জ্যামাইকা: নীল পাহাড়ের দেশ
এই তো কদিন আগেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে ফেরিতে চড়ে পাড়ি দিতে হয়েছিল ক্যারিবিয়ান সাগরে। সেই সফর নিয়ে বাংলাদেশে কী কাণ্ডটাই না হলো। কিন্তু এই ঘটনা থেকে বলা যাবে না জাহাজে চড়ে ক্যারিবিয়ান সাগরগুলোতে চলাচল করাটা একেবারেই মন্দ। যাদের সি সিকনেস আছে তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যাদের আবার অত ঝুট-ঝামেলা নেই, তারা হয়তো এই ভ্রমণকে স্বাগত জানাবেন।
ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলো মূলত পর্যটন খাত থেকেই অধিকাংশ আয় করে থাকে। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিকে নিজের চাদরে বেঁধে তারা কেমন সুন্দর নকশা এঁকে রেখেছে, তা সেখানে না গেলে বোঝা সম্ভব না। তবে ক্রিকেটের বদান্যতায় এই দ্বীপগুলো সম্পর্কে কিছুটা আগ্রহ তো জেগেছে অবশ্যই। আমোদপ্রিয় দ্বীপগুলোর একটি জ্যামাইকা। জ্যামাইকা যদি যেতে হয়, সেটা কেমন হতে পারে? একবার লেখায় মিলিয়ে নিন। তারপর নাহয় ট্যুর প্ল্যানটা সেড়ে নেওয়া যাবে।
ঢাকা থেকে জ্যামাইকায় সরাসরি যাওয়ার কোনো উপায় নেই। আমেরিকা কিংবা ইউরোপ দিয়ে যেতে হবে। বিমান সংস্থাগুলোর সাহায্য নিলে শুধু অপেক্ষা আর ভ্রমণের পাল্লাটা দীর্ঘ হবে। আর নাহলে বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিন। প্যাকেজ ট্যুরগুলোতে কিছু সাশ্রয় তো হবেই। মনে রাখবেন। ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোতে খরচ কিন্তু মোটেও কম নয়। তাই খরচ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান নিয়ে নেবেন।
যাত্রার আগে ভালো একজোড়া জুতো নিতে ভুলবেন না। ছাতা, টুপি, পানির বোতল এই কয়েকটি জিনিস খুব সামান্য মনে হলেও আপনার ক্যারিবিয়ান ভ্রমণকে আরো সুন্দর করতে সাহায্য করবে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপে পৌঁছে জ্যামাইকা যেতে হলে ফেরিই সবচেয়ে ভালো পথ। বিমানেও যাওয়া যাবে। তবে ফেরির যাত্রাটা রোমাঞ্চকর। পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ানের সেই আতঙ্ক না থাকলেও সমুদ্রের চারপাশের দৃশ্য দেখলে ক্যারিবিয়ান আবহাওয়ার সঙ্গে কিছুটা মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ হবে।
জ্যামাইকার মাটিতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে দুপুর হয়ে যাবে। আকাশের নীলের মাঝে ঘন মেঘ। এখানকার আবহাওয়া কেমন যেন। যখন বৃষ্টি পড়ে তখন এক নাগাড়ে ঝরতেই থাকে। আর যখন রোদ তখন সে কী অবস্থা! আপনি হয়তো মৃদু বৃষ্টির জ্যামাইকাকে ভালোবাসবেন। চারপাশের বাতাসে অন্তত ধোঁয়া বা পেট্রল পোড়ার ঘ্রাণ নেই। সঙ্গে ঢাকার রাস্তার মতো ধুলো নেই। কেমন এক বুনো গন্ধ চারপাশে। দূরেই সারিবদ্ধ পাহাড়গুলো গম্ভীর হয়ে আছে। জাহাজ থেকেই কৃষ্ণচূড়া গাছ চোখে পড়বে। সময় থাকলে দেখবেন দ্বীপে হয়তো আগুন ধরেছে। একটু কাছে যেতেই ভুল ভাঙবে।
জাহাজ যেখানে থামবে তার নাম এসকুইভাল। একপাশে লম্বাটে কিছু কন্টেইনার দেখা যাবে হয়তো। এই কন্টেইনারগুলো খালি নয়। এগুলোতে অ্যালুমিনা আছে। পোর্ট থেকেই রেললাইন চোখে পড়বে। ছোট ছোট রেলগাড়িতে চড়ে কন্টেইনারগুলো এখানে আসে। এগুলো রপ্তানির মালামাল।
পোর্ট ছাড়ার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। ক্যারিবিয় দ্বীপগুলোতে সব প্রাণের আমেজ এই সমুদ্রবন্দরেই। ডেকে দাঁড়ালেই ব্যস্ততা চোখে পড়তে বাধ্য। একটু থমকে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকান। সমুদ্রের রঙ সবুজ আর আকাশের নীল এই দুয়ে মিলে কেমন অদ্ভুত এক খেল দেখাচ্ছে। ইংরেজিতে একেই বলে সি গ্রিন। ঘোর লাগা চোখে মনে হবে এটা বাস্তব হতেই পারে না। রঙতুলি দিয়ে কেউ হয়তো এঁকেছে এমন কিছু।
বেশ কদিনের ভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে একটা দিন একটু বিশ্রামেই কাটিয়ে দিন। জ্যামাইকার খাবারগুলো চেখে দেখুন। আর সমুদ্রের ধারেই সময় কাটান। ভ্রমণের পাল্লাটা পরেরদিনের জন্যেই নাহয় তুলে রাখা হোক।
জ্যামাইকা ঘুরতে গেলে প্রথমে পোর্ট থেকে বের হওয়ার অনুমতিপত্র নিতে হবে। বাইরে বের হতেই বন্দরের ব্যস্ততা যেন নিমেষেই হাওয়া। গাড়িঘোড়া তো নেই সঙ্গে মানুষের টিকিটির দেখাও মিলবে না। দেখো কাণ্ড! এবার ঘুরা যায় কিভাবে? আমি বলে দিচ্ছি। ওই আবার পোর্টের অফিসে ফিরে যান। যার কাছে অনুমতিপত্র নিয়েছেন তাকে বললেই একটা গাড়ি ম্যানেজ করে দিবেন। ওই একটু বখশিশ দিতে হবে। তো সে কথা আগে বললেই পারতেন! তা জানি। তবে নিজে থেকে একবার দেখে নিলে মন্দ কী? এবার আপনার গন্তব্য ওল্ড হারবারে।
গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে জ্যামাইকার ইতিহাসটি একটু শুনে নিন। তাইনু নামে এক উপজাতি জ্যামাইকার নাম রেখেছিল জায়মাকা। এই নামের অর্থ কাঠ ও পানির দেশ। পরে মানুষের মুখে মুখে এর নাম হয়ে গেলো জ্যামাইকা। পোর্ট থেকে ওল্ড হারবারে পনেরো মিনিটে পৌঁছে যাবেন। পুরো রাস্তাজুড়ে শুধু ঘন জঙ্গল। সামনে যে কী অপেক্ষা করছে, কে জানে। হ্যাঁ, এখানে জনবসতি অনেক কম। গাছপালাই বেশি। তবে ওল্ড হারবারের বাজারে গেলে কিছুটা স্বস্তি মিলবে।
এখানে এসেই মনে হবে জনমানুষ আছে। দোকানপাট অফিস কোর্ট সব আছে। এতক্ষণ মানুষের খোঁজ নেই আর এখানে তো রীতিমতো বাজার। রাস্তার সংযোগস্থলে একটা লোহার ঘড়ি দেখতে পাবেন। ও হ্যাঁ, ইতিহাসের পাট তো শেষ হয়নি। এককালে ক্যারিবিয় দ্বীপগুলো তো ব্রিটিশ আর ফরাসি সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল জ্যামাইকা। সেই শুরু থেকে ঘড়িটি এখনো আছে। একদম নির্ভুল সময় এই ঘড়িতে দেখতে পাবেন।
বেশিক্ষণ অবশ্য এখানে থাকবেন না। সন্ধ্যের আগে আগে ফিরতে হবে। কারণ ট্যাক্সিগুলো আবার সহজে ফিরতে রাজি হয় না। জ্যামাইকায় এলে হাতে সময় রাখতে হবে। এখানকার মানুষগুলো দেখতে আসুরিক হলেও প্রকৃতির কাছে বড্ড অসহায়। ঝড়ের সংকেতে বন্দরের কাজ স্থগিত রাখতে হয় প্রায়ই।
ওল্ড হারবার থেকে কিছু দূরেই কোলবেক ক্যাসেলে ঘুরে আসতে পারেন। বহু বছর ধরে একে জ্যামাইকার সবচেয়ে রহস্যময় বাড়ি ভাবা হতো। জন কোলবেক নামে এক ব্রিটিশ কর্নেলের আবাসন ছিল এটি। এমনিতে জ্যামাইকাতে ভূমিকম্পের ভয় তাই বহুতল বাড়ি নির্মাণ ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ঐতিহাসিকদের মতে, এক সময় এই বাড়িটি ছিল তিনতলা সমান উঁচু। ঐতিহাসিকদের কথাই মানতে হবে। কারণ এখন তো বাড়িটির ধ্বংসাবশেষ বাকি আছে শুধু। তবে এই বাড়িকে ঘিরেও গল্পের অভাব নেই। এককালে এই বাড়ির চারপাশে ছিল অসংখ্য পরিখা ও মাটির নিচের ঘরে ক্রীতদাসদের রাখা হতো।
ইতিহাসের পাঠ ভেঙে ভেঙে দেয়াই ভালো। কলম্বাস সাহেব এই দ্বীপটিতে আসেন স্বর্ণের খোঁজে। স্পেন সরকার তাকে দ্বীপটি লিখে দেন। কিন্তু আস্তে আস্তে এর বাণিজ্যিক গুরুত্ব বুঝতে পেরে ১৬২০ সালে আবার উপহার কেড়ে নেন।
স্প্যানিশদের পর ইংরেজ সাহেবরা আসেন এখানে। আফ্রিকান ক্রীতদাসদের এখানেই আনা হতো। সেজন্যেই এখানকার অধিকাংশ মানুষ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত।
কিংসটনে তাই আপনাকে যেতেই হবে। ওল্ড হারবার থেকে মাত্র ৩৩ কিমি দূরে শহরটি। এখানে দুটো ভাগ আছে। একটি নতুন অন্যটি পুরনো। পুরনো অংশে গেলেই ইতিহাসে কিছুটা ফিরে যাওয়ার সুযোগ মিলবে। এখানে জনবসতিও অন্যান্য জায়গা থেকে বেশি। নতুন অংশটি আবার ব্লু মাউন্টেনকে পেছনে রেখে গড়ে উঠেছে।
হ্যাঁ, এখান থেকে পাহাড়কে নীল দেখায়। অদ্ভুত তো বটেই। ব্লু মাউন্টেনে পর্যটকরা ওঠেন। অনেকে রাতে পাহাড় চড়েন সূর্যোদয় দেখায় আশায়। ভারি সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা। সরীসৃপের মতো পেঁচিয়ে ওপরে উঠে গেছে। এখানকার কফির বেশ সুনাম আছে। পথে সুন্দর ঝর্ণা, দুর্গ আর ফেরিওয়ালাতের নানা সদাই আপনার সময়টিকে বেশ ভালো রাখবে। ব্লু মাউন্টেন দেখা হয়ে গেলেই আবার ফেরিতে করে দেশের পথ। পেছনে ফেলে যাওয়া নীল পাহাড়ের দেশকে।
অনন্যা/এআই