বই পড়া এবং দেশের রাজনীতি
পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু বলেছেন, তাঁর জীবনের উত্তম ফসল ফলিয়েছে কারাগারের দিনগুলো। তিনি জেলে বসেই বিশ্বের সেরা বইগুলো পড়েছেন এবং নিজের সেরা লেখাগুলো লিখেছেন। তাঁর ‘হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইটি জেলে বসেই লেখা। জেলে বসে কন্যা ইন্দিরাকে রাজনৈতিক শিক্ষাদানের জন্য যেসব চিঠি লিখেছেন, সেগুলো সংকলিত করেই বিশ্ব-ইতিহাস বইটির প্রকাশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও জেলে বসেই রাজনৈতিক শিক্ষায় আরো শিক্ষিত হন এবং বঙ্গবন্ধু হন। কারাগারে বসে তিনি যেমন রাজনৈতিক বই পড়েছেন, তেমনি নিজের আত্মজীবনীও লিখেছেন। তেমনি লিখেছেন কারাগারের রোজনামচাও। আত্মজীবনীটি অবশ্য অসমাপ্ত রয়ে গেছে।
দুটি বই-ই বর্তমান হাসিনা সরকারের আমলে প্রকাশিত হওয়ার পর বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং দেশের তরুণ প্রজন্মের মনে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর রাজনৈতিক দর্শন জানার জন্য প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। জেলে বসে লেখাপড়া সম্পর্কে দুটি উদাহরণ এ জন্য টানলাম যে ঢাকার একটি দৈনিকে খবর বেরিয়েছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার এক মাস সময় কেটেছে বই ও পত্রিকা পড়ে। কী ধরনের বই জিজ্ঞাসা করা হলে কারা কর্তৃপক্ষের একজন বলেছেন, সবই রাজনৈতিক বই এবং ঢাকার কয়েকটি প্রধান বাংলা দৈনিক। বিএনপি সূত্র বলেছে, তিনি এখন একটু অসুস্থ। বইপত্র পড়েই দিন কাটাচ্ছেন।
এই খবরটা জেনে আমি উৎসাহিত হয়েছি এ জন্য যে রাজনৈতিক নেতারা সাধারণত বইপত্র পড়ার সময় পান না। কারাগারে গেলে তার অখণ্ড অবসরে রাজনৈতিক বইপত্র পড়ে নিজেদের মনন ও মেধা উন্নত করতে পারেন এবং জাতির জন্য সঠিক পথনির্দেশও করতে পারেন। খালেদা জিয়া সম্পর্কে তাঁর অনুসারী মহলে একটা কৌতুক প্রচলিত যে তিনি কেশ চর্চার জন্য যতটা সময় দেন, ততটা বইপত্র পাঠের জন্য দেন না। তাই তাঁর দলের রাজনীতিও বদ্ধ জলাশয়ের মতো। তাতে স্রোত থাকে না।
বাংলাদেশে বিএনপির রাজনীতি অবশ্যই বদ্ধ জলাশয়ের মতো। দলটিতে নিয়মিত লেখাপড়া করেন এমন নেতা কম। তাঁদের মধ্যে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের লেখাপড়া করার অভ্যাস আছে। আন্তর্জাতিক মানের বইপত্রও লিখেছেন। কিন্তু তিনি বইয়ে যা লেখেন এবং রাজনীতিতে যা করেন, তার দুটির মধ্যে এত পার্থক্য যে তাঁর নিজের দলেও কোনো ক্রেডিবিলিটি নেই। অতি সম্প্রতি তাঁর বর্তমান ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর দলের মধ্যেই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে এবং দলের শীর্ষ নেতারাই কোনো রকমে হাঁসফাঁস করে তাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বেগম জিয়ার কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকলে বিদ্যাবুদ্ধিতে ঢু ঢু, দুর্নীতির দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত এবং বিদেশে পলাতক পুত্রকে বেগম জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান না করে হয়তো মওদুদ আহমদকেই করতেন।
লেখাপড়ার ব্যাপারে খালেদা জিয়ারও সীমাবদ্ধতার কথা জেনে সম্ভবত ব্যারিস্টার রফিকুল হক তাঁকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে একখণ্ড সুকান্তের কাব্যসমগ্র দিয়েছিলেন। সেটি পাঠ করা দূরের কথা, পাতা উল্টে দেখার সময়ও ‘দেশনেত্রী’ পেয়েছিলেন বলে জানা যায়নি। যা হোক, এখন কারাজীবনের অখণ্ড অবসরে তিনি যদি বইপত্র নিয়মিত পড়েন এবং তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষাকে ধারালো করেন, তাহলে তা বিএনপির বিভ্রান্ত রাজনীতিতে দিশা ফিরিয়ে আনবে এবং দলটির রাজনৈতিক চরিত্রও বদলাতে পারে।
বইয়ের রাজনৈতিক দর্শন যে অনেক রাজনৈতিক দলের চরিত্র বদলাতে পারে, তার প্রমাণ গত শতকের গোড়ার দিকে অনুশীলন, যুগান্তর পার্টির নেতা ও কর্মীদের আমূল চরিত্র বদল। অনুশীলন ও যুগান্তর দল ছিল সন্ত্রাসী দল। সন্ত্রাস দ্বারা পুলিশ হত্যা, ফাঁড়ি ও অস্ত্রাগার দখল দ্বারা ব্রিটিশ বিতাড়নই ছিল তাদের লক্ষ্য। ব্রিটিশরাজ ক্ষুদিরাম থেকে কানাই দাস প্রমুখ বহু বিপ্লবীকে ফাঁসিতে চড়ান। শত শত বিপ্লবীকে জেলে ঢোকান। কিন্তু বিপ্লবীদের সংখ্যা তাতে কমেনি, বরং বেড়েছে।
এই সমস্যা সমাধানের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত কর্তৃপক্ষ এক অভিনব বুদ্ধির আশ্রয় নেয়। তখন বিশ্বে মার্ক্সবাদের প্রচার বাড়ছে। রাশিয়ায় একটি কমিউনিস্ট বিপ্লবও হয়ে গেছে। তখন পর্যন্ত কমিউনিজম পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে একটা বড় হুমকি নয়, ভারতে সন্ত্রাসবাদের দিক থেকে যুব প্রজন্মের মুখ ফেরাতে ব্রিটিশ সরকার মার্ক্সবাদ-সংক্রান্ত দেদার বই আমদানি করতে শুরু করে এবং জেলে সন্ত্রাসী হিসেবে ধৃত বন্দিদের তা পড়তে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
অল্প দিনের মধ্যেই এর চমৎকার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ব্রিটিশদের আখ্যা দেওয়া সন্ত্রাসীরা (আসলে দেশপ্রেমিক বিপ্লবীরা) দেশ স্বাধীন করা সম্পর্কে সন্ত্রাসবাদ কোনো উপযুক্ত পন্থা নয় বলে ভাবতে শুরু করেন এবং মার্ক্সবাদে দীক্ষা নেন। অবিভক্ত ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা বেশির ভাগ নেতাই ছিলেন সন্ত্রাসী অনুশীলন ও যুগান্তর পার্টির সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা টেররিস্ট পরিচয় ঘুচিয়ে কমিউনিস্ট পরিচয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁদের মধ্যে সন্দীপ বোমা ষড়যন্ত্রের মামলায় আসামি মুজফ্ফর আহমদও ছিলেন একজন। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠাতাদের তিনি ছিলেন পুরোধা একজন এবং পরিচিত হয়েছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহমদ নামে।
সেই প্রাচীন যুগেও ভালো রাজনীতিক হতে হলে কৌটিল্যীয় শাস্ত্র পড়তে হতো। আধুনিক যুগে বহুকাল ইউরোপীয় রাজনীতিকদের অনেকে মেকিয়াভেলির দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন; যদিও অনেকে প্রকাশ্যে তাঁর নিন্দা করতেন। বর্তমান বিশ্বে জটিল রাজনীতির যুগে ছোট-বড় সব রাজনীতিককেই অগ্রসরমাণ রাজনীতির বিকাশের সঙ্গে পরিচিত থাকতে হয়, আপটুডেট থাকতে হয়। না হলে তাঁদের রাজনীতি সফল হতে পারে না।
পঞ্চাশের দশকে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি যখন প্রৌঢ় নেতৃত্বের ভারে পীড়িত, ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী ও নাজিমুদ্দীনের মতো প্রৌঢ় নেতারাই হচ্ছেন দেশের নেতা। তখন রাজনীতি ও রিয়ালিটির মধ্যে একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছিল। তা স্বাধীন দেশের রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর ছিল। আমার সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তার দু-একটি উদাহরণ দিই। গত শতকের চুয়ান্ন সালের দিকের কথা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তোড়জোড় চলছে। যুক্তফ্রন্ট নেতা ফজলুল হকের কে এম দাসের বাসভবনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রচণ্ড ভিড়।
এ সময় ভিয়েতনামে জোর যুদ্ধ চলছে। তখনো আমেরিকা মঞ্চে নামেনি। ঔপনিবেশিক শক্তি ফরাসিদের সঙ্গে হো চি মিনের সৈন্যদের চলছে জোর লড়াই। ঢাকায় খবর এলো ফরাসিদের শেষ ঘাঁটি দিয়েন বিয়েন ফুর পতন ঘটেছে। হো চি মিন-বাহিনী জয়ী। ঢাকায় উল্লাসের ঝড় দেখা দিল। কমিউনিস্ট পার্টি এবং তাদের ছাত্রসংগঠন ঢাকায় বিরাট আনন্দ শোভাযাত্রা বের করেছিল। শোভাযাত্রায় স্লোগান ছিল—‘দিয়েন বিয়েন ফু আমাদের’। শোভাযাত্রাটি যখন হাটখোলা রোড অতিক্রম করছে, তখন তার স্লোগান শুনে হক সাহেব পাশে বসা এক রাজনৈতিক নেতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘বাইরে কী হয়েছে, ওরা এত ফু ফা দিচ্ছে কেন?’ নেতা বললেন, ‘যুদ্ধে ফরাসিদের হার হয়েছে। ওদের শেষ ঘাঁটি দিয়েন বিয়েন ফুর পতন হয়েছে।’ হক সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, সে কি যুদ্ধ (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ) এখনো শেষ হয়নি?
দ্বিতীয় ঘটনা শেরেবাংলা ফজলুল হক তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ঢাকা সফরে এসেছেন। পল্টনের মাঠে তাঁর নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন চলছে। গভর্নরকে সে কথা জানানো হলো। তিনি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, চৌ এন লাই আবার কে? চিয়াং কাইশেকের কী হলো? ১৯৪১ সালে যখন ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে এবং চিয়াং কাইশেক চীনের নেতা হিসেবে কলকাতা সফরে এসেছিলেন। হক সাহেব তাঁর কথাই মনে রেখেছেন।
তৃতীয় গল্পটি আমার শোনা। খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ছিলেন ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী আততায়ীয় গুলিতে নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দীন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। শপথ নেওয়ার পরপরই তিনি ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটা চিঠি পাঠানোর জন্য তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারিকে নির্দেশ দেন।
প্রাইভেট সেক্রেটারি তাঁকে জানান, পাকিস্তান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আর অন্তর্ভুক্ত দেশ নয়। তবে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত একটি দেশ। পাকিস্তান সরকারের ওপর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কোনো এখতিয়ার নেই। নাজিমুদ্দীন তাঁর কথা শুনলেন না। বললেন, ‘তা হোক চিঠিটা তুমি পাঠাও। তিনি আমাকে বড় পছন্দ করেন। আমি তাঁর আন্ডারে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলাম।’ রোনাল্ড রিগান ছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তাঁর সঙ্গে ব্রিটিশ লেবার পার্টির তৎকালীন নেতা লিন কিনোক দেখা করতে গেলে তিনি বলে উঠেছিলেন, ওহ্, আপনাকে চিনি। আপনি তো আমেরিকায় যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত। আমেরিকার আরেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) জানতেন না কিউবা দেশটি কোথায়?
এ রকম আরো উদাহরণ দেখানো যেতে পারে। রাজনৈতিক নেতারা যতই শিক্ষিত হন, আধুনিক বিশ্ব এবং তার জটিল ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যদি অজ্ঞ থাকেন, তাহলে তাঁর রাজনীতি এবং তাঁর দেশের রাজনীতির জন্যও তা ক্ষতিকর। জানা যায়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে রোজ সেদিনের সংবাদপত্র এবং তাঁর প্রয়োজনীয় বইপত্র নিয়ে সকালে অন্তত দুই ঘণ্টার জন্য লেভেটরিতে ঢুকতেন। এ সময় তাঁকে ডিস্টার্ব করা চলত না।
বর্তমান বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের রাজনীতিকদের সম্পর্কে অভিযোগ, তাঁরা বইপত্র পড়ার সময় পান কম এবং তাঁদের মধ্যে এই বইপত্র পড়ার আগ্রহও কম। বাংলাদেশে তো রাজনৈতিক নেতারা নানা ব্যাপারে অন্তত দিনে অর্ধ ডজন বক্তৃতা দেন। তাঁদের অনেকের বক্তৃতাতেই সারবস্তু বলতে কিছু থাকে না। তা শুধু পত্রপত্রিকার শোভা বর্ধন করে। এসব বক্তৃতার অর্ধেকেই থাকে নেতা বা নেত্রীর পাদবন্দনা। বাকি অর্ধেক জনগণকে অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয় উপদেশ, যাতে কোনো সারবস্তু থাকে না।
বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে বইপত্র পড়ার চর্চা বেশি তা বলছি না। ফলে দেশের রাজনীতিতেও চিন্তা ও মননের দৈন্য দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। আমাদের সব দলের নেতাকর্মীরাই যদি বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তাঁদের বইপত্র পড়ার সময়টা একটু বাড়ান, তাহলে ভালো। পবিত্র কোরআনেরও নির্দেশ ‘ইকরা’ অর্থাৎ পাঠ করো। (কালের কণ্ঠের সৌজন্যে)