মহাকাব্যের নারীগণ: সত্যভামা, কৃষ্ণের স্ত্রী হয়েও দৃষ্টির আড়ালে
সত্যভামা মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র কৃষ্ণের স্ত্রী। রাজা সত্রাজিতের কন্যা। কৃষ্ণের আট স্ত্রীর মধ্যে তৃতীয়। মহাভারতে কৃষ্ণের অবদান যত বেশি, সে তুলনায় সত্যভামার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। বিয়ের অব্যবহিত পরেই অক্রুর ও কৃতবর্মার প্ররোচনায় সত্যভামা শতধন্বা কর্তৃক নিদ্রিত অবস্থায় সত্রাজিত নিহত হন। নববধূ সত্যভামা পিতার মৃতদেহ তৈলমধ্যে রক্ষা করে স্বামীর কাছে উপস্থিত হন। তখন কৃষ্ণ শতধন্বাকে হত্যা করে।
সত্যভামা কৃষ্ণের প্রতি সন্তুষ্ট হয়। কিন্তু নারদ মুণি যখন শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার আসেন তখন উপঢৌকন হিসেবে স্বর্গ থেকে কল্পবৃক্ষের কয়েকটি ফুল আনেন। শ্রীকৃষ্ণ এই ফুলগুলি স্ত্রীদের মধ্যে ভাগ করে দেন কিন্তু ভুলক্রমে শ্রীকৃষ্ণ সত্যভামাকে এই উপহার থেকে বঞ্চিত করে। ফলে সত্যভামা কৃষ্ণের প্রতি অভিমান করে। তখন সত্যভামার সন্তুষ্টি লাভের জন্য সর্গ থেকে কল্পতরু এনে প্রাঙ্গণে রোপণ করে। সত্যভামাও কৃষ্ণের প্রতি খুশি হন। সত্যভামার এই অভিমান কৃষ্ণের প্রতি তার ভালোবাসাকে ব্যক্ত করে তুলেছে। কিন্তু এত মান-অভিমান ভালোবাসকে কেন্দ্র করে হলেও কৃষ্ণের সহযাত্রী হতে দেখা যায়নি মহাভারতে তেমন কোথাও। কিন্তু সহধর্মিণী তো সর্বদাই গৃহীত। তবু, গুটিকয় উপস্থিতির মধ্যেই যেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন চরিত্রটি সীমাবদ্ধ রেখেছেন।
কৃষ্ণ মহাভারতের বিশেষ এবং প্রধান চরিত্র হলেও সত্যভামার উপস্থিতি কম। ‘মহাভারত’ অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের পত্নী সংখ্যা আট। এঁরা হলেন রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, মিত্রবিন্দা, নগ্নজিতী, মাদ্রী, লক্ষণা ও রোহিনী। কৃষ্ণ তার জীবন যাত্রায় বহু স্ত্রীকে গ্রহণ করলেও রুক্মিণী ও সত্যভামার নাম বেশি উল্লেখ করা হয়। তবুও নামের সঙ্গে জীবনচিত্র সেভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। এমনকি কৃষ্ণের জীবন পরিচালানার সঙ্গে যুক্ত হয়েও সত্যভামা আলোর বাইরেই থেকে গেছে।
সত্যভামা ইন্দ্রের স্ত্রী শচী, শিবের স্ত্রী গৌরী ও অগ্নির স্ত্রী স্বাহার মতো পুণ্যব্রতের অনুষ্ঠান করে নারদ মুণিকে স্বামী কৃষ্ণকে দান করে। তারপরই সত্যভামার মনে বিচ্ছেদের জ্বালা শুরু হয়। তখন শ্রীকৃষ্ণের নামাঙ্কিত তুলসীপত্রের বিনিময়ে নারদের কাছ থেকে স্বামীকে ফিরে পান। কৃষ্ণের প্রতি সত্যভামার এই হৃদয়বৃত্তি এবং আত্মিকটানের কথা আসলেও কৃষ্ণকে কোথাও নিজ স্ত্রীদের সম্পর্কে বিশেষভাবে বিগলিত হতে দেখা যায়নি। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন মহাভারতের আলোচনায় হয়তো কৃষ্ণের ব্যক্তিক জীবন ফোকাস করতে চাননি তাই তার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সেভাবে তুলে আনেননি কাহিনিতে। কৃষ্ণ ও সত্যভামার যতটুকু যোগাযোগ সেখানে কিছুটা হৃদয়ের আকুতি দেখানো হয়েছে আবার কিছুটা এসেছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে।
যাদুবংশ ধ্বংস ও শ্রীকৃষ্ণের মহাপ্রায়াণের পর অনন্যা যাদব মহিলাদের সঙ্গে সত্যভামাকে ইন্দ্রপ্রস্থে স্থানান্তর করে অর্জুন। কিন্তু অর্জুন কর্তৃক নীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কৃষ্ণকে হারিয়ে সত্যভামার হৃদয়ের অবস্থা কেমন ছিল সেগুলোর কোনই বর্ণনা মহাভারতে আসেনি। মহাভারত মহাকাব্যটিতে বহু চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে কিন্তু লেখকের দৃষ্টি স্বল্প কিছু চরিত্রের উন্নয়নে এমনভাবে গৃহীত হয়েছে যে সত্যভামার মতো নারীর দিকে তার মনোযোগ পড়েনি। মহাভারতের কাহিনিকে যিনি তরান্বিত করলেন, যার উপস্থিতি ছাড়া পুরো মহাভারত অন্তঃসারশূন্য! বলতে গেলে কৃষ্ণ নেই অর্থ গোটা মহাভারতই নিশ্চিহ্ন। তবুও তার ব্যক্তিক কোন কিছুই বিবৃত হয়নি। শুধু তার কৃষ্ণের রাজনৈতিক জীবন বর্ণনা এসেছে সেখানেও স্ত্রীদের উপস্থিতি গৃহীত হয়নি। আর সত্যভামার তো তেমন কোনই সাক্ষাৎ মহাভারতে নেই।
কিন্তু সত্যভামার জীবনাবসান কিভাবে হলো, তার কিছুটা আভাস আমরা পুরাণ মারফতে পায়। কৃষ্ণের মৃত্যুর পর ইন্দ্রপ্রস্থে যাত্রা করলেও পরবর্তী সময়ে তিনি হিমালয় অতিক্রম করে কলাপগ্রামে গিয়ে জীবনের অবশিষ্ট কাল শ্রীকৃষ্ণের ধ্যানে কাটিয়ে দেন। এবং সেখানেই সমাধিস্থ হন। সত্যভামার যেটুকু চিত্র লেখক রূপায়ণ করেছেন সেখানে কৃষ্ণের প্রতি তার প্রেমময়ীভাবই প্রধান হয়ে উঠেছে। ‘পতিই সতীর গতি’ আরও একবার যেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন তুলে ধরলেন। কিন্তু নারী হৃদয়ের এই মূল্য পুরুষের কাছে অতি তুচ্ছ তাই হয়তো কৃষ্ণ মননে সত্যভামা আলো-আঁধারির মতো থেকেছে। প্রকৃতির মতো সুজলা-সুফলা করে তাকে বাড়তে দেওয়া হয়নি।