যশোদা : চিরন্তন মাতৃমূর্তি
সনাতন ধর্মীয় পুরাণ ও ইতিহাস অনুযায়ী যশোদা হলো নন্দ-এর পত্নী ও শ্রীকৃষ্ণর পালক মাতা। ভগবত পুরাণ মতে, কংসের হাত থেকে রক্ষা করতে দেবকীর পুত্র কৃষ্ণকে নন্দ ও তার ধর্মপত্নী যশোদাকে দিয়েছে বসুদেব। দেবকীর সাত পুত্রকে কংস হত্যা করার পর বাসুদেব-দেবকীর অষ্টম পুত্রের জন্ম মাত্র নন্দের স্ত্রী যশোদাকে দেয় বাসুদেব। একইসঙ্গে যশোদার সদ্যোজাত কন্যাকে এনে দেবকীর কাছে রাখে। কারণ দৈববাণীতে কংস জ্ঞাত ছিল যে, দেবকীর অষ্টম পুত্র কংস বধের কারণ হবে। ফলে নিজ সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে যশোদার সাহায্য নেয় বসুদেব।
কংস এই যোগমায়াকে হত্যা করতে গেলে শক্তিরূপিণী যোগমায়া কংসের হাত থেকে মুক্তিলাভ করে অদৃশ্য হয়ে যায়। এবং কংসকে বলে তার হত্যাকারী অন্যত্র প্রতিপালত হচ্ছে। কিন্তু দেবকীর ভাই কংস প্রচণ্ড পরিমাণে প্রজাদের ওপর নিপীড়ন শুরু করে। ফলে মর্ত্যে কৃষ্ণের আগমন ঘটে যেন মর্ত্যবাসী কংস নামক অসুরের হাত থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু দৈববাণীর কারণে দেবকী-বসুদেবেরও নিস্তার মেলেনি। সন্তানের নিশ্চিত মৃত্যু জেনে তাই দেবকী সন্তান কৃষ্ণকে যশোদার কাছে পাঠিয়ে দেয় কংসের অলক্ষ্যেই। মায়ের মমতাকে বির্সজন দিয়ে কল্যাণের দিকে পরিচালিত করেছে নিজেকে। নিজ অত্যাচার সহ্য করে প্রজাদের শান্তি ফেরাতে চেষ্টা করেছে দেবকী। এদিকে দেবকীর বিসর্জন ও যশোদার মায়ের মমত্ববোধ কৃষ্ণকে যশোদা নন্দন হিসেবে বিশ্বে খ্যাতি দিয়েছে। যশোদার মাতৃক্রোড়ে বেড়ে উঠেছে কৃষ্ণ।
যশোদার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন বাল্যলীলার কথা জানা যায়। যার ভেতর শ্রীকৃষ্ণের মাতা যশোদাকে বিশ্বরূপের দর্শন করানোও অন্যতম। মাকে বিশ্বরূপ দর্শন করালেও মায়ের কাছে কৃষ্ণ সমগ্র জগতে সন্তানের মতোই বেড়ে উঠেছে। মায়ের মমতাস্পর্শেই সন্তানসম মর্যাদায় যশোদাকে ভরিয়ে তুলেছে। কিন্তু বাড়তি কোনো ঘটনার অবতারণা করেননি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। কারণ কৃষ্ণের কংস বধ ঘটনা দেখানোর পাশাপাশি তার শৈশবে বেড়ে ওঠার দৃশ্য দেখাতে চেয়েছেন।
বেদব্যাসের মহাভারত-এ,মহাঋষি নারদ কর্তৃক বৃন্দাবন-এ শ্রীকৃষ্ণের দর্শন নিয়ে নানা কাহিনির ব্যাখ্যা আছে।
একটি লীলায়, মাটি খাওয়ার জন্য মাতা যশোদা কৃষ্ণকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন। এই ঘটনা দেখে নারদমুনি বলে উঠেছিলেন, ‘এন্না ঠাবাম্ সাইঢানাই, য়াশোডা’, যার অর্থ ‘যশোদা, আপনি কি তপস্যা করেছিলেন, যে আপনি স্বয়ং নারায়ণকে দণ্ড দেওয়ার, আদর করার, পালন করার শক্তি লাভ করলেন।’ কৃষ্ণ যশোদাকে মুখ খুলে দেখাতেই যশোদা সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে লক্ষ্মীসেবিত বিষ্ণুকে দর্শন করলেন। যশোদা মূর্ছিত হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে তাকে নারদ শ্রীকৃষ্ণের জীবনের সব সত্য তুলে ধরে। এ ধরনের বিভিন্ন বিষয় পুরাণে ভিন্ন ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
আবার অন্যান্য লীলার মধ্যে কৃষ্ণের মাখন চুরি করে খাওয়া, কালীয় নাগ দমন করা, উদুখলে বন্ধনাবস্থায় যমলার্জুন উদ্ধার ইত্যাদি ঘটনায় যশোদার কৃষ্ণের প্রতি বাৎসল্য রসের মহিমা প্রকাশ পেয়েছে। যশোদা নন্দনরূপে কৃষ্ণ জগৎ বিখ্যাত হলেও যশোদা সম্পর্কে সবিস্তারে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন উল্লেখ করেননি। কারণ তিনি মহাভারতের কাহিনিতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে ফোকাস করতে চেয়েছেন। সেখানে কৃষ্ণের বেড়ে ওঠা বা মাতৃমূর্তি যশোদার মমত্বকে বিস্তৃত করতে চাননি। কিন্তু মায়ের শ্রেষ্ঠত্ব সর্বত্র। ফলে যশোদার পরিচয় সে জননী। কৃষ্ণ মাতারূপে অভিহিত হয়ে তিনি চিরন্তন মাতৃমূর্তির প্রতিমা স্বরূপ।
অনন্যা/এআই