শিরদাঁড়া সোজা করে বাঁচতে হলে!
নারীর অধিকার এবং নারীবাদ কথা এখন এত বেশি শোনা যায় যে, অনেকেই মনে করেন, এটা দিন-দিন বাক্যবাগিস পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ব্রিটেনের ইয়ং উইমেন ট্রাস্ট চ্যারিটির এক সমীক্ষা দেখা গেছে যে, ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়েসি তরুণীরা নিজেদের সবচাইতে বেশি নারীবাদী ভাবেন। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো, উনিশ শতকের গোড়া থেকে আজ পর্যন্ত যত নারীর অধিকার এবং নারীবাদী আন্দোলন হয়েছে তার সবচাইতে বেশি সুফল পেয়েছে মানবসভ্যতা। সেই সভ্যতা নারী ও পুরুষ উভয়ের।
সম্প্রতি মিস ইউনিভার্স খেতাব কৃষ্ণাঙ্গ সুন্দরী অর্জন করেছেন জোজিবিনি টুনজি। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কন্যাশিশুদের জন্য কোন বিষয়টি তিনি প্রশিক্ষণের জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার এই সুন্দরী বলেন, ‘নেতৃত্ব দিতে। এমন নয় যে নারীরা নেতৃত্ব দিতে চান না। কিন্তু সমাজ আমাদের জন্য প্রতিকূল ব্যবস্থা করে করেছে। সে-কারণেই বাচ্চা মেয়েদের শেখানো দরকার, কীভাবে সমাজে জায়গা তৈরি করতে হয়।’
টাইম ম্যাগাজিনে এবার ‘পার্সন অফ দ্য ইয়ার’ হয়েছেন সুইডেনের কিশোরী পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। এই মেয়েটি একা চোখে আঙুল দিয়ে পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে জোরে কণ্ঠ ছোঁড়া যায় জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা নিয়ে। এদিকে মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সে ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সানা ম্যারিন। ফিনল্যান্ডে তো বটেই, গোটা বিশ্বের নিরিখে কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নজির গড়েছেন তিনি।
আশ্চর্য তথ্য হলো, ম্যারিন উঠে এসেছেন শ্রমিক পরিবার থেকে এবং তিনি তাদের বংশের প্রথম গ্রাজুয়েট। অর্থাৎ নারীদের শিক্ষায় সিক্ত করলে সেই শিক্ষার সর্বোচ্চ সুফল উঠে আসতে পারে যে-কোনো পর্যায় থেকে। ইতিমধ্যেই নিউজিল্যান্ডের নারী প্রধানমন্ত্রী অনূর্ধ্ব-৪০ জেসিন্ডা আর্ডের্নের সঙ্গে তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছে ম্যারিনের। জেসিন্ডার মতো তিনিও সদ্য মা হয়েছেন। ঘর সামলেই দেশ সামলাচ্ছেন তারা। আরো একটি বিশেষ দিক হলো, ফিনল্যান্ডে এই মুহূর্তে যে-পাঁচটি দলের জোট সরকার, তার সব ক’টির নেতৃত্বেই রয়েছেন মেয়েরা।
বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে বাংলাদেশের নারীরাও এগিয়ে চলছে। হতে পারে সেই চলাটা এখনো ভীষণ মন্থর, কিন্তু গতিটা বহাল আছে। লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকসের সাবেক শিক্ষক জঁ দ্রেজ বলেছেন, ভারতের তুলনায় যেসব সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে তার বেশির ভাগই নারীকেন্দ্রিক বা নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলেই সম্ভব হয়েছে। ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। অর্থনীতিতে নারীর আজকের এই অবদানের নেপথ্যে রয়েছে মুক্তিসংগ্রামে নিবেদিত ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম। এই বিজয়ের মাসটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় নজরুলের অমোঘ বাণী- ‘বল বীর বল উন্নত মম শির’। শিরদাঁড়াকে সোজা রেখে আমরা যাতে এই উন্নত শির ধরে রাখতে পারি, তার জন্য সবার আগে প্রয়োজন নারীর মানবিক অধিকারের পথের কাঁটার অপনয়ন করা। আমরা সবাই যেন উন্নত শিরে বাঁচি, অন্যকে বাঁচতেও সহায়তা করি।