এটা বাপের বাড়ি, ওটা শ্বশুর বাড়ি- নারী তোমার বাড়ি কই?
নারীমাত্রই বাপের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি। নির্দিষ্ট করে নিজের বাড়ি বলার উপায় আমাদের সমাজে নেই। নারীর ভূ-সম্পত্তি পিতা-স্বামীর দয়া-দাক্ষিণ্যর ওপরই নির্ভরশীল। আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে কন্যা সন্তানের পিতা-মাতার সম্পত্তির অংশীদারিত্বের বিধান রয়েছে। তবে সেটা পুত্র সন্তানের প্রাপ্ত অংশের অর্ধেক। স্বামী এবং মৃত পুত্রের সম্পত্তির ষোলআনার মাত্র দুইআনা অংশের আইনি দাবিদার। তবে পিতা বা স্বামী যদি জীবদ্দশায় নিজেদের সম্পত্তি পুত্রদের অনুকূলে দিয়ে যায়; সেক্ষেত্রে কন্যা এবং স্ত্রী কানাকড়িও পায় না। নারীর উত্তরাধিকারী সম্পত্তি পাওয়া না-পাওয়া সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে পিতা বা স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। পুত্রসন্তান না থাকলে পিতার অবর্তমানে কন্যা সন্তানেরা পিতার সম্পত্তির শতভাগ অংশের উত্তরাধিকারী হতে পারে না। পিতার ভাই-ভাইপো’রা সম্পত্তির অধিক অংশের অংশীদার হয়ে যায়। অদ্ভুত বিধানে পিতার সম্পত্তি থেকে কন্যা সন্তানেরা বঞ্চিত হয়ে যায়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীকে সম্পত্তির অধিকারবঞ্চিত করার নানাআইন-বিধান; নারীর প্রতি চরম বৈষম্যপূর্ণ।
হিন্দুসম্প্রদায়ের নারীরা সকল ক্ষেত্রেই ভূ-সম্পত্তি অধিকার বঞ্চিত। তারা পিতা, স্বামী বা সন্তানের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নয়। হিন্দু আইনে নারীকে সম্পূর্ণরূপে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। নারীবিদ্বেষী অমানবিক আইনটি এখন পর্যন্ত কেন রদ হয়নি? সে জিজ্ঞাসা নিশ্চয় রয়েছে। আমাদের দেশের হিন্দুসম্প্রদায়ের মূল নেতৃবৃন্দ পুরুষ এবং সে কারণে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্দয়-অমানবিকতার দৃষ্টান্তস্বরূপ কালো সেই আইনটি টিকে রয়েছে। যারা এই আইন পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালনে সচেষ্ট তারাই আইনটির পক্ষে তাদের জোরালো অবস্থান নিশ্চিত করেছে। ঘৃণিত নারীবিরোধী আইনটি সে-কারণেই বহাল-তবিয়তে রয়েছে।
একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, আমাদের আইনে রয়েছে মৃত স্বামীর মোট সম্পত্তির মাত্র দুই আনার উত্তরাধিকারী জীবিত স্ত্রী হবে। অপরদিকে মৃত স্ত্রীর মোট সম্পত্তির চার আনা জীবিত স্বামী পাবে। এই বৈষম্যপূর্ণ আইনটি ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনে অন্তর্ভুক্ত। বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিক সমাজে অজস্র ঘৃণিত আইনের ন্যায় এটিও নিশ্চয়ই টিকে থাকবে ততদিন; যতদিন সমাজের আমূল পরিবর্তন না ঘটবে।
সম্প্রতি এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের মোট নারীর ৭০ শতাংশের কোনো সম্পত্তি নেই। অর্থাৎ সহায়-সম্বলহীন সিংহভাগ নারী। যারা অন্যের দয়া-অনুগ্রহে সমাজে পরগাছার ন্যায় টিকে রয়েছে। ২৯ শতাংশ নারী উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি লাভ করেছে। এবং অবশিষ্ট ১ শতাংশের সম্পত্তি থাকলেও, নানা কারণে তাদের সম্পত্তি এখন তাদের অধিকারে নেই। পিতার সম্পত্তি থেকে নারীদের বঞ্চিত করার অজস্র ঘটনা-দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে রয়েছে। আইনিক দীর্ঘসূত্রতা এবং আইনের আশ্রয় মামলা-মোকদ্দমায় অধিক অর্থ বিনিয়োগের কারণে বঞ্চিতরা আইনের আশ্রয়ের ধারে-কাছে ভিড়তে পারে না। আমাদের আইন-আদালতগুলোতে সুবিচার পাওয়া নির্ভর করে অর্থ জোগানের ওপর। অর্থের জোরেই সুবিচারনির্ভর। এটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রচলিত ধারণা। যা মোটেও বাস্তববিবর্জিত নয়। আইনি আশ্রয় এবং আদালতে মামলা দায়ের প্রসঙ্গে প্রচলিত প্রবাদটি হচ্ছে- একটি মুরগির জন্য একটি গরু হারানোর শামিল। আইন ব্যবসায়ীদের আশ্বাসে যারা মামলা-মোকদ্দমা করেছে তারা প্রায় প্রত্যেকে অর্থনাশে ফতুর হয়েছে। উকিলদের কথায়-আশ্বাসে মনে হবে দ্রুত সম্পত্তির অধিকার ফিরে পাওয়া যাবে। সহজেই পুনরুদ্ধার হবে বেদখলকৃত সম্পত্তি। অথচ বাস্তবে যুগের পরিসমাপ্তিতেও মামলার নিষ্পত্তি হয় না। অর্থের কারসাজিতে রহস্যজনক ঝুলে থাকে মামলাগুলো রাজা ত্রিশঙ্কুর ন্যায়। মামলার তারিখে আদালতে যাওয়া-আসা এবং উকিলদের ফি দিয়ে-দিয়ে ফতুর হবার দশা। জমি-জমাসংক্রান্ত মামলা সহজে নিষ্পত্তি না হবার সংস্কৃতিতে বঞ্চিতরা সে পথে অগ্রসরে আগ্রহী হয় না এবং আস্থাও রাখে না।
আইন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে যারা নাকাল হয়েছে। একমাত্র সেই সকল ভুক্তভোগীরাই জানে আমাদের দেশে আইন-আদালত কি পরিমাণে বিড়ম্বনাপূর্ণ এবং মামলা পরিচালনা সম্পূর্ণরূপে অর্থ বিনিয়োগের ওপরই নির্ভরশীল। উপনিবেশিক আইন স্বাধীনদেশে অপরিবর্তিত থাকায় মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল আইনের দরজায় মাথা ঠুকেও সাধারণ মানুষ সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয়। বাংলাদেশকে সম্ভব এবং অসম্ভবের দেশ বলা হয়। এখানে সবই সম্ভব-সবই অসম্ভব। অর্থ-বিত্তের এবং রাজনৈতিক প্রভাবে অসম্ভব বলে কিছু নেই। বরং সমস্তই সহজে সম্ভব। তবে সাধারণের জন্য সমস্তই চরমভাবে অসম্ভব।
আমাদের সমাজে পুত্রদেরকেই বংশের প্রকৃত উত্তরাধিকারীরূপে গণ্য করা হয়। বিয়ের পর কন্যা সন্তানেরা পিতার সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভাইদের কর্তৃত্বে থাকা সেই সংসারে কন্যারা অতিথিরূপেই আসা-যাওয়া করে। বৃদ্ধ পিতা-পুত্রদের আশ্রয়ে থাকার কারণে জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে নিজের সম্পত্তি পুত্রদের লিখে দেয়। কন্যাদের বঞ্চিত করে পুত্রদের সম্পত্তি দেবার ঘটনা দেশে সর্বাধিক। পিতার সম্পত্তি এজমালী থাকলেও সেই সম্পত্তির অধিকার কন্যা সন্তানদের পাওয়া দুরূহ। ভাইয়েরা দয়া-পরবশে দিলে পাবে। না দিলে মামলা করে সম্পত্তি আদায় বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থায় সুদূরপরাহত। যে সকল নারীদের স্বামীর অর্থনৈতিক অবস্থা ভাইদের তুলনায় অধিক সমৃদ্ধশালী- একমাত্র তারাই সহজে পৈতৃক সম্পত্তির অংশ অনায়াসে পেয়ে থাকে। নারীর অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতেই পিতৃ সম্পত্তি পাওয়া না-পাওয়া অনেকটা নির্ভর করে। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। সেটা খুবই নগণ্য। নারীর উত্তরাধিকার প্রাপ্তির মূলে অর্থনৈতিক বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। শ্রেণি সমতা প্রতিষ্ঠা ব্যতীত নারীর উত্তরাধিকার সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সংস্কারের মাধ্যমে তো নয়-ই। বিদ্যমান ব্যবস্থাটি অপরিবর্তিত রেখে যে সংস্কারই করা হোক না কেন, সেটা টিকবে না। সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিদ্যমান ব্যবস্থাটির আমূল পরিবর্তন।
আমাদের সমাজ-জীবনে নারীর প্রতি যে সকল বৈষম্যগুলো আমরা নিয়মিত প্রত্যক্ষ করি; তার মূলে অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। তবে নারীর প্রতি বৈষম্যের প্রারম্ভিক সূত্রপাত নারীর জন্ম মুহূর্ত থেকে ঘটে থাকে। কন্যা সন্তান জন্মের পর ভূমিষ্ঠ কন্যার কানে কাউকে না শুনিয়ে চুপি-চুপি (নিশ্চয় লজ্জা-অপমানে) আজান দেওয়া হয়। অথচ পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। উঁচু স্থান থেকে তীব্র চিৎকারে আজান দিয়ে পুত্রলাভের খুশির সংবাদটি সর্বত্র জানান দেয়া হয়। সন্তান জন্মের পর সামর্থ্যবানেরা আকিকা দিয়ে থাকে। পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে দুইটি এবং কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে একটি খাসি জবাই করে আকিকার বিধানকে বৈষম্যহীন-সমতার দৃষ্টান্ত ভাবার মোটেও উপায় নেই। বরং সম্পূর্ণরূপে বৈষম্যপূর্ণ। বংশের উত্তরাধিকারী পুত্রদেরই গণ্য করা হয়। কন্যাদের নয়। মায়েরা নারী হয়েও প্রচলিত ব্যবস্থার শিকার। সে কারণে কন্যা সন্তানদের পুত্র সন্তানের সমকক্ষ বিবেচনা এবং সমমর্যাদা প্রদান করতে পারে না। নগণ্য সংখ্যক পিতা-মাতারা পুত্র-কন্যানির্বিশেষে সন্তানদের সমতার ভিত্তিতে দেখে থাকেন। সমাজের সংখ্যালঘু সুবিধাভোগীদের বিষয় অবশ্য ভিন্ন। এই সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তরা নারী স্বাধীনতার কথা বলে বেড়ায়। এ সমস্ত শ্রেণির নারীরা সকল প্রকার বৈষম্যের ঊর্ধ্বে। তাদের জীবনাচার, দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা সংখ্যাগরিষ্ঠদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এরা নারী স্বাধীনতার জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি করে অথচ প্রত্যেকের গৃহের গৃহকর্মীদের ওপর নির্বিচারে নির্যাতন-নিপীড়নে দ্বিধা-সংকোচ করে না। শ্রেণিবৈষম্যকে ধারণ ও পালনকারী এসকল সুবিধাভোগী শ্রেণির নারীদের পিতা এবং স্বামী উভয়ের উত্তরাধিকার-সম্পত্তি সুরক্ষিত এবং নিশ্চিত। সংখ্যালঘু এই শ্রেণির সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির নারীদের সমস্যা-বৈষম্য আকাশপাতাল ব্যবধানসম। এদের কাছে নারী স্বাধীনতার প্রকৃত বার্তাটি স্বেচ্ছাচারিতা। যেটা তারা নির্বিঘ্নে করে থাকে।
আমাদের বিবাহআইনে বিয়েতে দুজন পুরুষ সাক্ষীর বিষয় সুনির্দিষ্ট করা আছে। দুজন পুরুষ সাক্ষীর স্থলে একজন পুরুষ সাক্ষী পাওয়া গেলে অপর একজন পুরুষ সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে দুজন নারী সাক্ষীর অনুমোদন রয়েছে। তবে যদি একজন পুরুষ সাক্ষীও পাওয়া না যায়, তাহলে শত-হাজার নারী সাক্ষী দিয়েও বিয়ে সম্পন্ন করা যাবে না। মানবসৃষ্টির আদিতে আদম-হাওয়ার বিষয়ে কোরআনে না থাকলেও-বাইবেলে বিস্তৃত রয়েছে। সাপরূপী শয়তানের প্ররোচনায় ইভ-অ্যাডামকে নিষিদ্ধ ফল খেতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেই অপরাধে তাদের স্বর্গচ্যুতি এবং পৃথিবীতে আগমন। ক’মাস পূর্বে এক ওয়াজ মাহফিলে একজন বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ (?) এজন্যে হাওয়াকে (ইভ) সমস্ত দায় প্রদানে তিরস্কার করেছেন। যা পক্ষান্তরে নারীর প্রতি চিরস্থায়ী অবমাননার শামিল। বিয়ের পর নারীমাত্রই নামের পদবি হারায়। বিয়ের পর পিতৃ পদবি-জাত বা বর্ণ পরিবর্তন হিন্দু সম্প্রদায়ে আইনি বিধান। জাতপ্রথার কারণে উচ্চবর্ণের কিংবা নিম্নবর্ণের নারীর পিতৃ পদবি-বর্ণ পরিহার করে স্বামীর পদবি-বর্ণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। মুসলিমসম্প্রদায়ে জাতপ্রথা নেই, নামের পদবি পরিবর্তনের আইনি বিধানও নেই। সমাজে প্রচলিত পিতৃপদবি পাল্টে স্বামীর পদবি গ্রহণ সম্পূর্ণ সংস্কৃতিগত। যেটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অনিবার্য সংস্কৃতিরূপে সমাজ জীবনে বিরাজমান। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারীর প্রতি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে বলেছেনÑ‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিতে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।’
মোগল শাসনামলের সুদীর্ঘ ইতিহাসে মোগল সম্রাজ্ঞীদের নাম-পরিচয় ইত্যাদি জানা গেলেও; মোগল সম্রাটদের কন্যাদের বিষয়ে কিছুই জানা যায় না। একমাত্র সম্রাট শাহজাহানের কন্যা জাহানারা’র বিষয়ে ইতিহাসে কিছু তথ্য রয়েছে। এছাড়া মোগলকন্যাদের প্রসঙ্গে বিন্দুবিসর্গ জানার উপায় নেই। বিষয়টি রহস্যপূর্ণ রূপেই বিবেচনার দাবি রাখে। মোগলদের পূর্বে শাসনকর্তা ছিল সুলতানশাহীরা। সুলতান ইলতুত্মিশ নিজ পুত্রদের তুলনায় কন্যা সুলতানা রাজিয়াকে অধিক যোগ্য বিবেচনায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন। নারীর অধীনে এবং ধর্মীয় অন্ধসংস্কারে রাজন্যবর্গ-সভাসদবৃন্দ সুলতানা রাজিয়াকে শাসকরূপে মেনে নিতে পারেনি। অত্যন্ত সাহসী-প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত সুলতানা রাজিয়া চার বছর শাসনকার্য পরিচালনার পর নিষ্ঠুর হত্যার শিকার হন। এবং নানারাজনৈতিক অশান্তি, প্রাসাদষড়যন্ত্রের পর সুলতানা রাজিয়ার ভাই-ইলতুত্মিশের কনিষ্ঠ পুত্র নাসির উদ্দিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সুলতানা রাজিয়া হত্যা এবং ভ্রাতা নাসির উদ্দিনের ক্ষমতা লাভ কিসের ইঙ্গিত বহন করে?
নানাবিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানবসভ্যতার বিকাশ। আদিমযুগ, দাসযুগ, সামন্তযুগ, পুঁজিবাদীযুগ, সমাজতান্ত্রিক যুগ একে-একে এসেছে। আদিম সাম্যবাদী যুগে নারী-পুরুষের সম-মর্যাদা ও সম-অধিকার ছিল। যা দাস যুগে পরিসমাপ্তি ঘটে। আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী কেবল সন্তান ধারণ ও জন্ম দিত না। খাদ্য সংগ্রহ-শিকারসহ সকল কর্মকা-েও যুক্ত ছিল। পরিবার-সমাজ নিয়ন্ত্রণেও নারীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনুপ্রবেশেÑ ব্যক্তিকেন্দ্রিক সম্পত্তির লোভে-মোহে দাস এবং সামন্তযুগে নারীও পুরুষের সম্পদে পরিণত হয়েছিল, অপরাপর বঞ্চিত-দুর্বল মানুষদের ন্যায়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফা মাত্রই পণ্যনির্ভর। নারীও এর ব্যতিক্রম নয়। নারীকে বিজ্ঞাপনের মডেল করা হয়, ফ্যাশান শো’তে অংশ নিতে হয়। শিল্পীসত্তা বিসর্জন দিয়ে সৃজনশীলতা ত্যাগ করে তারকা হতে হয়। নির্মাতা এবং অর্থের লগ্নিকারকদের ইচ্ছানুযায়ী নামমাত্র বস্ত্র শরীরে রাখতে হয়। অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শনে-নগ্ন হতে হয়। নারীর সুন্দর দেহমাত্রই পণ্য। মুনাফাবাজেরা তা সেল্যুলয়েডে বন্দি করে বাজারজাত করে মুনাফা লাভ করে থাকে। পুঁজিবাদের ভয়ংকর ছবি আমাদের সমাজে জাজ্বল্যমান। পুঁজিবাদ মুনাফানির্ভর কোনো কিছুকে ছাড় দেয় না। পণ্যে পরিণত করে। সংস্কৃতিসহ সকল প্রকার সাংস্কৃতিক উৎসব-বিনোদনে অনুদান-পৃষ্ঠপোষকতার বাতাবরণে পণ্যের বিজ্ঞাপন নিয়ে হাজির হয়। সংস্কৃতিকে পর্যন্ত পুঁজিবাদ করতলগত করেছে, পণ্য প্রচারের হাতিয়াররূপে। দাস বা সামন্তযুগ নারীকে বন্দি করেছিল। পুঁজিবাদ প্রত্যক্ষে বন্দি করেনি। কিন্তু পণ্যের দাসীতে পরিণত করেছে। পুঁজিবাদ নারীকে পণ্যেরও পণ্যে পরিণত করে থাকে। পণ্যের প্রচার-প্রসারেও নারীকে অপরিহার্য পণ্যরূপে গণ্য করে। সমাজে বৈষম্য সৃষ্টিতেই পুঁজিবাদের সামগ্রিক অপতৎপরতা স্পষ্ট। নারী-পুরুষের বৈষম্য সৃষ্টিতে পুঁজিবাদ সর্বাধিক ভূমিকায় অবতীর্ণ। দাস-সামন্ত যুগের ন্যায় পুঁজিবাদেও ন্যায়-অন্যায়ের বিবেচনা নেই। অতীত যুগের ন্যায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়ও নারীর জন্ম অপরাধতুল্য। নারীবৈষম্য, নারী নির্যাতন, নারীর সম্পত্তির অধিকার হরণ সমস্ত অনাচারের নেপথ্যে পুঁজিবাদের ভূমিকা খুবই স্পষ্ট। পুঁজিবাদ উচ্ছেদ-আক্রমণ তাই অতি জরুরি। সাম্রাজ্যবাদের শোষণযন্ত্র পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শিকার দেশ এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।
আমাদের শাসকগোষ্ঠীসমূহ পুঁজিবাদে আস্থাশীল। তাই বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যেই সকল বৈষম্য-নিপীড়ন শিকলের বেষ্টনিতে আটকে রয়েছে। নারীর সম্পত্তির সমঅধিকার; নারীঅধিকারের অন্তর্গত। অসমতা কখনো ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে পারে না। আইন-ধর্মীয় বিধান পরিবর্তনে নারীঅধিকার নিশ্চিত করা যাবে না। প্রচলিত আইনে বহু ইতিবাচক বিধান রয়েছে। আইনের সকল বিধান কি সমাজে পরিপূর্ণরূপে পালিত হয়? হয় না এবং হবার উপায়ও নেই। আইন করে নারীর সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত হবে না। আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক রাষ্ট্রের জনগণ। জনগণ কি মালিকানার জোরে রাষ্ট্রের ওপর ন্যূনতম কর্তৃত্বের অধিকার রাখে? রাখে না। বরং প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের অনাচারে অতিষ্ঠÑবিপন্ন। অথচ এই রাষ্ট্রের মালিকানা সাংবিধানিকভাবে জনগণের। বিষয়টি নিশ্চয় হাস্যকর, কৌতুকপূর্ণ এবং উপহাসতুল্য। সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। যা সংস্কারে মোটেও সম্ভব নয়। একমাত্র সমাজ পরিবর্তনেই সম্ভবপর। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমঅধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠার মূলে সমাজবিপ্লব। একমাত্র সমাজবিপ্লবেই সকল শোষণ, বৈষম্য, বঞ্চনা, নিপীড়নের অবসান হবে। মুক্তি নিশ্চিত করবে সকল মানুষের।
নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত