হিড়িম্বা: পরার্থপর নারীর প্রতিমা
রাক্ষস রাজ হিড়িম্বের বোন অরণ্যচারিণী রাক্ষসী হিড়িম্বা। দুর্যোধনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জতুগৃহ থেকে পলায়ন করে বনের ভেতর পাণ্ডবরা হিড়িম্বের বাসস্থানে উপস্থিত হয়। হিড়িম্ব মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে হিড়িম্বাকে পাঠায় ধরে আনতে। হিড়িম্বাও ভাইয়ের আদেশ পালনে সুন্দরী মানুষের মূর্তি ধারণ করে পাণ্ডবদের আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করে। কিন্তু পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের বাহুবল, রূপ দর্শনে হিড়িম্বা নিজেই বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে পড়ে।
বোনের ফিরতে দেরি দেখে রাক্ষস রাজ হিড়িম্ব সেখানে উপস্থিত হয়। তখন ভীমের সঙ্গে লড়াই বাধে, শেষ পর্যন্ত হিড়িম্ব নিহত হয়। ইতোমধ্যে কুন্তীর সামনে হাজির হয়ে ভীমের প্রতি অনুরাগ ও পতিত্বে বরণ করার বাসনা জানায় হিড়িম্বা। ভীম তখন হিড়িম্বকে বধ করে হিড়িম্বাকেও বধ করতে আসে। কিন্তু যুধিষ্ঠির তখন নারী-হত্যায় বাধা দেয়। কুন্তীর কাছে আশ্রয় নিলে হিড়িম্বার মনের গতিবিধি কুন্তীর কাছে স্পষ্ট হয়।
যুদ্ধের ১৪তম দিনে ঘটোৎকচের পরাক্রম বীরত্ব সহ্য করতে না পেরে কৌরবদের কাতর অনুরোধে অর্জুনবধের জন্য রক্ষিত ইন্দ্রদত্ত বৈজান্তী শক্তি নিক্ষেপে ঘটোৎকচ বধ করে কর্ণ।
ভীমের প্রতি যুধিষ্ঠির তখন নির্দেশ দেয়, ভীম স্নাহ-আহ্নিক শেষ করে হিড়িম্বার সঙ্গে মিলিত হবে এবং সূর্যাস্তের পর পুনরায় ভ্রাতাদের কাছে ফিরে আসবে। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের আদেশে আপত্তি জানায় ভীম। বলে, যতদিন তার পুত্র সন্তান জন্ম না নেয়, ততদিন সে হিড়িম্বার সঙ্গে বসবাস করবে। হিড়িম্বা ও ভীম একসঙ্গে তখন আকাশপথে চলে যায়। ভীমের ঔরসে ও হিড়িম্বার গর্ভে ঘটোৎকচের জন্ম হয়।
রাক্ষসীরা গর্ভবতী হয়েই সদ্য প্রসব করে। তাই হিড়িম্বার পুত্র জন্মানোর পরই যৌবনলাভ করে সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রয়োগে দক্ষ হয়ে ওঠে। ঘট অর্থাৎ হাতীর মাথা, উৎকচ অর্থাৎ কেশশূন্য। হিড়িম্বার এই পুত্রের মাথা হাতীর মতো কেশশূন্য ছিল বলে একে ঘটোৎকচ নাম দেওয়া হয়।
প্রথমদর্শনেই রাক্ষসী হিড়িম্বার সঙ্গে রক্ত-মাংসের মানুষ ভীমের বিবাহ অস্বাভাবিক মনে হতেই পারে। কিন্তু কাহিনি নির্মাণের ক্ষেত্রে লেখক সবসময় কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিল ঘটান। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেবও হিড়িম্বা বা রাক্ষসকূলের কাহিনি নিয়ে এসে মহাভারতের কিছু অলৌকিক কাহিনি সৃষ্টি করেছেন। মহাভারতের যুদ্ধের সময় ঘটৎকচের বিশেষ অবদান পরিলক্ষিত হয়। যুদ্ধের ১৪তম দিনে ঘটোৎকচের পরাক্রম বীরত্ব সহ্য করতে না পেরে কৌরবদের কাতর অনুরোধে অর্জুনবধের জন্য রক্ষিত ইন্দ্রদত্ত বৈজান্তী শক্তি নিক্ষেপে ঘটোৎকচ বধ করে কর্ণ।
কাহিনি নির্মাণে লেখক একের পর এক গল্পের অবতারণা করেছেন। গল্পটির কতটা পূর্ণতা বা প্রাপ্তি পেয়েছে, তা নিয়ে মাথা ঘামাননি। তাই হিড়িম্বা শুধু স্বামীর মঙ্গল কামনায় নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে।
মৃত্যকালে ঘটোৎকচ নিজের দেহ বিশালভাবে বর্ধিত করে কৌরবসৈন্যের ওপর পতিত হয়ে তাদের একাংশ নিষ্পেষিত করে। মহাভারতের যুদ্ধে হিড়িম্বা ও তার পুত্র ঘটোৎকচের অবদান অপরিসীম হওয়া সত্ত্বেও মানবরূপী কোনো জীবন হিড়িম্বার হয়নি। মহা পরাক্রমশালী ভীমের সঙ্গী হয়েও হিড়িম্বা ত্যাগ ও বিসর্জনের মধ্যেই ক্ষান্ত থেকেছে। প্রথমে নিজ সঙ্গীকে হারিয়েছে। পরবর্তীকালে পঞ্চপাণ্ডব রক্ষায় সন্তানকে বিসর্জন দিয়েছে।
তবে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব যে শুধু যেকোনো মূল্য মহাভারতের যুদ্ধে পাণ্ডব বিজয় সুনিশ্চিত করার সব কৌশল অবলম্বন করেছেন, তা বোঝায় যায়। জতুগৃহ থেকে পলায়ন করে পাণ্ডবরা রক্ষা পেতে হিড়িম্বাকে ভীমের পত্নীর স্বীকৃতি দিয়েছে। সন্তান উৎপাদন করেছে। কিন্তু পাণ্ডব রাক্ষস রাণীকে সঙ্গে নেয়নি। আবার রাণীর মর্যাদা দিয়ে তাকে সঠিক সম্মানে সম্মানিতও করেনি। এখানে জতুগৃহ থেকে পাণ্ডবদের রক্ষা এবং মহাভারতের যুদ্ধে পাণ্ডবদের বিজয় নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই বীজ বপণ করেছেন ব্যাসদেব। অথচ হিড়িম্বার মর্যাদা কোথাও পরিপূর্ণ হয়নি। চরিত্রটির বিস্তারেও লেখকের উদাসীনতা লক্ষণীয়। যেন বিসর্জনের উদ্দেশ্যেই হিড়িম্বা চরিত্রটি নির্মিত।
হিড়িম্বা রাক্ষসী হলেও সন্তানকে জন্ম দিয়েছে কিন্তু সন্তানের মঙ্গল কামনা করে মহাভারতের যুদ্ধ থেকে তাকে বিরত রাখেনি। বরং পাণ্ডবদের জয় নিশ্চিত করতে যা করা দরকার, ঘটোৎকচ করেছে। কিন্তু ঘটোৎকচের প্রতি যেমন হিড়িম্বার মনের দশা কী, সেটার ব্যাখ্যা দেওয়ার কোনোই প্রয়োজনবোধ করেননি লেখক, তেমনই সন্তানের নিহত হওয়ার ঘটনায় ভীমেরও স্তম্ভিত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। কাহিনি নির্মাণে লেখক একের পর এক গল্পের অবতারণা করেছেন। গল্পটির কতটা পূর্ণতা বা প্রাপ্তি পেয়েছে, তা নিয়ে মাথা ঘামাননি। তাই হিড়িম্বা শুধু স্বামীর মঙ্গল কামনায় নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। আবহমান বাঙালি নারীর রূপ যেন পরিপূর্ণতা পেয়েছে হিড়িম্বার বিসর্জনের মধ্যে নিহিত।
অনন্যা/এসএএস