বাড়ছে অর্জন, কমছে না নির্যাতন
যখন মাহজাবিনরা নিজের কর্মগুণে নাসায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করে তখন ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতদের পুড়িয়ে মারা হয়। পুরুষের সাথে সমানতালে নারীরা তাদের কর্মদক্ষতায় এগিয়ে থাকলেও এখনো পুরুষের নারীকে বশীভূত রাখার অসুস্থ মানসিকতার নির্মূল ঘটেনি। খুন, গুম, অপহরণ, উক্ত্যত্তকরণ, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন ধর্ষণ প্রভূতি নারীদের জীবনযাত্রা বিভীষিকাপূর্ণ করে তুলেছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, চাকরি, সাংবাদিকতা, কৃষি, এমন কি নারীর ক্ষমতায়নসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে নারীর অগ্রগতি এগিয়ে চলা দৃশ্যমান। নারীনির্যাতন, হত্যা, খুন, ধর্ষণ বন্ধকল্পে নারীর পথচলা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশের নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষা, মেধা, দক্ষতা ও কর্মের দ্বারা দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, গণমাধ্যম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ব্যাংক-বিমা, করপোরেট হাউস কিংবা অনলাইন ব্যবসা সর্বত্রই নিজেদের সরব উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন বাংলাদেশের নারী। ধাপে ধাপে বাধা অতিক্রম করে প্রতিবছর উন্নয়নসূচককে এগিয়ে নিচ্ছেন তারা। আর তাই নারীর অগ্রগামিতা নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা সূচক। এক কথায় দেশের অর্থনীতিতে নারীর অবদান এখন বিশ্বের বিস্ময়। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর (বিবিএস) জাতীয় পর্যায়ে ১২ হাজার ৫৩০ জন নারী নিয়ে একটি জরিপ চালিয়ে নারী নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছে। তাতে দেখা গেছে স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৬৫ শতাংশ নারী, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশমানসিক এবং ৫৩ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার স্বীকৃতি মিলেছে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় তাদের ‘দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৫-২০১৭’। এতে রাষ্ট্রক্ষমতায় নারীর অবস্থান বিবেচনায় প্রথম, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ সূচকে নবম এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অষ্টম স্থানে এসেছে বাংলাদেশের নাম। জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৭তম।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে রয়েছেন ৯জন নারী। জেলা প্রশাসকের দায়িত্বও পালন করছেন ৯ নারী। এছাড়া অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব, উপসচিব, ইউএনও, এডিসি, এসি ল্যান্ড পদেও রয়েছে নারীর সরব উপস্থিতি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ থেকে জানা যায়, ২০১০ সালে পরিবারভিত্তিক বিনাবেতনে কাজ করত ৯১লাখ নারী। সেটি এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৮৪ লাখে। জরিপের তথ্য বলছে, দেশে এখন কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ছয় কোটি ১৪ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ চার কোটি ৩১ লাখ আর নারী এক কোটি ৮৩ লাখ। বিবিএসের অর্থনৈতিক এক জরিপ বলছে, গেল এক দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে নারীদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। নারীপ্রধানের নেতৃত্বে চলছে ৫ লাখ ৬৩ হাজার ৩৬৮টি প্রতিষ্ঠান, যা মোট প্রতিষ্ঠানের ৭ শতাংশ।
শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে প্রতিনিয়তই। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে প্রাথমিকে মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৫১ শতাংশ, মাধ্যমিকে ৫৪ শতাংশের বেশি ছাত্রী। এসএসসি পর্যায়ে ছাত্রীর অংশগ্রহণের হার ৪৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। কয়েক বছর ধরে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি), জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি পরীক্ষার পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, অংশগ্রহণেই শুধু নয়, সফলতায়ও নারীর হার বেশি।
আইসিটির ক্ষেত্রেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা বিষয়ক এক গবেষণায় দেখা যায়, আইসিটির ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৩৪ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই হার বাড়িয়ে ৮২ শতাংশে উন্নীত করা গেলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরো ১ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হতো। এতে সরকারের ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা আরো সহজ হতো।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত পোশাকশিল্পে পাঁচ হাজারেরও বেশি কারখানায় কাজ করছে ১৫ লাখ শ্রমিক। যার ৮৫ শতাংশ নারী।
এত অগ্রগতির পরও নারীর এগিয়ে চলার পথ আজও মসৃণ হয়নি। দেশি-বিদেশি নানাগবেষণায় সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে, নারীনির্যাতন রোধে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন, নাগরিক সমাজের নানাউদ্যোগ ও সরকারের প্রচেষ্টা সবই মাঠে মারা যাচ্ছে। নারীনির্যাতনের ধারাবাহিকতা সব অর্জনকেই ম্লান করে দেয়। আর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা প্রতিনিয়ত নারীর এগিয়ে চলার পথকে রুদ্ধ করছে। তারা বলছেন, চাকরির পাশাপাশি সংসারের কাজের বোঝাও নারীকে একাই ঠেলতে হচ্ছে, যা নারীর স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিবিএসের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শ্রমশক্তি জরিপেও এই চিত্র উঠে এসেছে। জরিপ অনুযায়ী, কর্মজীবী পুরুষের তুলনায় কর্মজীবী নারী তিনগুণ বেশি কাজ করেন। ওই জরিপে চাকরিজীবী নারীর ঘরের কাজকে ‘ডাবল বারডেন’ বলা হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, চাকরি করেন এমন নারীদের শতকরা ৮৬ দশমিক ৬ শতাংশ ক্ষেত্রেই রান্নার কাজ করেন আর চাকরিজীবী পুরুষদের মধ্যে শতকরা তিন শতাংশ রান্না করেন।
বাকি পরিবারে রান্না করে অন্য কেউ। কর্মজীবীর মধ্যে ১০০ জন নারীর মধ্যে কাপড় ধোয়ার কাজ করেন ৮৯জন আর ১২ জন পুরুষ এ-কাজ করেন। ঘর পরিষ্কারসহ বাসার বিভিন্ন জিনিস পরিষ্কারের ৮৮ দশমিক ৪ শতাংশ করে নারী। আর ৭ শতাংশ পুরুষ এ-কাজ করে।
আজ নারী সমাজ অন্ধ অনুকরণ থেকে মুক্ত। সব ধরনের জড়তা, কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন সত্তা ও একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠার নিরন্তন সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এ সংগ্রামে তারা অনেকটাই জয়ী। শিক্ষার আলোই তাদের এই পথ দেখিয়েছে। শিক্ষাই তাদের পৌঁছে দিচ্ছে সাফল্যের সুউচ্চ শিখরে। আজ নারী বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে আপন মহিমায় ভাস্বর। তাই নারী আজ ঘরের কোণে সেকালের মতো বন্দি থেকে অন্ধ অনুকরণ ও বিশ্বাসকে আঁকড়ে না ধরে শিক্ষা তাদের অন্তর-বাহিরকে জাগরিত করেছে। তাই এ কথা আজ বলতে দ্বিধা নেই যে, শিক্ষা ছাড়া নারী সমাজের পরিবর্তন সম্ভপর ছিল না। কারণ শিক্ষা শুধু একটি জাতি গঠনের মূল স্তম্ভই নয়, বরং জাতির বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে জাগ্রত করে। দেশোন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়। যুগে যুগে নারী-পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় দেশ এগিয়ে গেছে সমৃদ্ধির পথে। আজকে আমাদের নারীর অগ্রগতি আমাদের আশান্বিত করে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শুধু পুরুষ নয়, নারীর অগ্রগতি এগিয়ে চলা দৃশ্যমান। এ পথে নারীর নানাবাধাবিপত্তি থাকলেও শিক্ষা চাকরি নারীর ক্ষমতায়নসহ নানাধরনের চ্যালেঞ্জিং পেশায় থেকে দেশ জাতির উন্নতি, অগ্রগতিতে কাজ করে যাচ্ছে।
পরিশেষে বলতে চাই, নারীর নির্যাতন ও সহিংসতা রোধে নারীদের সচেতন হতে হবে। নারীদের নিজ অধিকার আদায়ের জন্য নিজেদের কথা বলতে হবে। নারী নির্যাতনকারী যেই হোক না কেনো তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নারীদের সচেতন হতে হবে প্রকৃত অধিকার প্রসঙ্গে। নারীদেরকে যখনই মানুষ হিসাবে দেখা হবে তখনই নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতা কমে আসবে ।