পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে অনন্যা’র অন্দরেও
আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে এমনই এক হেমন্তের দিনে যাত্রা শুরু করেছিল পাক্ষিক অনন্যা। হেমন্ত, ঋতুকন্যা হেমন্ত! জীবনানন্দ দাশের প্রিয় হেমন্তঋতুর এক মোহিতরূপ তিনদশক আগেও বাংলার চরাচরজুড়ে ছড়িয়ে থাকত। কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। মিষ্টি রোদের আদর। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত। কৃষিপ্রধান আমাদের জনজীবনে হেমন্ত আসে আনন্দ-বেদনার নরম পায়ে। ধান কাটা-মাড়াই, চড়–ইচঞ্চল ব্যস্ততা। নবান্নের পিঠাপুলি। সূর্যাস্তের সময় ফসলকাটা মাঠে হেমন্তের ধোঁয়াশা ঝুলে থাকে বনজ প্রকৃতির ভেতরে। বাংলার প্রকৃতিতে যেন রূপের হাট মেলে বসে। আর জীবনানন্দ তখন লিখে ফেলেন- ‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে/হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু শিশিরের জল;/অঘ্রানের নদীটির শ্বাসেসে/হিম হয়ে আসে।…’
আর এমনই দিনে, এক অজানা স্বপ্নাঞ্জন মেখে যাত্রা শুরু করেছিল পাক্ষিক অনন্যা। সাফল্য ব্যর্থতা বড্ড আপেক্ষিক বিষয়। বরং সময়ের ওপর আঁচড় রেখে যাওয়াটাও বড়ো কথা। গত ৩২ বছরে আমরা ক্রমশ অকল্পনীয় এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি।
কে-না জানে, পরিবর্তনই জীবনের ধর্ম। পরিবর্তনই সব কিছুর নিয়ন্তা। পরিবর্তনের একটি উদাহরণ বোঝাতে সৈয়দ মুজতবা আলী যেমন ওমর খৈয়ামের বিখ্যাত পঙক্তি বাংলায় তর্জমা করেছেন, ‘প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে’- অর্থাৎ ফুরিয়ে যাবে সকল সৌন্দর্য, পরিবর্তন গ্রাস করবে সকল কিছু। সেই অর্থে ‘পরিবর্তন’ একটি চিরন্তন শব্দ। মানুুষ যেমন একই নদীতে দুবার গোসল করতে পারে না, নদীর প্রবহমান জল এসে সরিয়ে নিয়ে যায় একটু আগে ডুব দেওয়া অংশটুকু, তেমনটি নিরন্তর পরিবর্তন আমাদের এমন এক চক্রব্যুহে ঢুকিয়ে দেয়, যেখান থেকে আর কখনো বের হওয়া যায় না। আমরা আর কখনো ফিরে যেতে পারব না লেটার প্রেস, ব্লক ছাপার যুগে। অনন্যা’র যাত্রার শুরুতে যাকে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে পেয়েছিলাম, সেই দিল মনোয়ারা মনু চিরতরে বিদায় নিয়েছেন গত ১৪ অক্টোবর, তাকে আর কোনোদিন ফিরে পাব না। অনন্যার পাশে যেসব কবি-সাহিত্যিক শিল্প অনুরাগীরা দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই চলে গেছেন না-ফেরার জগতে। একইসঙ্গে অনন্যা এমনই তিনটি দশকের সাক্ষী- যে-সময় দ্বিমেরু যুগের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বে শুরু হয়েছিল বহুমেরু যুগের, পতন ঘটেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের, চালু হয়েছিল মুক্তবাজার অর্থনীতি, ঘটেছিল নাইন-ইলিভেনের মতো তোলপাড়করা ঘটনা। আর এসবের মধ্যে নীরবে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে তথ্যপ্রযুক্তি নামের এক বিস্ময়-বিজ্ঞান। আর এসবের ভেতর দিয়েই বাংলাদেশের নারীদের অনুপ্রেরণার একটি প্লাটফরম হওয়ার চেষ্টা করেছে পাক্ষিক অনন্যা। সামগ্রিকভাবে দুই শতাধিক কৃতি নারীকে সম্মানিত করেছে অনন্যা শীর্ষদশ। বাংলাদেশে নারীজাগরণের বিস্ময়কর পথ-পরিক্রমার সাক্ষী থেকেছে পাক্ষিক অনন্যা।
সার্বিকভাবে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে অনন্যা’র অন্দরেও। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে যা যা করতে হয়, সেসব পরিবর্তন অনন্যাতেও ঘটেছে, ঘটে চলেছে অলঙ্ঘনীয় কারণে। বিগত ৩২ বছরে ‘অনন্যা’কে অনন্যা-রূপে প্রকাশিত হতে যাঁরা কোনো-না-কোনোভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের প্রতি রইল অশেষ কৃতজ্ঞতা। রইল নিরন্তর শুভ-ইচ্ছা, ভালোবাসা।