সব দোষ কেন বউয়ের
আমাদের নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই ‘বিয়েভীতি’ বলে একটা বিষয় কাজ করে। এই বিয়ে নিয়ে ভয়ের প্রধান কারণ হলো বিয়ের পর নানান সাংসারিক জটিলতা৷ বিয়ের পর সংসারে অশান্তি হবে এটা একদম নিশ্চিতভাবেই ধরে নেন অনেকে। তবে সব অশান্তির মূলে দায়ী করা হয় ঘরের বউকে। পান থেকে চুন খসলেও তার দিকে আঙুল তোলা যেন যুগ যুগ ধরে ট্রেন্ড হয়ে আছে।
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ছেলের বউয়ের কাছে একগাদা আবদার থাকে। বিয়ের আগে থেকেই যেন লিস্ট করে বসে থাকে বর ও তার পরিবারের লোকজন। তাইতো মেয়ে দেখার সময় তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেন তাদের সব চাহিদা এই মেয়ে পূরণ করতে পারবে কি না। এরপর বিয়ের পর শুরু হয় বউয়ের ওপর সব চাহিদা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। বিয়ের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারীর জীবন কাটে শশুর বাড়ির লোকেদের চাহিদা পূরণ করতে করতে। এক্ষেত্রে বহু নারী নিজেদের পরিচয়, সুখ, স্বাস্থ্য সব জলাঞ্জলি দিয়ে বসেন।
নারীদের কখনো মেটাতে হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের নতুন নতুন খাবারের আবদার, কখনো বাচ্চার গল্প শোনার আবদার, কখনো বাচ্চাদের এলোমেলো করা ঘর গোছানো, আবার বাচ্চাকে পড়তে বসানোর ঝামেলাও নেহাত কম নয়। মা হয়ে যেমন সামলাতে হয় ছেলেমেয়ের আবদার, আবার মেয়ে হয়ে বাবা-মায়ের আবদার আবার কখনো স্ত্রী হিসেবে স্বামীর, বৌমা হিসেবে শ্বশুর-শাশুড়ির আবদার। এত কিছুর ভিড়ে ঠিক নিজের যত্ন আর নেওয়া হয় না।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/08/4-3-1024x576.jpg)
আবার অন্যদিকে যারা কর্মজীবী নারী আছেন তাদের দিন কাটে আরও বেশি ব্যস্ততায়। সারাদিন কর্মস্থলে সময় কাটানোয় পরিবারের সদস্যদের সেভাবে সময় দিতে পারেন না অনেকে। তাই অবসর সময়ে সবার প্রতি দায়িত্বটাও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। স্বাভাবিক সময়ে কর্মজীবী নারীদের চলতে হয় ঘরে-বাইরে সমান তালে তাল মিলিয়ে। প্রতিদিন ঘুম ভাঙে নতুন এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে। ছুটির দিনগুলোতে সাধারণত পুরুষরা আরাম আয়েশ করে কাটালেও কর্মজীবী নারীদের একইভাবে দিন কাটে।
কিন্তু এতসব দায়িত্ব সামলানোর পরও কথায় কথায় আঙুল তোলা হয় বউয়ের দিকে। সকালে নাস্তা ঠিকসময়ে তৈরি না হলে ঘরের বউয়ের দোষ, রান্নায় লবণ বেশি বা কম হলে বউয়ের দোষ, বাচ্চা পরীক্ষায় খারাপ ফল করলে বউয়ের দোষ, এমনকি স্বামীর কোনো খারাপ কাজের দায়ও গিয়ে পরে বউয়ের ঘাড়ে। তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া একগুচ্ছ চাহিদার কোনো একটা পূরণে খামতি থাকলে তুলোধুনো করতে ছাড়েন না পরিবারের কেউ। এমনকি সেই নারীর বাবা-মা, পরিবারের লোকজনও তাকে শেখায় মানিয়ে নিতে। কারণ, সমাজ মনে করে বিয়ের পর এই চাহিদা-গুলো পূরণ করাই নারীর জীবনের লক্ষ্য।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/08/1-19-1024x576.jpg)
তবে যে আজ গৃহবধূ হিসেবে কথায় কথায় হেনস্তার শিকার হোন, একদিন সে নিজেও শাশুড়ি হিসেবে গৃহবধূর পায়ে পায়ে দোষ ধরবেন। কারণ, যুগের পর যুগ সমাজে যেভাবে এসব নিয়মনীতি শেকড় গেড়ে বসেছে তা অস্বীকার করার মতো মানসিকতা খুব কম মানুষেরই তৈরি হয়েছে। প্রগতিশীল চিন্তার কিছু মানুষ পরিবর্তন নিয়ে ভাবছে সত্যি, তবে তার অগ্রগতি খুব একটা চোখে পরার মতো নয়। এ সমস্যা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের। নারীর ঘরের কাজগুলোকে সমাজ ঠিক কাজ মনে করতে রাজি নয়।
গৃহবধূকে কথায় কথায় হেনস্তা করা কমাতে হলে তার ওপর থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত চাহিদাগুলো কমাতে হবে। সবার আগে সমাজ ও পরিবারের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। নারীকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সমাজে নারীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। নারী পুরুষের বৈষম্য দূর করতে হবে। সর্বোপরি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করলেই হয়তো বা আশার আলো দেখা যেতে পারে।
অনন্যা/এসএএস