নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্যই কি সব!
নারীর প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে এত কথা সমাজে প্রচলিত কিন্তু সুরাহার উৎসমুখে সিলগালা মারা! কাড়া নেড়েও কেন জানি বারবার থমকে পড়ে নারীর প্রকৃত মুক্তি! বেঁচে থাকার সুস্থ পরিবেশ! নারীর জীবন কেন প্রতিনিয়ত প্রশ্নের সম্মুখীন? কেন নারীকে সুন্দরভাবে গ্রহণ করে না পরিবার-সমাজ! সৃষ্টিমূলে যেই নারীর অবদান এতটাই বেশি তাদের হেনস্তা করার আগে পুরুষ কে, কী, কিভাবে পৃথিবীতে এসেছেন, তা কেন ভাবেন না!
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নাগপাশে নারীদের জীবন বিপন্ন। সময় এসেছে নারীর নিজ অবস্থানকে শক্ত করার। জেগে ওঠার! কেন শুধু পোশাকি আবরণকেই নারীর যোগত্যা ভাবা হয় আজও? নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে আর কত ঘষামাজা! নারীকে বিচার করার কী আদৌ কোন মাধ্যম বাহিরাবরণ? একজন পুরুষ বা একজন নারী সুন্দর পোশাক পরলে তাকে পরিচ্ছন্ন, রুচিশীল, মার্জিত মনে হয়। কিন্তু পোশাকটা খুললে তো পোশাকের কোনোই মূল্য থাকে না! কারণ মূল্যটা ব্যক্তির। তার রুচি-অভিরুচির। পোশাক স্রেফ বাইরের আবরণ। তেমনি যারা নারীকে বাইরের আবরণ দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করেন তাদের এটা মাথায় এবং মননে নেওয়া উচিত নারীর বাইরের আবরণ সব নয়। যদি তাই হতো আবহমান কাল ধরে একটি কথা ঘুরেফিরে আসতো না ‘চরিত্র মানব জীবনের মুকুট স্বরূপ’। চরিত্র কি কেউ বাইরে দেখেন, না স্পর্শ করতে পারেন! এটি উপলব্ধির বিষয়। তাহলে নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে আর কত কাল হেনস্তা, মানসিক নির্যাতন-নিপীড়ন!
সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে ‘আগে দর্শনধারী তারপর গুণবিচারী’! কিন্তু সবাই কথাটির ভুল ব্যাখ্যা দিতেই মুখিয়ে থাকি! দর্শনের কোথায় বলা আছে নারীর রূপজদর্শন? কথাটি প্রচলিত, নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই। এই দর্শন কি নারী বা পুরুষের ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন, রুচিশীল মননের বর্তা দেয় না! একজন ব্যক্তি তিনি নারী হন বা পুরুষ যখন কর্মস্থলে প্রবেশ করেন বা বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সভা-সেমিনার সেখানে তার রুচিশীলতার পরিচয়টাই খুঁজতে চেষ্টা করা হয়! বাইরের আবরণ নয়। তবে যারা বাইরের আবরণকেই দর্শনধারীর সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করেন তাদের মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়!
পরিবারে মেয়ে হলে তাকে একপেশে করে রাখা হয়। তাকে ছেলেদের মতো ডালপালা গজিয়ে উঠতে দেওয়া হয় না। যতটা পারা যায় ছেটেছুটে একটা বনসাঁইয়ে রূপান্তরিত করা হয়। নারীর এই অবরুদ্ধ দশা কবে কাটবে? আমরা নামে আধুনিকতার বুলি আওরাই কিন্তু পরিবারে-সমাজে কোনোই সুনির্দিষ্ট কারণ নেই, যার জন্য বলতে হবে যে, নারীরা আজ ভালো আছে! নারীকে পরিবার থেকেই শুরু করা হয় নিপীড়ন! মেয়ের গায়ের রঙ, মোটা না শুকনা, লম্বা না বেটে! এসব কী রূপ কথা! একজন মানুষকে হেনস্তা করার মাধ্যম ছাড়া আবার কী!
দেশের মানুষ এতটা ধর্মভীরু কিন্তু তারা কেউ কেন বোঝেন না, সৃষ্টি করেছেন স্রষ্টা। সেখানে ব্যক্তির কিছু করার নেই! যদি তাই হতো তাহলে সবাই হয়তো সুন্দরী নাম যাদের আছে, তাদের কাতারে নিতে চেষ্টা করতেন। তবে ব্যক্তি সর্বদা যোগ্যতা-দক্ষতাকে বাড়িয়ে তুলতে পারেন। সে নারী-পুরুষ উভয়ই। তবে সমাজে পুরুষের তো ‘পোয়া বারো’! তাদের যোগ্যতা-দক্ষতা-গুণ-গরিমা কিছু না থাকলেও পুরুষ! সমাজ তাদের সুন্দর তকমা সেঁটে দিয়েছে! আর নারীর বেলায় বালাইষাট! ও তো মেয়ে! ওকে দিয়ে কী হবে! তার ওপর রূপও নেই! তবে ভণ্ডামির লেবাস রেখে দিয়ে কী হবে! এত মনে-প্রাণে স্রষ্টাকে ডেকে এই তার নমুনা! তার সৃষ্টিকেই বিদ্রূপ, কটূক্তি!
কেন নারীকে তার শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে হেনস্তা করতে হয়! আজও বিয়ের ক্ষেত্রে খোঁজা হয় রঙ যার ভালো, লম্বা-চওড়া গড়ন, মোটাও হবে না আবার শুকনাও না! কারণ শুকনা হলে তো আবার মা খেতে দেয় না! সেখানেও মায়েরই দোষ! এই নোংরামি, ভণ্ডামি, উগ্র মানসিকতার বলি কবে হবে? সমাজ পরিবর্তন একদিনে হবে না। আজ অবধি তাহলে হতো। কিন্তু যেহেতু পুরুষতন্ত্র তাদের শক্তি সামর্থ্য নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে, তাই নারীদের মনোবল হারালে চলবে না। নারী মানে আমরাই পারি। দেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ কম ছিল না। যদি নারীরা অস্ত্র ধরতে পারে তবে নারী নিজ মান-মর্যাদা বৃদ্ধিতে লড়তে পারবে না! বাঙালি নারীরা এতটা ঠুনকো কখনোই নয়! কেউ ভাঙতে চাইলেই লুটিয়ে পড়বে এতটা মেরুদণ্ডহীন নয়।
পরিবার-সমাজে চলা আসা কুপ্রথা শিকার হন না, এমন নারীর সংখ্যা নেই বললেই চলে! নারীদের নিজেদের অবস্থানে দৃঢ় হতে হবে। কেউ গায়ের চাপা রঙ, মোটা, শুকনা, লম্বা না শর্ট; এসব বলে আপনার যোগ্যতা-দক্ষতাকে অবমূল্যায়ন করবে আর অমনি আপনি সেটাকে আত্মহননের পথে নিয়ে যাবেন এমন কেন! ‘সোনার আটিং বাঁকাও ভালো’ এই বাঁকাদের সোজা করতে হলে আপনাকেই আপনার অপমানের জবাব দিতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতে হবে। অন্য কেউ হয়তো সহ-মর্মিতার বাণী শোনাবে কিন্তু ভুক্তভোগী নন! ফলে নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে যাদের মাথাব্যথা, তাদের এই ব্যথাটার মলম তো নারীদেরই দিতে হবে। আসুন নিজের জীবনকে সবচেয়ে মূল্যবান ভাবি। বাহিরাবরণ ও বাইরে চকচকে না হয়ে মনকে চকচকে-স্বচ্ছ করে তুলি। তাহলেই সমাজের যত নোংরা আবর্জনা পচা-গলা, প্রথা, কুসংস্কার, গোঁড়ামি দূর হবে। গড়ে উঠবে শোষণমুক্ত সমাজ।