বয়স্কদের জন্য নিরাপদ খাদ্যাভ্যাস
গত কয়েকমাসে পরিচিত অনেকের পরিবারের প্রবীণদের মৃত্যুর খবর জেনেছি। চারজন বন্ধুর বাবা মারা গেছেন। করোনাকালীন সময়টায় করোনা আতঙ্কে অন্যসব রোগকে আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি৷ হয়তো অনেকক্ষেত্রে যথাসময়ে চিকিৎসা পাবারও সুযোগ হচ্ছেনা। তবে এইসময়টায় যে ধরনের খাদ্যাভ্যাস বা জীবনযাত্রা তৈরি হয়েছে, সেটি আমাদের জন্য উপযুক্ত কিনা সে বিষয়টি দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে৷ নিজেদের পাশাপাশি বৃদ্ধ বাবা-মা বা প্রিয়জনদের সুস্থতার খাতিরেই কিছু বিষয় জেনে রাখা জরুরি৷ প্রয়োজন নিরাপদ খাদ্যাভ্যাস।
পরিচিতদের মধ্যে গত কয়েকমাসে যে ক'জন বয়স্ক মানুষ মারা গেছেন, তাদের প্রত্যেকেরই ডায়াবেটিস, ক্রোনিক কিডনিজনিত সমস্যা, ক্যান্সার, এমনকি মাইল্ড হার্ট অ্যাটাকের মতো সমস্যা ছিলো। তাই একটু জানতে চেষ্টা করেছি কীভাবে বয়স্কদের বেলায় এমন 'নন-কমিউনিক্যাবল ডিজিজ'কে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
বয়স বাড়ার সাথে সাথেই দেহে এমন রোগগুলো বাসা বাঁধতে থাকে। একবার হয়ে গেলে তা পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব না হলেও, শুধুমাত্র ডায়েট এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, যেহেতু এর সবগুলোই ডায়েটারি ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভরশীল। ৬৫ বা তারও বেশি বয়স হলেই আমরা কাউকে বয়স্ক, বা Geriatric Patient বলে থাকি। এই বয়সীদের শতকরা ৮৫ ভাগের বিকলাঙ্গতা এমনকি মৃত্যুরও কারণ নানাধরনের নন-কমিউনিক্যাবল ডিজিজ। বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও বিষয়টি কিছুটা 'Geriatric Nutrition' এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। এটির মানে হচ্ছে বার্ধক্যজনিত প্রভাবকে পুষ্টির সহায়তায় বিলম্বিত করা।
আমরা জানি, প্রবীণ বা বয়স্ক ব্যক্তিরাই অপুষ্টির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বয়সের সাথে সাথেই শরীরের বিপাকীয় হারের (BMR) পাশাপাশি, ওজন, মাংসপেশির (Lean Muscle Mass) হ্রাস পেতে থাকে, যার ফলাফল গিয়ে দাঁড়ায় কম এনার্জি রিকোয়্যারমেন্টে। এসময় কিছু কিছু পুষ্টি উপাদানের চাহিদা যেমন কমতে থাকে, তেমনি কিছু পুষ্টি উপাদানের চাহিদাও বিপুল বেড়ে যায়। দেহের চাহিদা অনুযায়ী খাবারের কম বৈচিত্র্যতা, অর্থনৈতিক স্বল্পতা, দাঁতের ক্ষয়/না থাকা, ঘ্রাণ না পাওয়া, স্মৃতিশক্তি লোপ পাবার ফলে খেতে অনাগ্রহী হন অনেকেই, যার ফলে সবচেয়ে বেশি দেখা দেয় ক্ষুদ্র-পুষ্টি। সেসময় Micronutrients, Calcium, Vitamin-D, Vitamin-A, Iron, Folic Acid, Vitamin-B12, Antioxidants ইত্যাদি উপাদানগুলোর ঘাটতি, এমনকি শরীরে পানির পরিমাণও কমতে থাকে। কম খাবার গ্রহণে ইনসুলিন হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়, এতে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবারে দেহ ইনটোলারেন্ট হয়ে পড়ে। এতে করে দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এতই লোপ পায় যে, সাধারণ সর্দি-কাশিও তাদের দেহে ঘাটি গেড়ে বসে।
তাই প্রতিরোধের উপায় হলো খাবারের উপর জোড় দেওয়া, শারীরিক পরিশ্রম করা। প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি করে খাওয়া, যাতে দেহে ভেঙ্গে যাওয়া প্রোটিন সহজেই তৈরি হতে পারে এবং Lean পেশির কমে যাওয়া অংশ পূরণ হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় দৈহিক ওজন অনুযায়ী ০.৮-১গ্রাম/কেজি প্রোটিনজাতীয় খাবার রাখা যেতে পারে। ফল, সবুজ শাকসবজি, মাছ-মাংস, ডিম, দুধ, সামুদ্রিক মাছের প্রতি জোড় দেওয়া উচিত, আর পরিমিত পানি পান করতে হবে। লবণে যেহেতু নিউট্রিয়েন্ট ফর্টিফাই করা হয়, তাই একদমই বাদ না দিয়ে পরিমিতভাবে (দৈনিক ৬গ্রাম এর কম) গ্রহণ করতে হবে।
মাত্রাতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার, সিগারেট, অ্যালকোহলের মতো নেশাজাতীয় দ্রব্য বর্জন করতে হবে। অনেকেই একবেলায় দরকারি সব খাবার খেতে পারেন না, এক্ষেত্রে Small Meal Frequency ফলো করা যেতে পারে। খাবারের পাশাপাশি ফিজিক্যাল মুভমেন্ট, যেমন- হাঁটা, ইয়োগা ইত্যাদি শরীরচর্চা বাড়াতে হবে। এগুলো মেনে চললে বয়সের বৃদ্ধি প্রলম্বিত হওয়ার পাশাপাশি ডায়বেটিস, হার্ট ডিজিজ, ক্যান্সার, কিডনি ডিজিজের মতো রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।
মনে রাখতে হবে, 'Diet is the 1st medicine for any kind of disease', তাই খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনুন, পরিমিত পরিমাণে সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করুন৷
লেখক: স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী,
পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়