Skip to content

১২ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | মঙ্গলবার | ২৭শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘যাব বহুদূর’

২০১৭ সালে প্রথম নারী হিসেবে স্কুটি চালিয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উঁচু রাস্তা (বান্দরবানের থানচি থেকে আলিকদম) পাড়ি দেওয়ার গৌরব অর্জন করেন আতিকা রোমা। তখন তিনি একটি জাপানি সংস্থায় গৃহকর্মী শিশুদের নিয়ে এডভোকেসি প্রকল্পে কাজ করতেন। সে-সময় পাবলিক ট্রান্সপোর্টে নারীকে যৌনহয়রানি, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা. এমন খরবগুলো দেশব্যাপী চরম অস্থিরতার সৃষ্টি করে। সে-সময় আতিকা রোমা চ্যালেঞ্জ নিলেন নারীদের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট থেকে নামিয়ে এনে রাস্তায় স্বাধীন চলাচলের ব্যবস্থা করার। তিনি দেখলেন, নারীরা বাইকে স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে। ‘যাব বহুদূর’র যাত্রা শুরু হলো।
চার বছরের চাকরি ছেড়ে নেমে পড়লেন নারীদের স্কুটি চালনোর স্কুল ‘যাবো বহুদূর’র কাজে। নারী অধিকারের সঙ্গে নারীর আত্মবিশ্বাস তৈরিতে স্বাধীন চলাচলের বিকল্প নেই। তিনি নিজে যেহেতু বাইক চালাতে পারেন, ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়াতে পারেন। এই সংখ্যাটা বাড়ানো দরকার। আতিকা যখন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাস্তা পাড়ি দেন, তখন আরো ১৯জন রাইডার ছিল তার দলে। সেখানে তিনিই একমাত্র নারী। তখনই মনে হলো সংখ্যাটা বাড়ানো দরকার। সবখানে নারীপুরুষ যেখানে সমানে সমান কোথাও কোথাও বরং নারীরা পুরুষকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে স্বাধীন চলাচলের ক্ষেত্রে নারীরা কেন পিছিয়ে থাকবে! 

নারীর পথের স্বাধীনতা দেওয়ার কাজটা যে সহজ হবে না, সেটাও তিনি ভেবেছেন। তবু শুরু করে দিলেন। প্রথমে তার পরিচিত নানাবয়সের নারীদের উদ্বুদ্ধ করলেন। কিন্তু জায়গা কোথায় পাবেন? নারীরা মোটর বাইক চালাবেন, নারীরা স্বাধীন চলাচল করবেন, এমন কাজের জন্য কেউ জায়গা দিতে রাজি নন। তিনি বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গেছেন, প্রথমে স€§ত হলেও পরে অদৃশ্য কারণে আর এগোননি তারা। 
নিজের উপর বিশ্বাস হারানোর পাত্র নন আতিকা। তিনি ধৈর্য ধরেছেন। অবশেষে ধানমন্ডি সুলতানা কামাল মহিলা কমপ্লেক্সে আবেদন করে নিজের ইচ্ছের কথা জানালে তারা নামমাত্র ভাড়ায় জায়গাটি ব্যবহারের সুযোগ দেয়। 

প্রথম বছরে পরিকল্পনা ছিল ২৫০জন নারীকে বাইক চালানো শেখানোর। কিন্তু প্রত্যাশার চেয়ে সফলতা বেশি এসেছে। গত একবছরে ‘যাব বহুদূর’-এ ৩৮০জন নারী স্কুটি চালানো শিখে গেছেন। এই নারীরা শুধু ঢাকার নয়, ঢাকার বাইরে থেকে যেমন চট্টগ্রাম, খুলনা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, বরিশালসহ দেশের আরও অনেক জায়গা থেকে শিখতে আসছেন। প্রবাসী নারীরাও দেশে এসে বাইক চালনা শিখছেন। এর মধ্যে কোলকাতা, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, থাইল্যান্ড, নেদারল্যান্ড থেকেও অনেক প্রবাসী নারী কোর্সের সময় মিলিয়ে দেশে আসছেন ও শিখছেন। 
‘যাব বহুদূর’ শুধু স্কুটি চালানো শেখানোর মধ্যে তার দায়িত্ব শেষ করেন না। এটি একটি প্লাটফর্ম। একটি জানালাও। যেখানে দাঁড়িয়ে নারীরা স্বাধীন নিশ্বাস নেয়। তারা নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া নানা হয়রানির কথা, অভিজ্ঞতার কথা বলে থাকেন একে অপরের সাথে। প্রত্যেক শিক্ষার্থী এই নেটওয়ার্কের সদস্য হয়ে যান। তারা যে যেখানেই থাকবেন নারীর স্বাধীন পথ চলায় কাজ করবেন এমন অঙ্গীকারও করেন। 
‘যাব বহুদূর’র আর একটি কাজ গ্রুপ রাইড আয়োজন করা। এটা আতিকা রোমার চমক লাগা স্বপ্ন। যে স্বপ্ন তাকে দীর্ঘরাত ঘুমাতে দেয়নি। উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠেছেন। তিনি অলরেডি গ্রুপ রাইড শুরু করেছেন। দলবেঁধে দীর্ঘপথ ছুটে বেড়িয়েছেন। তিনি এই দলে আরো নারী বাইকার যুক্ত করছেন দিনে দিনে। 

‘যাব বহুদূর’
আতিকা রোমা বলেন, যখন একটা মেয়ে শিখতে আসেন তখন হয়ত তিনি কোনোদিন একটা বাইসাইকেলও ছুঁয়ে দেখেননি। মাত্র ৭দিন পর যখন তিনি স্কুটি চালানো শিখে গেলেন, পরদিন যখন তিনি নিজে বাইক চালিয়ে দেখা করতে সেন্টারে এলেন, একটা সৃষ্টির তৃপ্তি আমার মনে কাজ করে। শান্তি লাগে।
শুরুর দিকে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান স্পন্সর করতে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু আতিকা রোমা বুঝতে পারেন সেই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের নিজের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ‘যাব বহুদূর’ তার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছে। বাধ্য হয়ে রোমা সকল স্পন্সর বাতিল করে দেন। এই সেন্টারে শুধু স্কুটি চালানো শেখানো হয় না। রাস্তার নিয়ম-কানুন ও বাইক চালানোর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহের দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়। 
আতিকা রোমাকে ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকার একজন নারী বাইকার হিসেবে বাংলাদেশের অন্য নারীদের বাইকিংয়ে উৎসাহিত করার জন্য স€§াননা সনদ দিয়েছে এবং ২০১৯ সালে তাকে ডওখ ভবংঃ (ডড়সবহ ওহ খবধফবৎংযরঢ়) বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী নারী হিসেবে পুরস্কৃত করে।
আতিকা বলেন, আমার মা প্রচ- স্বাধীনচেতা ছিলেন। তিনি বাইসাইকেল চালাতে পারতেন। কিন্তু সে-সময় সমাজ তাকে বাধ্য করে বাইসাইকেল চালানো ছাড়তে। তিনি আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে রাখতেন। আমি কিশোরী বয়স থেকে মায়ের প্রশ্রয়ে বাইক চালাতাম। মা বলতেন, নারীর স্বনির্ভরতা মানে, স্বাধীন চলাচল। 

তিনি আরো বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নারীরা বাইক চালনায় অনেক পিছিয়ে। আমাদের দেশের অনেক নারীর হাতেই টাকা আছে, ইচ্ছেও আছে, কেনার সামর্থ আছে, শুধু যেটা নেই সেটা হলো চালানোর দক্ষতা। তারা যখন একজন নারী বাইকারকে ট্রেইনার হিসেবে পান, তখন সহজে শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি শুধু সেই জায়গাটাতেই কাজ করে যাচ্ছি।

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ