কৌশলে কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, দ্রুত বিচার চাই
আধুনিক বিশ্বে যৌনহয়রানি ও ধর্ষণকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে খোদ দাম্পত্য জীবনেও সঙ্গী-সঙ্গিনীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে ধর্ষণের শ্রেণিভুক্ত অপরাধ ভাবা হয়। কোনো কোনো ভূখণ্ডে যৌনহয়রানির অভিযোগকেও গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ধর্ষণ কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতামূলক আচরণের শাস্তি কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। সেখানে আপস কিংবা মধ্যস্থতার কোনো স্থান নেই। কিন্তু উল্টোচিত্র দেখা যায় বাংলাদেশে। করোনা মহামারির প্রভাবে মানুষ গৃহকোণে বন্দি হওয়ার এক মুহূর্তে বুঝতে পারে এই মহামারির সঙ্গেই তাকে আপস করে চলতে হবে। তার নিজের জীবনে ভাঙা-গড়ার খেলা চললেও নারীর জীবনে শুধু গৃহবন্দিই নয়, নিরাপত্তাহীনতার নিগড়ে জড়াতে হয়েছে। এমনকি ঘরের বাইরেও কাউকে বিশ্বাস করার কিংবা আস্থা স্থাপনের সুযোগ নেই বললেই চলে। সংবাদমাধ্যমগুলোতে সেই চিত্রই যেন প্রতিনিয়ত প্রকটিত হচ্ছে।
১০ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছে, ফরিদপুরের ভাঙ্গায় মোবাইলফোন দেওয়ার কথা বলে ডেকে নিয়ে কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ এসেছে। সংবাদ সূত্র থেকে জানা যায়, অভিযুক্ত ধর্ষণকারীদের একজন মেয়েটির প্রেমিক। সম্ভবত দুজনের সম্পর্কে যোগাযোগ একটি বড় সমস্যা। তাই প্রেমিকই বলেছিল তার কাছে থাকা একটি ফোন আছে, যা মেয়েটি নিতে পারে। কিশোরী মেয়েটি প্রেমিকের প্রতি আস্থা রেখেই এক জটিল ফাঁদে পা দিয়ে বসে। এই ফাঁদের জালটুকু বিশ্বাসে মোড়া হলেও তাতে যে এক ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করছে তা যেন আন্দাজই করতে পারেনি। তবে এমন ঘটনা এবারই প্রথম নয়। সম্প্রতি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের হার অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীকে দেওয়া হয়েছে স্বাধীনতা কিন্তু তার বিনিময়ে নিরাপত্তাকে অনেকটাই বিসর্জন দিতে হচ্ছে। যেকোনো রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা-রক্ষায় এমন নিরাপত্তাহীনতা কোনোমতেই কাম্য নয়। কারণ দেশের ভেতর অনিয়ম ও শৃঙ্খলাহীনতার দায় অনেকটাই রাষ্ট্রের কড়া নজরদারির অভাবের ওপর বর্তায়।
সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ধর্ষণ মামলায় প্রায় ৩ শতাংশ অপরাধী সাজা পেয়ে থাকে। অর্থাৎ আইনগতভাবেই ধর্ষকরা উৎসাহ পায়। এই অপরাধে তাদের কঠিন সাজা হবে এই ভয় যেন স্পর্শ করতে পারে না।
উন্নত বিশ্বে নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণের অভিযোগ এমনকি যৌন নিপীড়নের অভিযোগকেও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু আমাদের সামাজিক ও আইনগত প্রতিষ্ঠানের কাঠামো যেন অপরাধীদের সহজেই মুক্তির সুযোগ দিয়ে বসে। অবশ্য আইন সংশ্লিষ্ট বিভাগ নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক হলেও সম্প্রতি একটি প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে, সমাজে ধর্ষণের রোধ সম্ভব হচ্ছেনা কেন? বেআইনি এই ঘটনা ভুক্তভোগী নারীদের নিরাপত্তার শঙ্কায় ঠেলে দিচ্ছে বারবার। মূলত সামাজিকভাবে লোকলজ্জার ভয়েই এমন ঘটনাকে ভুক্তভোগী নারী ও তার পরিবার চেপে যেতে বাধ্য হয়। ফলে অসংখ্য ঘটনাই প্রকাশ হয় না বা বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। আর যদিও বা সম্ভব হয় তাহলে সেই অপরাধ প্রমাণের দায় অভিযুক্ত নারীর ওপর বর্তায়। সেই পদ্ধতিও নারীর জন্যে সুখকর কিছু নয়।
অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবশালীদের দাপটে অনেক অপরাধী প্রশ্রয় পায় বলেই এমন অপরাধ করেও মুক্তি পেয়ে যায়। ফলে ধর্ষকের বিরুদ্ধে যে মামলা সাজানো হয় তা অনেকাংশেই ভালোভাবে খতিয়ে দেখা হয় না। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ধর্ষণ মামলায় প্রায় ৩ শতাংশ অপরাধী সাজা পেয়ে থাকে। অর্থাৎ আইনগতভাবেই ধর্ষকরা উৎসাহ পায়। এই অপরাধে তাদের কঠিন সাজা হবে এই ভয় যেন স্পর্শ করতে পারে না।
ইদানিং ধর্ষণের জন্যে তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহারকে দায়ী করছেন অনেকে। এভাবে ধর্ষণের অপরাধের দায় অনেকটা নারীকেই পুরুষতন্ত্র দোষ দেয়। ন্যায়বিচার পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো নিজের আত্মসম্মান বাঁচিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সংবাদটিই যেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। প্রেমিকের সঙ্গে ফোন নেওয়ার জন্যে মেয়েটি এতদূর গেছে। সারাদিন ছেলেটির সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছে। অথচ একবারও তার সন্দেহ হয়নি সে নিরাপত্তার অভাবে আছে? অথচ এমন যুক্তিকে কি মেয়েটিকে ধর্ষণ করার সাহস পাওয়ার বিষয়টিকে বাদ দেওয়ার অবকাশ আছে? বরং সামাজিকভাবে নৈতিক অবক্ষয়ের বেহাল দশাই যেন স্পষ্ট হয়।
আমাদের সামাজিক ও আইনগত প্রতিষ্ঠানের কাঠামো যেন ধর্ষকদের সহজেই মুক্তির সুযোগ দিয়ে বসে। মূলত সামাজিকভাবে লোকলজ্জার ভয়েই এমন ঘটনাকে ভুক্তভোগী নারী ও তার পরিবার চেপে যেতে বাধ্য হয়। ফলে অসংখ্য ঘটনাই প্রকাশ হয় না বা বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয় না।
নৈতিকভাবে সূক্ষ্ম বোধগুলো জাগ্রত করার বিষয়ে আগেও বহু কথা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহল ও আইন-রক্ষাকারী বাহিনীকেই এগিয়ে আসতে হবে। ধর্ষণ বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের বদলে এ বিষয়ে কড়া নজরদারি ও আইন কার্যকর করার বিষয়ে মনোযোগী হওয়া দরকার। বিশেষত ধর্ষণের অপরাধের প্রমাণপত্রের ফাঁকফোকড়গুলো নিয়ে এখনই নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে।
সম্প্রতি এও দেখা গেছে, প্রশাসন ধর্ষক ও ভুক্তভোগীর মধ্যে আপসরফার দায়িত্ব পালন করছে। মূলত ধর্ষকের নৈতিক অপরাধবোধের স্থান থেকেই ভুক্তভোগীকে আইনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সামনে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন ব্যবস্থা অবশ্য ধর্ষককে সহজেই মুক্তির উপায় বাতলে দেয়। নৈতিক সাজা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে না। তাই ধর্ষণকে ভয়ঙ্কর অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা এবং অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। নয়তো সমাজ এক অন্ধকূপে নিপতিত হবে, যেখানে ধর্ষকের দৌরাত্ম্যে নারীর সম্ভ্রম প্রতিনিয়ত হুমকির মুখেই থাকবে।
অনন্যা/এআই