সন্তানের অভিভাবক নন – মা!
সন্তানের জন্মদান থেকে শুরু করে লালন-পালন আর তার সবরকম চাহিদা পূরণে একজন মা তথা নারীর অবদানের কোনো তুলনা হয় না। বলা যায়, সন্তানের ক্ষেত্রে পুরো অবদানটাই মায়ের থাকে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে ওই সন্তানের আসল অভিভাবক কে! বাবা না মা? সামাজিকভাবে বাবাকেই সন্তানের অভিভাবক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে সেসময় মায়ের সন্তান ধারণ, জন্মদান আর লালন-পালনের থেকেও বড় হয়ে ওঠে বাবার অধিকারবোধ দখলদারিত্ব।
এখন দেখা যাক, দেশের প্রচলিত আইন কি বলে। অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০ অনুসারে, ১৮ বছরের কম বয়সী সন্তানকে নাবালক হিসেবে বিবেচনা করা হবে। আর ওই সন্তানের অভিভাবক হলেন তিনি, যিনি ওই সন্তানের শরীর কিংবা সম্পত্তি অথবা উভয়ের তত্ত্বাবধান ও ভরণপোষণে আইনগতভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। এই আইন অনুসারে, সন্তানের অভিভাবক তার বাব। তবে বাবার অনুপস্থিতিতে মা সন্তানের অভিভাবক হতে পারেন। এছাড়াও আদালতে অবেদন করে একজন ব্যক্তি কোনো নাবালক সন্তানের অভিভাবক হতে পারবেন।
আবার দেশের প্রচলিত অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০ এর ১৯ নম্বর ধারা অনুসারে যদি বাবা চারিত্রিকভাবে অসৎ হোন, মাদকাসক্ত হোন কিংবা স্ত্রী অথবা সন্তানের উপর নিষ্ঠুর আচরণ করেন অথবা নিঃস্ব হোন অথবা পুনরায় বিয়ে করেন বা নাবালক সন্তানের ভরণপোষণ না দেন, তাহলে তিনি পিতা হিসেবে অযোগ্য হতে পারেন। ফলে স্বামী সন্তানকে নিজ বাড়িতে আটকে রেখে স্ত্রীকে বের করে দিলেও নাবালক এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক হলেও সন্তানের অভিভাবকত্ব মাকে দিতে পারে আদালত।
এদিকে মুসলিম আইন অনুযায়ী, সন্তানের সার্বিক মঙ্গলের কথা চিন্তা করে একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সন্তানের অভিভাবকত্ব তার মাকে দেওয়া হয়েছে। ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে এই বয়স ৭ আর মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে তার বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত। নাবালক সন্তান যার মা কিংবা যার কাছেই থাকুক না কেন, সন্তানের সার্বিক খোঁজ-খবর, ভরণপোষণ ইত্যাদির দায়িত্ব কিন্তু বাবারই। তবে সন্তান মায়ের কাছে থাকার সময় বাবা যদি তার কোনো ভরণপোষণ না দেন, তাহলে মা তার সন্তানকে বাবার সঙ্গে দেখা করাতে বাধ্য নন। (১২ ডিএলার ১৩৪)
অর্থাৎ বাবাকে সন্তানের অভিভাবকত্ব দেওয়া নিয়ে কোনো সমস্যাই নেই কোনো আইনে। তবে কোনো কারণে মা সন্তানের অভিভাবকত্ব নিতে চাইলে তাকে প্রচলিত আইনের মাধ্যমে আদালত থেকে অনুমতি নিতে হবেই। এই দুই আইন ছাড়াও, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ অনুসারে, অগ্রগণ্যতার ক্রম অনুসারে বাবা, বাবার নিয়োগ দেওয়া কোনো ব্যক্তি, বাবার বাবা অর্থাৎ দাদা, দাদার নিয়োগ দেওয়া কোনো ব্যক্তি একজন নাবালকের সম্পত্তির অভিভাবক হওয়ার অধিকারী।
হিন্দু আইনেও নাবালক সন্তানের প্রকৃত ও স্বাভাবিক অভিভাবক তার বাবা। এমনকি বাবা উইল করে কাউকে অভিভাবকত্ব দিলে ওই ব্যক্তি মায়ের চেয়েও অগ্রাধিকার পাবেন। মা শুধু অবৈধ সন্তানের স্বাভাবিক অভিভাবক। তবে তার বাবা পরিচয় পাওয়া গেলে সেই অভিভাবক হিসেবে অগ্রাধিকার পাবে।
খ্রিষ্টান আইনেও নাবালক সন্তানের স্বাভাবিক অভিভাবক তার বাবা। তবে কোনো কারণে সন্তানের অভিভাবকত্বের দাবি উঠলে আদালত এর সিদ্ধান্ত জানাবে। অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০ অনুসারে, বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে আদালত সন্তানের অভিভাবক নির্ধারণ করবে। সন্তানের মঙ্গলের কথা বিবেচনা করে মাকে তার দায়িত্ব দেওয়া হলে মা-ই হবেন অভিভাবক। মায়ের ধর্ম আলাদা হলেও সন্তানকে বাবার ধর্মবিশ্বাসে লালন-পালন করতে হবে। আর মাও যদি অযোগ্য প্রমাণিত হন, তাহলে সন্তানের অভিভাবকত্ব পাবেন বাবার বাবা অর্থাৎ দাদা।
তাই বলাই যায়, সন্তান ধারণ, জন্মদান আর বুকে আঁকড়ে ধরে লালন-পালনের পরও তার স্বাভাবিক অভিভাবকের জায়গাতেই চরম বৈষম্যের শিকার একজন মা। এতকিছুর পরও স্বাভাবিক অভিভাবক তিনি নন। বাবা অযোগ্য কিংবা তার অনুপস্থিতিতেই শুধু মা অভিভাবক হতে পারবেন। তবে এর জন্যও তাকে নিজ সন্তানের অধিকার বুঝে নিতে হবে আদালত থেকে।