আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের অগ্রদূত নভেরা
নভেরা আহমেদ। একজন বাংলাদেশি কিংবদন্তী ভাস্কর। তাকে বলা হয় বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের অগ্রদূত। বিংশ শতাব্দীর প্রথম বাংলাদেশি আধুনিক ভাস্কর তিনিই। তার কাজের প্রতি ছিলো অগাধ ভালোবাসা। তাই তো উপহার দিতে পেরেছেন একের পর এক সূক্ষ্ম কাজ।
তার কাজের প্রধান বিষয়বস্তু হচ্ছে নারী প্রতিমূর্তি। তবে নারী প্রতিমূর্তি নির্মাণে তিনি বিমূর্ততার দিকে ঝুঁকেছেন। কাজের স্টাইলের দিক থেকে তিনি ব্রিটিশ ভাস্কর হেনরি মূরের অনুবর্তী।
নভেরার জন্ম বাংলাদেশের সুন্দরবনে মার্চ ২৯, ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে। চাচা নাম রাখেন নভেরা। ফার্সি শব্দ ‘নভেরা’র অর্থ নবাগত, নতুন জন্ম। কর্মসূত্রে তার বাবা সৈয়দ আহমেদ কর্মরত ছিলেন সুন্দরবন অঞ্চলে। তবে পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের আসকারদিঘির উত্তর পাড়। পরবর্তী সময়ে তার বাবা চাকরিসূত্রে কিছুকাল কলকাতায় অবস্থার করায় নভেরার শৈশব কেটেছে কলকাতা শহরে। বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকাল থেকেই তিনি নাচ, গান শেখার পাশাপাশি মাটি দিয়ে মূর্তি তৈরি করতেন।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/07/2-17-1024x576.jpg)
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারত বিভাগের পর তারা পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লায় চলে আসেন। এ সময় নভেরা কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। পিতার অবসরগ্রহণের পর তাদের পরিবার আদি নিবাস চট্টগ্রামে গিয়ে স্থায়ী বসবাস শুরু করে। এরপর চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন তিনি। পরবর্তী আইন শিক্ষার জন্য তাকে বাড়ি থেকে লন্ডনে পাঠানো হয় ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে।
তবে শৈশব থেকেই নভেরার ইচ্ছা ছিল ভাস্কর্য করার। তাই তিনি সেখানে সিটি অ্যান্ড গিল্ডস্টোন কার্ভিং ক্লাসে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে ভর্তি হন ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে ন্যাশনাল ডিপ্লোমা ইন ডিজাইনের মডেলিং ও স্কাল্পচার কোর্সে। সেখান পাঁচ বছর মেয়াদের ডিপ্লোমা কোর্স করার পর ১৯৫৫ সালে তিনি ইতালির ফ্লোরেন্স ও ভেনিসে ভাস্কর্য বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন।
ষাট দশকের শেষভাগের মধ্যেই তার যা কিছু সৃষ্টি ও নির্মাণ। ১৯৭৩ থেকে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন স্বেচ্ছানির্বাসনে। আর সে সময় তিনি খুব কম কাজই করেছেন। এ সময় অবশ্য তিনি কিছু ছবি এঁকেছেন৷ তবে তার এই সেচ্ছানির্বাসনের কারণটা বেশ পরিচিতই বটে। কারণটা ছিল অভিমান।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/07/3-8-1024x576.jpg)
তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে এই অভিমানে। আর এই অভিমান খোদ রাষ্ট্রের কাছে। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কর হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদ মিলে শহিদ মিনারের দায়িত্ব পান ৷ কিন্তু সরকারি খাতায় নভেরার নাম না থাকায় শহিদ মিনারের নকশা পরিকল্পনায় তাঁর অবদানের প্রসঙ্গটি বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয় । কিন্তু শহিদ মিনারের স্থাপত্য ভাস্কর্যের মূল নকশার পরিকল্পনা যে নভেরা ও হামিদের যৌথ চিন্তার ফসল তা সবার কাছেই অনুমেয়।
কিন্তু রাষ্ট্রের ওপর তার অভিমান এতটাই প্রবল ছিল যার কারণে তিনি দীর্ঘ সময়ের জন্য গুটিয়ে নেন নিজেকে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে দেশ ত্যাগ করেন তিনি। তিনি আর কখনো বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন নি। এমনকী বাঙ্গালী সঙ্গও এড়িয়ে চলেছেন। বাংলায় কথা বলতেও তার ছিলো প্রবল অনীহা। কিন্তু ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে স্ট্রোকের ফলে হুইলচেয়ারে বসেই তার শেষ জীবন কাটে। দীর্ঘদিন অসুস্থতায় ভোগার পর ৭৬ বছর বয়সে ২০১৫ সালের ৫ মে প্যারিসেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
তার মৃত্যুর পর ৪৩টি চিত্রকর্মের হদিশ পাওয়া গেছে। নভেরা আহমেদের কাজের সর্ববৃহৎ সংগ্রহ রয়েছে ঢাকাস্থ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে। এছাড়া প্যারিসে তার স্বামী গেগ্ররী দ্য ব্রুনোর স্টুডিওতে ৯টি ভাস্কর্য ও ৪৩টি অঙ্কিত চিত্র রয়েছে৷
অনন্যা/এসএএস