‘ভালো মেয়েরা গলার আওয়াজ তোলে না’
“সাংবাদিকতার সুবাদে প্রতিদিনই আমাকে ঘুরতে হয় শহরের এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত। মিশতে হয় বহু মানুষের সাথে। সারাদিন চষে বেড়ানো এই শহরে প্রতিদিনই ইভটিজিং নামক হেনস্তার শিকার হতে হয় আমাকে। কখনো শুনেও না শোনার ভান করি, আবার কখনো চাইলেও পারি না । প্রতিদিন আমার শরীর, আচার-আচরণ ঘিরে বাজে মন্তব্য শুনে বাইরে পা বাড়াতে ভয় হয়। সর্বক্ষণ মনে হতে তাদের লালসার ঘৃণ্য দৃষ্টি আমার শরীরে তীরের মতো বিঁধছে। অশ্লীল মন্তব্যের মধ্যে মুখ বুঝে থাকা অনেকটাই কষ্ট সাধ্য। কিন্তু আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে মেয়ে হিসাবে প্রতিবাদ করাটা একরকমের পাপ। কারণ প্রতিবাদ করে উল্টা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে আপনাকেই।
একবার অফিসের কাজ শেষ করে বের হতে রাত সাড়ে নয়টা বাজলো। কাওরান বাজার থেকে ফার্মগেট হেঁটে যাচ্ছি। ডেইলি স্টার ভবন পার করার পরই লক্ষ্য করলাম আমার পিছনের দুইজন আমার শরীরকে ঘিরে অশালীন মন্তব্য করছে।“মামা চলবো নাকি। আজকে রাত তো একাই আছি। অনেক গরম আছে মালটা। যাবা নাকি।” কথাগুলা শুনে হঠাৎ ভয়ে অস্থির হয়ে আরও দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর হেঁটে একটু কয়েকজন মানুষ দেখতে পেলাম, সাথে সস্তি। পেছনে তারা আছে কিনা নিশ্চিত হতে তাকালাম দেখি আমার দিকে তাকিয়ে অশালীন মুখভঙ্গি করছে। গাঁ শিউরে উঠলো। কেমন একটা সমাজে বাস করি যেখানে আমাদের মতো কর্মজীবী নারীদের নিরাপত্তা নেই। চলতি পথে সর্বক্ষণ নর পিশাচের চোখ আমাদের কুঁকড়ে খায়।
আরেকবারের, বাসায় ফিরবো বলে লেগুনার জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ আমার শরীরের ¯পর্শকাতর স্থান ¯পর্শ করে খুব কাছ থেকে বলে গেলো, ‘সামলায় রাখ নাহলে খাইয়া দিমু’। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার চিন্তাশক্তি অবশ হয়ে গেলো। শরীর রীতিমতো ভয়ে জমে গিয়েছিল। কিছু বুঝার আগের মানুষের ভিড়ে মিলিয়ে গেলো মানুষরূপী পিশাচ। ঐদিনের পর বেশ কিছুদিন বাহিরে বের হইনি ভয়ে। বের হতে হবে ভাবতেই ডিপ্রেশন কাজ করতো। কতোদিন এইসব সহ্য করা যায়! তারপরও জীবিকার তাগিদে বের হই। মানুষের চোখ এড়িয়ে পথ চলার চেষ্টা করি।
এই শহরে, এই দেশে বেড়ে উঠা প্রায় প্রত্যেক নারী, মেয়েই জীবনের কখনো না কখনো ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া শারমিন জানান, “প্রায়ই এমন পরিস্থিতির সামনে পড়েছি। কখনো অশ্লীল গান দিয়ে আবার কখনো রূপক কিছুর সাথে তুলনা করে টিজিং করে। প্রতিবাদ করার সুযোগ থাকে না। কারণ কথাগুলো সরাসরি বলে না। শুধু যে পথেই ইভটিজিং হয় তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরেও সিনিয়র ভাইদের দ্বারা টিজিংয়ের শিকার হয়েছি। একবার প্রতিবাদ করায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা কিভাবে করি দেখে নিবে এমনই হুমকিরও শিকার হয়েছি। আরেকবার ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরছি। পরনে কুর্তী জিন্স। ট্রাফিকে বসে অপেক্ষা করছি পাশের রিক্সাওয়ালা আমাকে ইঙ্গিত করে অশালীন ভঙ্গিতে আমার রিক্সাচালক বলতে লাগলো বুক খোলা রাইখা ঘুইরা বেড়ায়। কথাটা শুনেই নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। রিক্সা থেকে নেমেই তাকে কড়া একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলাম। তারপর কিছু বলতেই সে বলে উঠলো আপনারে তো কিছু কই নাই। এতো ফাল পারতেছেন ক্যান? মাইয়া মানুষ চুপ থাকেন। ততক্ষণে আশপাশে মানুষ জড়ো হয়ে গেছে।
ট্রাফিকও ছেড়ে দিসে। শুনলাম আশেপাশে মানুষ আমাকে নিয়ে উল্টা কথা শোনাচ্ছে। কেউ কেউ হাসছে। কয়েকজন তো বলেই বসলো ম্যাইয়াদের এতো তেজ ভালো না তাহলে বেশ্যা লাগে। মন্তব্যগুলা শুনে মিশ্র অনুভূতি কাজ করলো। সমাজের এইসব মানুষের ভিড়ে নিজেকে অসহায় লাগতে লাগলো। এমনকি এই বিপদে অন্য মহিলারাও আমার পক্ষে কথা বললো না।”
যখন একজন নারী কোনোভাবে হেয় হয়,আরেকজন নারী এসে তার পাশে দাঁড়ায় না৷যে নিরাপদে আছে,সে নিজের গা বাঁচিয়ে সরে যায়৷এমনকি যে আক্রান্ত হয়,সে-ও সহজে রুখে দাঁড়ায় না। ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয়, ‘ভালো মেয়েরা গলার আওয়াজ তোলে না'৷
ইভটিজিং শব্দটি ছোট হলেও এর অন্তর্ভুক্ত অর্থ ব্যাপক। কোনো নারী, যুবতী, কিশোরী বা মেয়ে শিশুকে তার স্বাভাবিক চলাফেরার ক্ষেত্রে বিরক্ত করা,চলার পথে বা স্বাভাবিক কাজকর্ম করা অবস্থায় অশ্লীল বা অশালীন মন্তব্য করা,যে কোনো ধরনের ভয় প্রদর্শন,তার নাম ধরে ডাকা বা বিকৃত নামে তাকে সম্বোধন,চিৎকার চেঁচামেচি করা,তার দিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কিছু ছোড়া,ব্যক্তিত্বে লাগে এমন ধরনের মন্তব্য করা,যোগ্যতা নিয়ে টিটকিরি করা,তাকে নিয়ে অহেতুক হাস্যরসের উদ্রেক করা,রাস্তায় হাঁটতে বাধা দেওয়া,অশ্লীল বা অশালীন অঙ্গভঙ্গি করা, ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেওয়া, সিগারেটের ধোঁয়া গায়ে ফেলা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে পিছু নেওয়া, অশ্লীলভাবে প্রেম নিবেদন করা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে গান-ছড়া বা কবিতা আবৃত্তি করা,চিঠি লেখা,পথরোধ করে দাঁড়ানো,হুমকি প্রদান এর সবই ইভটিজিংয়ের মধ্যে পড়ে।
পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখা যায়, প্রতিদিনই কেউ না কেউ ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে যতগুলো ইভটিজিং কেস আছে তার শুধুমাত্র কিছু অংশই মিডিয়াতে আসে। বাকিগুলো চাপা পড়ে থাকে সম্মানহানীর ভয়ে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপাত্ত অনুসারে, গত চার বছরে খবরে প্রকাশিত নারী উত্যক্তের ঘটনা ৭৪২টি। এইসব ঘটনায় অন্তত ৩৬জন মেয়ে আতœহত্যা করেছে। এছাড়া নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় বিচারের হার ৩. ১% (সূত্রঃ অ্যাকশন এইড)।
ইভটিজিং বা নারী উত্যক্তের এই ব্যাপারগুলো যে বাস্তবতার গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন সময় চলচিত্র অথবা গানে যুগ যুগ ধরে নারীদের টিজিং করে আসা হচ্ছে। যেসব কুটক্তি মন্তব্য,অশালীন মন্তব্য পথে শুনতে মিলে তার অধিকাংশ উস্কানই আসে এসব সিনেমা অথবা গান। যেখানে দেখানো হয় নায়ক পথে অথবা কলেজ যাওয়ার সময়
নায়িকাকে প্রেম নিবেদন করছে। অথবা ভিলেনের নায়িকাকে পছন্দ ঘিরে অশালীন মন্তব্য। কখনো প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় জোর জবস্তি করা। উদাহরণ সরূপ “চুমকি চলেছে একা পথে,সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে” অথবা হানি সিঙয়ের ব্ল“ আইস গানে।
আইনে যা আছে : বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারায় ইভটিজিং স¤পর্কে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারীর শ্লীলতাহানির উদ্দেশ্যে সে নারী যাতে শুনতে পায় এমনভাবে কোনো কথা বলে বা শব্দ করে কিংবা সে নারী যাতে দেখতে পায় এমনভাবে কোনো অঙ্গভঙ্গি করে বা কোনো বস্তু প্রদর্শন করে,কিংবা অনুরূপ নারীর গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করে,তা হলে সেই ব্যক্তি এক (১) বছর পর্যন্ত বা যে কোনো মেয়াদে বিনাশ্রম কারাদণ্ডে কিংবা অর্থদণ্ডে কিংবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।’ ৩৫৪ ধারায় বলা হয়েছে,‘যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারীর শালীনতা নষ্ট করার অভিপ্রায়ে বা সে তাদ্বারা তার শালীনতা নষ্ট করতে পারে জেনেও তাকে আক্রমণ করে বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করে তা হলে সে ব্যক্তি ২ বৎসর পর্যন্ত যেন কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে বা জরিমানা দণ্ডে বা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’
দণ্ডবিধির ২৯৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করে কোনো প্রকাশ্য স্থানে কোনো অশ্লীল কার্য করে অথবা কোনো প্রকাশ্য স্থানে বা তার সন্নিকটে কোনো অশ্লীল গান, গাঁথা, সংগীত বা পদাবলি গায়,আবৃত্তি করে বা উচ্চারণ করে তাহলে সে ব্যক্তি ৩ মাস পর্যন্ত যে কোনো ধরনের কারাদণ্ডে বা জরিমানা দণ্ডে বা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’ [তথ্যসূত্র : মো. গাউছুল আজম, র্যাবের আইন কর্মকর্তা]
আমাদের দেশে প্রতি বছর ১৩ই জুন ইভটিজিং প্রতিরোধ দিবস পালন করা হলেও এতসব আইন থাকা সত্বেও ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছেনা। প্রায়ই ঝরে পড়ছে অসংখ্য প্রাণ। সমাজের এই ব্যাধি শুধু আমি অথবা আপনি একা মিলে প্রতিরোধ সম্ভব না। চাই সকলের একগ্র প্রচেষ্টা। একজনকে ইভটিজিং হতে দেখে নিজে পাশ কাটিয়ে চলে না গিয়ে, ভুক্তভোগীর সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। মানসিকতা বদলানো খুব সহজ কাজ নয়৷ তবে,সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি অনেক উন্নত করা সম্ভব৷ প্রয়োজন শুধু বিশ্বাস যে,বদল আনতে হবে এবং আমাদেরই আনতে হবে৷