ ঈশ্বরবিহীন পৃথিবীতে ব্যক্তির সত্তা স্বাধীন। ব্যক্তি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে সেটা তার স্বাধীন সত্তার প্রকাশ। মনে হয় আপাত সরল এই বক্তব্যে ব্যক্তিকে অবাধ, মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সামাজিক অঙ্গীকারের বাইরে রেখে তাকে যা কিছু করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। আসলে কি তাই? যে ব্যক্তি নিজের কাছে দায়বদ্ধ সে সমাজের কাছে দায়বদ্ধ না হয়ে পারে না। সার্ত্র ব্যক্তিকে নিজের কাছে দায়বদ্ধ করে তাকে তার প্রজ্ঞা ও বিবেকের সঙ্গে গেঁতে দিয়েছেন। তিনি নিজেই বিবেকের কাছে যা সত্য বলে জেনেছেন তাকেই বড় করে দেখেছেন। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপোসহীন, অনমনীয়। বিশ্বমানবতার সংকটে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা নজিরবিহীন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কট্টর প্রবক্তা সার্ত্র, সবসময়ই ছিলেন শোষিত মানুষের পক্ষে। সাম্যবাদের বিরোধিতা তিনি সহ্য করতে পারতেন না, কিন্তু মার্ক্সবাদী পার্টির আমন্তান্ত্রিকতার বিরুদ্ধেও ছিলেন সোচ্চার। তাঁর মতে, ‘এই বাম, যা সবকিছু ছেড়ে দিয়েছে, যা আজ বিধ্বস্ত, যা এক হতচ্ছাড়া দক্ষিণপন্থীকে জয়ী হতে দিচ্ছে।’ কত আগের কথা। বিশ্বজোড়া মার্ক্সবাদী পার্টির কার্যকারণে এই সত্য প্রতিফলিত হয়েছিল। ’৮৯-তে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য দেশে মার্ক্সবাদের পতন কত দ্রুত একজন চিন্তাশীল লেখকের ধারণাকে বাস্তবায়িত করেছে।
সার্ত্রে তাঁর জীবনসাধনায় প্রতিনিয়ত অনুশীলন এবং অনুসন্ধান করেছেন। মার্ক্সবাদীরা কখনো তাঁকে কাছে টেনেছে, কখনো দূরে সরিয়ে দিয়েছে। সত্য কথা বলার জন্য তিনি সবার কাছে প্রিয় হননি। তাতে সার্ত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। জয়ী হয়েছে লেখকের সত্য, জয়ী হয়েছে শিল্পের দায়।
একই কথা ওঠে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। চল্লিশের দশকে মার্ক্সবাদীরা রবীন্দ্রনাথকে সামন্তবাদী চেতনার ধ্বজাধারী–বুর্জোয়া ভাববাদী ইত্যাদি নানা অভিধায় চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁর রচনা বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অথচ স্বদেশের নানা সংকটে, দুর্যোগে, দুঃসময়ে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল সবসময় সাহসী আপোষহীন। তিনি যে অনমনীয় ভূমিকা পালন করেছেন দেশের অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা তা করেননি। শুধু কি তাই, ত্রিশের দশকে ফ্যাসিস্ট শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে তিনি তীব্র ধিক্কার জানিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। হিটলারের নাৎসিবাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রাশিয়ার চিঠির তিন সংখ্যক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আপাতত রাশিয়া এসেছি। না এলে এ জন্মের তীর্থদর্শন অসমাপ্ত থাকত।’ চিঠিটা ১৯৩০ সালের ২৫ ডিসেম্বর লেখা। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বুর্জোয়া মানবতাবাদী। তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু ‘তীর্থদর্শন’ শব্দটির মধ্যদিয়ে মানবতার জন্য যে গভীরতম ব্যঞ্জনা প্রকাশ পায় তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। তিনি একটি ভিন্ন মেরুর মানুষ হয়েও সমাজাতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে তীর্থদর্শন বলেছেন। স্পষ্ট বোঝা যায় তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের জন্যও ছিল তাঁর গভীর মমতা। ১৯৪১-এ ফ্যাসিস্ট হিটলার আক্রমণ করেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন। তখন তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়। তিনি অসুস্থ। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ তাঁর জীবনীতে লিখেছেন যে রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন খবরের কাগজের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। যেদিন দেখতেন সোভিয়েত সৈন্যরা পিছু হটেছে, নাৎসিরা এগিয়েছে, সেদিন তিনি কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। সারাদিন তাঁর খারাপ যেত। যেদিন দেখতেন সোভিয়েত বাহিনী এগিয়েছে, নাৎসিরা পিছু হটেছে সেদিন তিনি উৎফুল্ল হয়ে উঠতেন। বলতেন, ‘সোভিয়েত কখনো পরাভব মানবে না।’ অসুস্থ অবস্থায় তিনি সানন্দে কলকাতায় সদ্যগঠিত ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’র পৃষ্ঠপোষক হতে সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন। এখানেই শিল্পীর দায়, মত-পথের আদর্শের প্রশ্ন নয়, শিল্পী চান ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে মানবতার জয়।
বর্তমানে লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার লেখকরা সৃষ্টিশীল রচনার মধ্যদিয়ে নিজেদের শেকড়ের সন্ধান করছেন। তাঁর এই দায়বদ্ধ চেতনা থেকেই রাজনীতি ও সংস্কৃতির রাখিবন্ধন করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ঐন্দ্রজালিক প্রেরণা সঞ্চয়িত করেছেন। এ এমন এক অভিনব ধারা যে বিশ্বের পাঠকের দৃষ্টি এখন তাদের দিকে ঘুরে গেছে।
ঔপনিবেশিক শাসন, সামরিক শাসন, রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি, সাধারণ মানুষের সংগ্রাম ও বেঁচে থাকার কষ্ট নিয়ে তাঁরা ভিন্ন আঙ্গিকে গল্প-উপন্যাস-কবিতা লিখেছেন। শুধু সত্যের উদ্ঘাটন করেননি। তাঁকে শিল্প-সফলও করেছেন। এভাবেই বদলে যাচ্ছে শিল্পের বিষয়, আঙ্গিক–বদলে যাচ্ছে চেতনা, অনুভব। লেখকের শিল্পের খনন নিরন্তর চলে। তাঁর দায় তাঁকে কোনো অনির্দিষ্ট সত্যে বেঁধে রাখবে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
এ বছরের ১২ জুন (১৯৮৭ সাল) তারিখে নাইজেরিয়ায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আফ্রিকার এই দেশটি দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা পার হয়ে এলেও সামরিক শাসনের নিপীড়নে ছিল পীড়িত। জেনারেল বাবংগিদা মাঝপথে ভোট গণনা থামিয়ে দেয়। শুরু হয় বিক্ষোভ, প্রতিবাদ। হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে আসে। ১৯৮৬ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নাইজেরীয় সাহিত্যিক ওলে সোয়েঙ্কা জেনারেলদের তীব্র ভর্ৎসনা করে প্রতিবাদ জানান। তাঁর প্রতিবাদের প্রথম লাইনটি ছিল এমন : ‘জাতীয় নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা না করার সিদ্ধান্তটি প্রকৃতপক্ষে নাইজেরীয় জাতির জন্য এক মৃত্যু-দণ্ডাদেশ, যা ধীরে ধীরে কার্যকর হবে।’
শেষ পর্যন্ত ২৬ আগস্ট তারিখে নাইজেরীয়ার সামরিক নেতা ইব্রাহিম বাবাংগিদা পদত্যাগ করেছে। তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে দেশটিতে দীর্ঘদিনের সামরিক শাসনের অবসান হয়।
বাংলাদেশের লেখকরাও বিশ্ব-পটভূমির এই ধারাবাহিকতার বাইরে নয়। আমরা যদি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতার মূল্যায়ন করি, দেখবো, লেখকরা এই ইতিহাসের মৌল উপাদান সৃষ্টিতে কত ব্যাপক এবং গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছেন। পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পূর্ববঙ্গের ছাত্রদের উপর বাংলা ভাষা ব্যতীত যদি অন্য কোনো ভাষা আরোপ করা হয় তবে ইহার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো আমাদের উচিত। এমন কি প্রয়োজন হইলে ইহার বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহ করা উচিত। বাংলা ভাষা অবহেলিত হইলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ করিব। নতুন ভাষা আরোপ করা পূর্ববঙ্গে গণহত্যারই শামিল হইবে।’
গণহত্যার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। গণহত্যা দিয়ে শুরু হয়েছিল এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। সে সময় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একা ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সমসাময়িক সচেতন লেখকরা। অনেকের রচনা থেকেই উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে। লেখকদের এই দায়বদ্ধ ভূমিকার কারণে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদেরকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হত্যা করেছে। একই কারণে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দুদিন আগে রাজাকার-আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবীদেরকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। তারা চেয়েছিল একটি স্বাধীন দেশের মেধার শূন্যতা, বিবেকের শূন্যতা-সৃজনশীলতর শূন্যতা। কারণ সৃজনশীল মানুষেরাই পারেন গণমানুষের চেতনায় স্বপ্নের ফুল ফোটাতে।
তাই গণমানুষের কথা সরবে উচ্চারিত না করেও বড় লেখকের রচনায় ফল্গুধারার মতো বয়ে যায় সে অন্তঃস্রোত। যে কারণে আমরা হোমার পড়ি, পড়ি শেক্সপিয়র, রামায়ণ, মহাভারত, শাহনামা, গালিব, খৈয়াম। আমাদের যাপিত জীবনের দিগন্ত পরিব্যপ্ত করে রাখে এইসব রচনা। ধ্রুপদী রচনায় তাই দেশ থাকে না, থাকে না খণ্ডিত রুপোলি আকাশ। তা সবকালের, সব মানুষের। তাই লেখকের মৌল দায়িত্ব ভালো লেখা। নিজের প্রতি সৎ থেকে নিজের অনুভবকে শক্ত মেরুদণ্ড দেওয়া লেখকের কর্তব্য। তিনি যেন কখনো পরগাছা না হন, অন্যের ইচ্ছে-অনিচ্ছের দাসত্ব না করেন। জনপ্রিয়তা ভালো লেখকের বিবেচনার বিষয় নয়। রাজনৈতিক কমিটমেন্ট লেখকের মানসিক আশ্রয়, মানবিক উচ্চারণ লেখকের প্রাথমিক শর্ত, দেশকাল তাঁর জীবনযাপনের অষ্টপ্রহর যন্ত্রণা। এতকিছুর পরও শর্ত ভালো লেখা–বিপ্লবী দায়িত্ব ভালো লেখা। যে লেখা বক্তব্যের সঙ্গে শিল্পের নির্মাণের এক মহাকালির অগ্রযাত্রা।