মেয়েরা কেন রাতের রানি
মেয়েরা ঘরে দেরি করে ফিরলে হয়ে যায় ‘রাতের রানি!’ আর পুরুষেরা যখন রাত করে ঘরে ফেরে, তখন লোকের কাছে মনে হয়, তারা অনেক ‘পরিশ্রমী’। অনেক কাজ করে বাড়িতে ফিরেছে তারা। কিন্তু রাতে মেয়েরা বাইরে থাকলে, তাদের উদ্দেশে ‘রাতের রানি’ ছাড়াও লিঙ্গবৈষম্যের অনেক মন্তব্যই এই দেশে করতে দেখা যায় ।
বেশ কিছু দিন আগে আমাদের চলচ্চিত্র জগতের এক অভিনেত্রীসহ আরও কয়েকজন গ্রেফতার হওয়ার কারণে একটি উল্লেখযোগ্য শব্দ ভেসে বেড়িয়েছে অনেক দিন। শব্দটা হলো ‘রাতের রানি’। ওই-সময় যে সংবাদ সম্মেলন হয়, সেখানে গ্রেফতার দুই জনকে বলা হয় ‘রাতের রানি’। শব্দটি যথেষ্ট অপমানজনক ও নারী-বিদ্বেষী মন্তব্য। এ কারণে অনেকেই প্রতিবাদ স্বরূপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের ছবির সঙ্গে ‘রাতের রানি’ শব্দটি যোগ করেন।
এই মন্তব্য নারীদের ওপর প্রয়োগ করেই যেন অধিক আনন্দ পায় এই সমাজ। এই মন্তব্যে কারও কোনো ভ্রূক্ষেপ সচরাচর দেখা যায় না। কারণ, এই সব মন্তব্য খুবই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে সমাজে। একটা মেয়ে ঘর থেকে বের হলে রাস্তার মানুষদের প্রতি মুহূর্তে চাক্ষুষ নজরানার শিকার হয় প্রতিদিন। এই কারণে নারীকূলও এই বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে চলাফেরা করার প্রস্তুতি নিয়ে ঘর থেকে বের হয় রোজ।
কিন্তু পরিবারে গিয়েও তাদের ঠাঁই হয় না। পরিবার একটা মেয়ের ওপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করে। সার্বক্ষণিক নানা-কিছু নিয়ে বাঁধাধরা নিয়ম, সম্মানহানির ভয় দেখানো, কথার জবাব দিতে মানা করার জন্য অনেক অবদমনের একটা যাত্রা পার করে মেয়েরা। ফলে মানসিকভাবে অনেককেই বিরূপ ফলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
একই পরিবারে ছেলে আর মেয়ে একসঙ্গে বেড়ে উঠলেও, তাদের ভিন্নভাবে বড় করে তোলা হয়। চাকরি-জীবনেও কোনো স্বাধীনতা থাকে না নারীদের।
চাকরি যত ভালোই হোক না, বাড়ির বাইরে যদি যেতেই হয়, রাতে দেরি করে বাড়ি ফেরা যাবে না মেয়েদের। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার একটা জরুরি বিষয়। তাদের চাকরির খাতিরে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতে পারে। রাত হওয়া তো অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। এই ধরনের পূর্বশর্ত দেওয়া থাকে পরিবারের পক্ষ থেকে!
ছেলেরা রাত করে আড্ডা দিতে পারে, ছেলেদের তো একটু বন্ধু-বান্ধব থাকবেই। কিন্তু মেয়েদের বন্ধু-বান্ধব এত বেশি থাকা যাবে না। মেয়েদের জীবনে দুই বেলা সময় বলে কিছু হয় না। তাদের দিনটা সূর্যাস্ত পর্যন্ত বরাদ্দ থাকে। তাই তাদের হয় দিনের বেলায় চাকরি করতে হবে, নয়তো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডাটা দিনের বেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। দিনের বেলায় কাজ করে সন্ধ্যায় মেয়েদের আড্ডা দেওয়ার কোনো দরকার পড়ে না। যদি দরকারই পড়ে, তাহলে তাদের নামের সঙ্গে ‘রাতের রানি’ তকমা সেঁটে দেবে পুরুষতন্ত্র।
একই বিষয়কে ভিন্ন ভিন্ন তকমা সেঁটে দেওয়া একটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে। এখানে সমাজের তৈরি করা দীর্ঘদিনের অন্তর্জাল থেকে বের হতে পারে না কেউই। তাই লিঙ্গ বৈষম্য সর্বত্রই বিরাজমান। কিন্তু এই বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়াটা জরুরি। তার জন্য পরিবেশ ও পরিবার কে হতে হবে, এ জাতীয় কুসংস্কারমুক্ত। নারীর জন্য একটা ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। যেন একজন নারী কাজের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা পায়। নিজেকে আরও উপযুক্ত করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।