অসম বয়সের বিয়ে নিয়ে এত ট্রল কেন
দেশজুড়ে প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু ঘটছে, যা মুহূর্তেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসছে। এরপর সে ঘটনা নিয়ে শুরু হয় চুলচেরা বিশ্লেষণ, কখনো কখনো বিকৃত মন্তব্য, কখনো বা ট্রল। বিশ্লেষকের ভূমিকায় সাধারণ মানুষ আর তাদের বিকৃত বিশ্লেষণ তুলে ধরার মাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়া। কিন্তু কোন বিষয়ে বিশ্লেষণের এখতিয়ার তাদের আছে আর কোন বিষয়ে নেই, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই তথাকথিত বিশ্লেষকদের। যেমন, গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি অসম বয়সের বিয়ের খবর।
এক কলেজ শিক্ষিকার সঙ্গে অন্য এক কলেজছাত্রের বিয়ের খবর এখন দেশজুড়ে আলোচনায়। মামুন হোসেন নামের সেই কলেজ ছাত্রের বয়স ২২ বছর। কলেজ শিক্ষিকা খাইরুন নাহারের বয়স ৪০। তাদের মধ্যে বয়সের একটি বিশাল ব্যবধান রয়েছে। তবে তারা স্বেচ্ছায় একে অন্যকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। বছরখানেক আগে ফেসবুকে পরিচয় হয় তাদের। এরপর তাদের সম্পর্ক গড়ায় প্রেমে। সেই প্রেম পূর্ণতা পায় বিয়েতে। ছয় মাস আগে গোপনে বিয়ে করেন তারা। সম্প্রতি তাদের বিয়ের বিষয়টি এলাকায় আলোচনায় আসে। সেই সঙ্গে ভাইরাল হয় ফেসবুকে। বিয়ের বিষয়টি তারা মিডিয়ার সামনেও জানিয়েছেন।
তবে ফেসবুকে বিয়ের খবরটি ভাইরাল হওয়ার পর থেকে শুরু হয় নানান সমালোচনা। বিভিন্ন গ্রুপে গ্রুপে তাদের নিয়ে চলছে ট্রল। কেউ তাদের নিয়ে উপহাস করছেন, কেউ গুরু-গম্ভীরভাবে মারাত্মক অন্যায় দেখে বসছেন এরই মধ্যে। একতরফা ওই কলেজ-শিক্ষিকাকেও দোষ দিচ্ছেন কেউ। তাদের মতে, ছাত্রকে প্ররোচনা দিয়ে কিংবা জোরপূর্বক বিয়ে করেছেন। যদিও তারা দু’জনই গণমাধ্যমের সামনে এ বিষয়টি নিয়ে খোলামেলাভাবে বলছেন।
তবে কে শোনে কার কথা। আপাতত মুখরোচক টপিক পাওয়া গেছে। তাই বিকৃত মস্তিষ্কের একদল লোক ব্যস্ত তাদের নিয়ে ট্রল করতে। বিভিন্ন জায়গায় তাদের ছবি, ভিডিও ব্যবহার করে বিভিন্নরকম বাজে মন্তব্য করে পোস্ট করা হচ্ছে। কেউ সমাজের নিয়মের দোহাই দিচ্ছে, কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে , অসম বয়সের এই বিয়েকে মানতে নারাজ। কিন্তু আদৌও কি সমাজ, আইন, ধর্ম এ বিষয়ে কোনো বাধা দেয়? দেশের আইন অনুযায়ী পূর্ণবয়স্ক নারী ও পুরুষ স্বেচ্ছায় যেকোনো বয়সী, নারী-পুরুষ, যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষকে বিয়ে করতে পারেন। আমাদের দেশের আইনানুযায়ী বিয়ের বয়স মেয়েদের ১৮, ছেলেদের ২১ বছর। এক্ষেত্রে তাদের বিয়েতে আইনের কোনো বাধা নেই।
অন্যদিকে, বিয়ের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো বয়সের কথা ইসলামও বলেনি। যারা বিবাহের সামর্থ্য রাখে, তাদের বিবাহ করা কর্তব্য বলেও ইসলামে বিধান রয়েছে। অসম বয়সের বিয়েকে কোনো ধর্মেই অন্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়নি।
রইলো বাকি সমাজের নিয়মকানুনের কথা। অনেকেই নিজের থেকে ১৮ বছর কম বয়সের এক ছেলেকে বিয়ে করায় ওই কলেজ শিক্ষিকাকে নিয়ে হেয় করে কথা বলছেন, সমাজের তথাকথিত কিছু নিয়মের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। এই একই সমাজে যখন একজন ১৬ বছর বয়সের মেয়েকে ৪০ বছর বয়সের পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়, তখন কেন সবাই নিশ্চুপ থাকে?
বাল্যবিবাহ যেভাবে আমাদের সমাজে শেকড় গেঁড়ে বসে আছে, তা নিয়ে যদি নিয়মিত এমন প্রতিবাদ হতো, তবে অনেকাংশেই বাল্যবিবাহের সংখ্যা কমে আসতো। আবার নারী-নির্যাতন, ধর্ষণ, হয়রানি চোখের সামনে অহরহ ঘটছে। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকজনকে সোশ্যাল মিডিয়া সরব হতে দেখা যায়। এই কলেজ শিক্ষিকা ও ছাত্রের বিয়ে নিয়ে যে পরিমাণ ট্রল হচ্ছে, ধর্ষক কিংবা ইভটিজারকে নিয়ে কেন তেমন প্রতিবাদ হয় না? আইনের চোখে এই দম্পতি অপরাধী নয়। অপরাধী তারা, যারা তাদের ব্যক্তিজীবন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমজুড়ে এ ঘটনা নিয়ে যে বিকৃত চর্চা হচ্ছে, তার কারণ, নৈতিক অবক্ষয়, আইনের প্রতি উদাসীনতা, সঠিক শিক্ষার অভাব। এজন্য আমাদের সমাজের কিছু রীতিনীতি দায়ী। ছোটবেলা থেকেই একটি শিশুকে বৈষম্য শেখানো হয়। একজন নারী তার চেয়ে কম বয়সের পুরুষকে বিয়ে করতে পারে এমন ঘটনাকে আমাদের সমাজে অস্বাভাবিকভাবে তুলে ধরা হয়। তাই তরুণ প্রজন্ম ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বিষয়টি নিয়ে ট্রল করতে। এক্ষেত্রে যদি তাদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া যায়, তবে মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। এছাড়া, আইনের প্রতি সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সমাজের যেসব ভুল রীতিনীতির কারণে এমন বিকৃত মানসিকতার তৈরি হচ্ছে, সেসব রীতিনীতি কিভাবে দূর করা সম্ভব, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের ভাবতে হবে। এবং তা এখনই।
অনন্যা/জেএজে