প্রশ্নপত্র ফাঁসে অভিভাবক ও শিক্ষকদের জড়িয়ে পড়া জাতির জন্য বড় ট্র্যাজেডি
ড. এসএমএ ফায়েজ, শিক্ষাবিদ ও গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্তিকাবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর পিএইচডি করেছেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব আবেরডিন থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং ফেডারেশন অব বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। দেশী-বিদেশী জার্নালে তার একশর অধিক বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস ও এর প্রভাব, প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে করণীয়, শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, গবেষণা, কোটা পদ্ধতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি একটি জনপ্রিয় দৈনিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন ফাঁস এখন মারাত্মক আকার ধারণ করছে। সম্প্রতি শেষ হওয়া এসএসসি পরীক্ষায় প্রায় সব বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এটি আপনি কীভাবে দেখছেন?
পরীক্ষা গ্রহণের যে উদ্দেশ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে সেটা আর থাকে না। কোনো সাবজেক্টের প্রশ্ন যদি ফাঁস হয় এবং সে পরীক্ষা যদি হয়ে থাকে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া নিয়ে যদি এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকে যে, যেমন করে হোক এটি প্রতিহত করা হবে, তাহলে কেন সেটা সম্ভব হয় না, সেটাও বোধগম্য নয়। এতদিন ধরে পরীক্ষা হয়ে আসছে, কোনো দিন এত লার্জ স্কেলে বা বিশাল আকারে ও ঘোষণা দিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। আমাদের ইন্টেলিজেন্স খুবই শক্তিশালী এবং যারা বিভিন্ন পদে রয়েছেন, তাদের দক্ষতা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। তাহলে নিশ্চয়ই কোথাও এমন একটি গ্যাপ রয়েছে, যেটি এখনো আমরা শনাক্ত করতে পারিনি। শনাক্ত করতে কিন্তু এতদিন লাগার কথা নয়, কারণ বহুদিন থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। গত বছরও হয়েছে। এবার তো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এসএসসি পরীক্ষায় প্রায় সব কয়টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। আমি মনে করি, এখনই সময় সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার। দেশবাসীর মধ্যে এ আস্থা নিয়ে আসতে হবে যে, এখন থেকে কোনোক্রমেই আর প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না। এ নিশ্চয়তা প্রদান করা কঠিন কিন্তু কাউকে না কাউকে এটা করতে হবে।
এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?
এটা আমার পক্ষে বলা কঠিন। তবে যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের এ পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনের কারণগুলো শনাক্ত করতেই হবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটতে পারে না। যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের দায়িত্ব হলো, কোনাভাবেই যেন প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয়, তা নিশ্চিত করা। আর ফাঁস হলে কীভাবে হচ্ছে, তা শনাক্ত করা। এ দায়িত্ব আগেই পালন করার কথা ছিল। এখন একটার পর একটা প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, তাও আবার চ্যালেঞ্জ করে, ঘোষণা দিয়ে। আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা যেতে পারে কিন্তু যারা বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তারা তো ফাঁসকারীদের চেয়েও দক্ষ, তাদের কাছেও প্রযুক্তি রয়েছে এটি ধরার জন্য, তাহলে কেন ফাঁসকারীদের ধরতে পারছেন না, তা আমাদের বিস্মিত করছে।
পরীক্ষার আগে ইলেকট্রনিক ডিভাইসে প্রশ্নপত্র পাওয়ার অভিযোগে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এটা কি গ্রহণযোগ্য?
এটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব শিক্ষার্থীর বয়স ১৮ বছরের চেয়ে কম। অপ্রাপ্তবয়স্ক একজন যখন দেখবে প্রশ্নপত্র পাওয়া যাচ্ছে, তখন তার মধ্যে টেম্পটেশন বা প্রলোভন কাজ করবে— সবাই পাচ্ছে, আমি পাব না কেন! এটাই কিন্তু স্বাভাবিক। তাদের গ্রেফতারের বিষয়টি আমাকে রীতিমতো অবাক করেছে। এমন পদক্ষেপ কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমিও একদিন ওই বয়সে ছিলাম, ওই বয়সে প্রলোভন অবশ্যই কাজ করে। যখন প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে, সবার হাতে হাতে ঘুরবে, তখন আমি সেটি দেখব না বা পাওয়ার চেষ্টা করব না— এটি আশা করা ঠিক হবে না।
এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন একটি সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল যে, রাজধানীর একটি স্কুলের কিছু অভিভাবক একটি তহবিল গঠন করেছেন প্রশ্নপত্র কেনার জন্য এবং শিক্ষকদের একটি দল করা হয়েছে, যারা প্রশ্নপত্র সমাধান করে দেবেন…
প্রশ্নপত্র ফাঁসে অভিভাবক ও শিক্ষকদের জড়িয়ে পড়াটা ক্ষমা করা যায় না। ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীরা প্রলোভন দ্বারা তাড়িত হতে পারে, অভিভাবকদের তো প্রলোভন দ্বারা প্রলুব্ধ হওয়ার কথা নয়; শিক্ষকদের তো এটা দ্বারা তাড়িত হওয়ার কথা নয়। এটি বলছে পরিস্থিতি কতটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এমন অভিভাবকদের মনোভাব— যে করে হোক আমার সন্তান ভালো করুক; কিন্তু আমার সন্তান অসৎ উপায়ে ভালো করছে আমার মাধ্যমে। এটি গোটা জাতি ও দেশের জন্য বিরাট দুঃখজনক ঘটনা।
একদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস বাড়ছে, অন্যদিকে নকল করার বিষয়টি ফিরে আসতে শুরু করেছে…
অতীতে আমরা দেখেছি, কোনো একজন ব্যক্তি এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেটি বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন। কথা হলো, আমি যদি ঠিক থাকতে পারি, তাহলে কেন নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারব না যে, অন্যরাও ঠিক থাকবে? অন্যরা ঠিক না থাকলে সেটা আমার দায়িত্ব হয়ে দাঁড়াবে। জবাবদিহিতা ওই পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। আমি এটা করব অথবা আমি এজন্য দায়ী থাকব। অর্থাৎ হয় করব, না-হয় দায় নেব এবং পদত্যাগ করব। আমি যদি ব্যর্থ হই, আমার সঙ্গে কাজ করা অন্যরাও যদি ব্যর্থ হয়, সেটা আমার দায়িত্ব। এক্ষেত্রে উদাহরণ তৈরি হওয়া উচিত। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে আমি দায় নিয়ে পদ থেকে সরে আসব। এর কোনো ব্যত্যয় হতে পারে না।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য পরীক্ষা পদ্ধতি কি কোনোভাবে দায়ী?
সব পদ্ধতির ভালো ও খারাপ দিক রয়েছে। মাথাব্যথা করলে মাথা কেটে ফেলা সমাধান নয়। এমসিকিউ থাকবে না, এ ধরনের কথা বলা হচ্ছে। এ ধরনের পদক্ষেপ কোনো সমাধান। একজন শিক্ষার্থীর মেধাকে যথাযথভাবে বিচার করার জন্য যে ধরনের প্রশ্ন হওয়া দরকার, সে ধরনের প্রশ্ন করতে হবে। এ ধরনের প্রশ্ন করতে গিয়ে ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে বলে সেটা করা হবে না, এমনটা হওয়া উচিত নয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা কেন থাকবে? প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে ফেসবুক বন্ধ করে দেয়া, আধা ঘণ্টা আগে কেন্দ্রে প্রবেশ করানো— এসব পদক্ষেপের মানে হলো, আমি এটিকে মেনে নিচ্ছি, আমার আর অন্য কোনো উপায় নেই এটি থামানোর। এ ধরনের বিকল্প কেন থাকবে? এখানে শুধু একটাই পথ। আর সেটা হলো, প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না।
পরীক্ষা পদ্ধতিতে হঠাৎ করে পরিবর্তন আনা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় বলে পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা কোনো সমাধান নয়। আরেকটি বিষয় হলো, কম বয়সী শিক্ষার্থীদের এত বেশি পরীক্ষা নেয়া ঠিক না। এটার পরিবর্তন হওয়া দরকার। আমাদের সময় প্রথমে মেট্রিক (এসএসসি), এরপর ইন্টারমিডিয়েট (এইচএসসি) ছিল, সেটা ভালো ছিল। এসএসসি, এইচএসসির মতো বোর্ড পরীক্ষার আগে পরিচিতি ঘটানোর জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা টেস্টের মতো করে নেয়া যেতে পারে। এখন সবাই সব পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়ার জন্য দৌড়াচ্ছে। এটি পেতে প্রশ্ন ফাঁস হলে তা পেতে হবে— এমন মনোভাব তৈরি হয়েছে। শিশু শিক্ষার্থীদের জিপিএ ৫-এর পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করতে হবে। শিশুদের ওপর এত বেশি লোড দেয়া ঠিক না।
দেখা যাচ্ছে, একজন শিক্ষার্থী সব বোর্ড পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারছে না বা ইংরেজির মতো বিষয়ে জিপিএ ৫ পাওয়া প্রচুর শিক্ষার্থী ফেল করছে…
প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি ব্যাপার আর যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে কিনা, সেটি আরেকটি বিষয়। পরীক্ষার খাতা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে কিনা, তা দেখতে হবে। কোনোভাবেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না, এটি ধরে নিয়ে একজন শিক্ষার্থী হয়তো বোর্ড পরীক্ষায় ইংরেজিতে ভালো করছে কিন্তু দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করছে, তাহলে বুঝতে হবে অবশ্যই কোনোখানে সমস্যা রয়ে গেছে, যে সমস্যা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। কিছুদিন আগে শুনতাম, পাসের হার বাড়ানোর প্রবণতা কাজ করছে। জানি না, এটা কতটুকু সত্য কিন্তু এটা মানুষ বিশ্বাস করত যে, এ ধরনের একটি বিষয় হচ্ছে। মেধা যথাযথভাবে যাচাই করার জন্য যেভাবে প্রশ্ন হওয়া দরকার, একইভাবে প্রশ্নের মূল্যায়নটাও তেমনভাবে যেন করা হয়। এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হতে হবে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস সমাজের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?
শিক্ষা ব্যবস্থা যদি এভাবে এগোতে থাকে, তবে ভবিষ্যতে একটা অ্যালার্মিং সিনারিও হতে পারে। আমাদের সন্তানরা কিন্তু আমাদের থেকেও মেধাবী। কারণ তাদের জানার অনেক সুযোগ রয়েছে। আমরা কিন্তু এ সুযোগ পাইনি। আমাদের সময় পৃথিবীটা ছিল ইতিহাসের পাতা অথবা ভূগোলের পাতার মধ্যে। এখন তো চোখের সামনে, আঙুলের আগায় সবকিছু। বিশ্বে যেখানেই যা কিছু ঘটুক না কেন, তাত্ক্ষণাৎ জানতে পারছে। এদের মধ্যে সময়ের সঙ্গে ইনহেরেন্ট ট্যালেন্ট গড়ে উঠেছে। তাহলে কেন ভালো ফলাফল ধরে রাখতে পারছে না? এখানে ভালো ফলাফল বলতে ভালো নিদর্শনের কথা বলছি। জিপিএ ৫ পাচ্ছে, অথচ দেখা যাচ্ছে যে, সে কিছুই জানে না। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলব, শিক্ষকতা যারা করছেন, তারা সর্বোত্তম নন। সবচেয়ে মেধাবী যারা, তারা শিক্ষকতা করছেন না। এত কম বেতন দেয়া হয় যে, ভালো শিক্ষক পাওয়া খুবই কঠিন। আমরা যদি দেশের ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, তাহলে প্রত্যন্ত গ্রামেও ভালো বেতন দিয়ে মেধাবী শিক্ষক রেখে দেয়া উচিত। শিক্ষকদের বেতন উচ্চ হওয়া উচিত এবং একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে যে, সবচেয়ে মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসবেন। শিশুদের পড়ানোর জন্য কিছু প্রশিক্ষণের দরকার রয়েছে। নামে নয়, যথাযথ ট্রেনিং নিশ্চিত করা দরকার। পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাব একজন শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলার জন্য সেখানকার শিক্ষকরা কী ধরনের দায়িত্ব পালন করেন। আমাদের এখানে সেটা হয় না এবং আমাদের শিক্ষকরা কোনো রকমে বেঁচে থাকতে পারলে, টিকে থাকতে পারলে যথেষ্ট মনে করেন। কোচিং বা প্রাইভেট পড়ানো ছাড়া শিক্ষকরা জীবনধারণ করতে পারেন না। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার পেছনে আমাদের আর্থিক ও সামাজিক ব্যবস্থা অনেকটা দায়ী। এটি পরিবর্তনের জন্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরো অনেক বাড়াতে হবে। আর এটা করতে হবে দেশের জন্য। দেশ শিক্ষিত হলে এগিয়ে যাবে অনেক দূর। দেশের প্রতিটি নাগরিককে শিক্ষিত করার দায়িত্ব সরকারের। আমাদের এখানে যারা শিক্ষকতা করেন, তারা নিজেদের বিষয় সম্পর্কেই ভালো করে জানেন না, সেখানে ইংরেজি জানেন বলে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তাহলে কী শেখাবেন তারা? একই সঙ্গে অভিভাবকদেরও খুব দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। নিজের সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দিতে হবে। একজন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেতে না-ও পারে কিন্তু দেখা যেতে পারে ভবিষ্যতে সে অনেক উন্নতি লাভ করেছে। আবার সব পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া একজন বাস্তব জীবনে গিয়ে সফল হতে পারছে না। যারা যথাযথভাবে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চাকরি দিচ্ছেন, তারা মেধা যাচাই করার ব্যাপারে খুব সতর্ক। তারা শুধু জিপিএ ৫ দ্বারা তাড়িত হন না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যা হচ্ছে, নিজ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বলতে হয়, সেখানে কিন্তু পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ওই রকম গলদ নেই। এখানে ডিপার্টমেন্টে পাঁচ বছর (চার বছর অনার্স, এক বছর মাস্টার্স) প্রতি পর্যায়ে যাচাই করে একটি পর্যায়ে নিয়ে আসা হয় কিন্তু দেখা যায়, ১০ মিনিটের একটি ইন্টারভিউ নিয়ে ফার্স্ব ক্লাস ফাস্টকে বাদ দিয়ে অনেক নিচ থেকে অন্য একজনকে শিক্ষক হিসেবে নেয়া হচ্ছে। এটিও কিন্তু গুরুতর একটি ব্যাপার। যারা মেধার স্বাক্ষর রাখছেন, তা প্রতিফলিত হচ্ছে তার স্কোরেও। অথচ ১০ বা ১৫ মিনিটের একটি সাক্ষাত্কার নিয়ে শিক্ষক হিসেবে যাচাই করা হচ্ছে। অন্যদিকে জিপিএ ৫ পেলেই যে সে ভালো ছাত্র তা কিন্তু নয়। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে যাচাই করা হয়, সেভাবে বোর্ড পর্যায়ে যাচাই করা হচ্ছে না। এ অর্থে জিপিএ ৫ মানে প্রকৃত জিপিএ ৫ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে অনার্স-মাস্টার্সের রেজাল্টটা এখনো চ্যালেঞ্জের সামনে আসেনি। কিন্তু নিয়োগ পদ্ধতি চ্যালেঞ্জের সামনে এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে…
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বলি। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, তারা কিন্তু বিষয়টি নিয়ে চরম হতাশ। এ অবস্থা তৈরি হলো কেন? শিক্ষক নিয়োগের নামে ভোটার নিয়োগ হচ্ছে বলে মনে হয়। এটা ভেবে আমরা খুব বেশি ব্যথিত হই যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ কী হতে যাচ্ছে? শিক্ষক পদে অনেক কম মেধাবী প্রচুর শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। এসব শিক্ষক অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বহুদিন থাকবেন। তারা কী পড়াবেন? তাদের দ্বারা শিক্ষার্থীদের যাচাই কতটুকু সঠিক হবে? অর্থাৎ অনেক বছর ধরে এ ভার আমাদের বহন করতে হবে। এ থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন। আমরা অনেকে মনে করি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বোধ হয় একেবারে ধ্বংস হওয়ার পথে চলে এসেছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা কীভাবে সম্ভব, তা বের করাও খুব কঠিন। দল-মতের ঊর্ধ্বে গিয়ে কাজ করতে হবে। শিক্ষার্থীর মেধাই একমাত্র বিষয় হওয়া উচিত শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে।
আমরা উন্নয়নশীল দেশ হতে যাচ্ছি। কিন্তু এর সঙ্গে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা কি সামঞ্জস্যপূর্ণ?
আমরা ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলাম বলেই ধারণা ছিল। কিন্তু প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে হঠাৎ করেই হোঁচট খেতে হয়েছে। সরকারের মধ্যে অনেকে রয়েছেন, বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার উন্নতির ব্যাপারে অত্যন্ত সিরিয়াস। আমাদের আরো সিরিয়াস হতে হবে, আরো ইফেকটিভ হতে হবে এবং শিক্ষার মান নিশ্চিতে কোনো ধরনের কম্প্রমাইজ করা চলবে না। যারা এ কাজ করতে পারবেন না, তাদের পদত্যাগ করতে হবে।
আরেকটি অভিযোগ উঠছে যে, গবেষণার প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে…
গবেষণার জন্য যা দরকার তা হলো, গবেষণাসংক্রান্ত সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা। যেমন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স ফ্যাকাল্টির কথা ধরা যাক। এদের গবেষণার জন্য যে যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতে হয়, সেগুলো অনেক দামি। সঠিক রেজাল্ট পাওয়ার জন্য সঠিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতে হবে। দেখতে হবে এগুলো আমরা নিশ্চিত করতে পারছি কিনা। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সেন্টার অব এক্সিলেন্স ফর সায়েন্স রয়েছে। সোস্যাল সায়েন্সের জন্য আরেকটি রয়েছে। সেখানে পুল করে কিছু ইনস্ট্রুমেন্ট বা যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে কিন্তু সবাই সুযোগ পাচ্ছেন না। গবেষণা খাতে ফান্ড অনেক বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে পাবলিকেশন না থাকলে প্রমোশন হবে না, এটা নিশ্চিত করতে হবে। পাবলিকেশন বলতে গ্রহণযোগ্য জার্নালে পাবলিকেশন থাকতে হবে। আর গবেষণার ক্ষেত্রে সমাজের যে চাহিদা, সেটাকে প্রাধান্য দিতে হবে। আমাদের সমাজে গবেষণার জন্য অনেক কিছু রয়েছে। সমাজ আশা করে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসবে। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সমাজের প্রত্যাশা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা করতে পারছে না। সমাজের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জবাবদিহির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তবে সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষক রয়েছেন, যারা থেমে নেই। তারা নিজেদের প্রচেষ্টায় গবেষণা করছেন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহযোগিতা নিয়ে। তবে শিক্ষকরা যদি গবেষণার কাজে নিজেদের তাড়িত না করে অন্য চিন্তায় বেশি ব্যস্ত থাকেন, যেমন— কীভাবে রাজনৈতিক সুবিধা পাব, কী করলে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লাভজনক কোনো জায়গায় যেতে পারব, তাহলে তো তারা শিক্ষক থাকছেন না। আমি যদি যোগ্য ব্যক্তি হয়ে থাকি, পদ আমার পেছনে থাকবে, আমি পদের পেছনে ছুটব না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমরা পদের পেছনে তাড়িত হচ্ছি। যেমন— সেই ব্যক্তির উপাচার্য হওয়া উচিত, যার পদের প্রতি বিন্দুমাত্র মোহ থাকবে না। সেই ব্যক্তির উপাচার্য হওয়া উচিত, যিনি মেধা ছাড়া আর কিছুই বুঝবেন না, চেয়ারের প্রতি সম্মান থাকবে। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা কারো প্রতি সমর্থন থাকতে পারে। তবে যখন ওই চেয়ারে বসবেন, তখন দৃষ্টিতে সবাই সমান হবে এবং মেধাই পাবে একমাত্র প্রাধান্য।
কোটা সংস্কার নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আমি পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলাম ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত। তখন মুক্তিযুদ্ধ কোটায় লোক পাওয়া না গেলে পদগুলো খালি রাখা হতো না, জেনারেল মেরিট থেকে পূরণ করা হতো। পিএসসির কার্যক্রমের পুরো ব্যাপারটি আমাদের প্রেসিডেন্টকে প্রতি বছর জানাতে হতো। একবার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বডি থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল যে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা তাদের সন্তানদের জন্য বাস্তবায়ন করা হোক। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাদের কাছে মতামত চাওয়া হলো। বিষয়টি নিয়ে পুরো কমিশন বৈঠকে বসেছিলাম। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেখানে কয়েকটি বিষয় আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। এর মধ্যে একটি ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন উঠছে। প্রায়ই দেখা যেত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হলেও তার সার্টিফিকেট রয়েছে। আমরা দেখেছি অনেক মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট থাকার পরেও তা নিয়ে কোনো ধরনের বেনিফিট গ্রহণের চিন্তা করেননি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিজে সুবিধা গ্রহণ করছেন আবার তার সন্তানরাও সুবিধা পাবে। অন্যদিকে একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নিজে বঞ্চিত হয়েছেন, তার সন্তানরাও হবে। আরেকটি বিষয় ছিল, কোটার মাধ্যমে একটা স্বাধীন দেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের সবসময়ের জন্য দুই ভাগে বিভক্ত করা কতটুকু সমীচীন হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা ১০০ শতাংশ যুক্তিসঙ্গত। তবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মাধ্যমে, এরপর সন্তানদের সন্তানদের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বংশধরদের বিভক্ত করে ফেলা দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। আরেকটি কথা বলা হয়েছিল, কারো বাবা যদি মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে থাকেন, সেটা তো সন্তানের কোনো দোষ নয়। সন্তান মেধাবী হয়েছে এবং সে তো দেশকে সত্যিকারে ভালোবাসে। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান যতটা ভালোবাসে, সেও ততটা ভালোবাসে— এটা ধরে নিতে হবে। সেখানে তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না বলে সে অনেক মেধাবী হয়েও বঞ্চিত হবে, এটি অ্যাপ্রিশিয়েট করা যায় না। তার তো এখানে কোনো দোষ নেই। সে তো মেধার স্বাক্ষরই রাখতে চেয়েছিল। এমন কিছু বিষয় তুলে ধরেছিলাম আমরা। আমার মনে হয়, এ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ রয়েছে। কোটার বিষয়টি নিয়ে খোলামনে আলোচনা হওয়া উচিত। আমরা এতদিন হলো স্বাধীন হয়েছি, অথচ এখনো আমাদের বংশধররা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্লাকার্ড নিয়ে মিটিং, মিছিল করছে। এর মানে দেশকে আমরা বিভক্তির মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা ছাড়া সবাই তো মুক্তিযুদ্ধে কোনো না কোনোভাবে অবদান রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা ছাড়া সবাই দেশকে দারুণভাবে ভালোবাসে। আরেকটি বিষয় হলো, কোটার মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার পর চাকরিরত অবস্থায় সেখানেও একটি বিভক্তি সৃষ্টির সম্ভাবনা থেকে যায়। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা সন্তানের সন্তান হিসেবে কোটার সুবিধা নিয়ে শ্রদ্ধা ও অহঙ্কারের জায়গা থেকে আমি নিজেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছি কিনা, নিশ্চয়ই তা দেখার সুযোগ রয়ে যাচ্ছে। এগুলোও তো চিন্তা করার কথা। অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা সন্তানের সন্তান রয়েছেন, যারা কোনোভাবেই সুবিধা নিতে চায় না। তারা নিজের যোগ্যতায় উন্নতি করতে চায়। আর নারী কোটার ক্ষেত্রে আমি দেখেছি অনেক নারী এ কোটার সুবিধা নিতে চান না, তারা এত মেধাবী যে, নিজের যোগ্যতায় উঠতে চান। তার পরও অবশ্যই নারীদের জন্য কোটা থাকা উচিত। একটি নিবন্ধে সাবেক এক পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন যে, যেহেতু জনসংখ্যার অর্ধেক নারী এবং কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি এখনো কম, তাই নারীদের জন্য কোটা থাকা উচিত। এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। তবে আমি জোরালোভাবে মনে করি যে, যারা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং যারা মুক্তিযুদ্ধে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন এবং কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের সন্তানদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটায় একটি যথাযথ স্থান থাকার প্রয়োজন রয়েছে। দৈনিক বণিক বার্তার সৌজন্যে)