ধর্ষকদের আতঙ্ক ছিলেন ফুলন দেবী!

ভারত উপমহাদেশে ধর্ষককে নয়, ধর্ষণের শিকার নারীদের মুখ লুকোতে হয় ঘরের কোণে। ধর্ষক বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায়, আর যত দোষ এসে পড়ে ভিকটিমের ঘাড়ে। তাইতো ধর্ষণের পর আত্মহত্যা কিংবা চুপ থাকাকেই শ্রেয় মনে করে নারীরা। কিন্তু এসব থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের ছিলেন ফুলন দেবী। ধর্ষণের পর অন্যসব নারীর মতো পথ বেছে নেননি তিনি। আত্মহত্যার পথেও যাননি। এমনকী লোকলজ্জার ভয়ে ঘরে লুকিয়ে থাকার পথও বেছে নেননি। বরং হয়ে উঠেছিলেন ধর্ষকদের যমদূত।
ভারতের উত্তর প্রদেশের জালৌন জেলায় এক মাল্লা সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেন ফুলন দেবী। মাল্লা সম্প্রদায়কে নিম্ন বর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। মাত্র ১১ বছর বয়সে ৩০ বছরের পুট্টিলাল নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে ফুলনের বিয়ে হয়। পুট্টিলাল ছিলো একজন অসৎ চরিত্রের লোক। ফুলনের সঙ্গে সে বলপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতো। শারীরিক অত্যাচার করতো। অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে ফুলন বাবার বাড়িতে ফিরে যান। কিন্তু ভারতীয় সমাজ তার গায়ে অসৎ চরিত্রের তকমা লাগিয়ে দেয়। ১৯৭৯ সালে মায়াদিন চুরির অভিযোগে ফুলনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফুলনের তিন দিন কারাবাস হয়। কারাবাসে তিনি আইন-রক্ষকের হাতে ধর্ষণের শিকার হন।

কেউ কেউ বলেন ডাকাতের দল ফুলন দেবীকে অপহরণ করে, আবার কেউ কেউ বলে তিনি স্বেচ্ছায় ডাকাতের দলে যোগ দেন। সেই ডাকাত দলের দলনেতা বাবু গুজ্জর কয়েকবার ফুলন দেবীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু সে দলের দ্বিতীয় দলনেতা বিক্রম মাল্লার প্রতিবাদ করেন এবং বাবু গুজ্জরকে হত্যা করেন। অবশেষে বিক্রম তাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দেন।
এরপর ডাকাত দলটি ফুলনের প্রথম স্বামী পুট্টিলালের বাস করা গ্রামে লুণ্ঠন করে। ফুলন পুট্টিলালকে টেনে নিয়ে এসে জনসমক্ষে শাস্তি দেয় ও খচ্চরের পিঠে উল্টো করে বসিয়ে নির্জন স্থানে নিয়ে এসে বন্দুক দিয়ে প্রহার করেন। প্রায় মৃত অবস্থায় পুট্টিলালকে ছেড়ে চলে যান তারা। যাওয়ার সময় কম বয়সের মেয়েদের বিয়ে করা পুরুষদের জন্য সাবধানবাণী স্বরূপ একটি পত্র রেখে যান।
বিক্রম মাল্লা থেকে বন্দুক চালানো প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ফুলন দেবী। এরপর উত্তর প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশে বসবাসকারী উচ্চবর্ণের লোকদের গ্রামে লুণ্ঠন, ভূস্বামীদের অপহরণ, রেল ডাকাতি ইত্যাদি বিভিন্ন অভিযান চালান ফুলন দেবী। চম্বল উপত্যকায় এই ফুলন দেবীর দল আত্মগোপনে থাকতো ।
বিক্রম মাল্লার অপরাধ জগতের গুরু ছিলেন শ্রীরাম নামের এক ডাকাত। তাকে কারারুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন বিক্রম। মুক্তি পাওয়ার পর তাকে দলের ভার বহন করার জন্য আহ্বান জানান। শ্রীরাম ছিলেন নিষ্ঠুর প্রকৃতির ব্যক্তি। শ্রী রাম বিক্রমকে হত্যা করার সুযোগের সন্ধানে ছিলেন। কিছুদিন পর শ্রী রাম বিক্রমকে হত্যা করে ফুলনকে অপহরণ করে নিয়ে যান।

শ্রী রাম ফুলনকে উলঙ্গ প্রায় অবস্থায় এক গ্রামে নিয়ে যান এবং ঘোষণা করেন যে ফুলন দেবী বিক্রমকে হত্যা করেছে। ফুলনকে শাস্তি দেওয়ার জন্য গ্রামবাসীদের আদেশ দেন তিনি। শাস্তি স্বরূপ প্রথম শ্রী রাম ফুলনকে ধর্ষণ করেন। তারপর এক এক করে বহু ঠাকুর তার ওপর যৌন ও শারীরিক নির্যাতন করেন। তিন সপ্তাহের অধিক সময় তার ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা হয়। ২৩ দিন পর ফুলন নিজেকে ঠাকুর সম্প্রদায়ের গ্রাম বেহমাই আবিষ্কার করেন। অবশেষে এক ব্রাহ্মণের সাহায্যে ফুলন বেহমাই থেকে পালাতে সক্ষম হন।
ফুলনের দুঃখের কাহিনী শুনে বাবা মুস্তাকিন নামক এক ডাকাত নেতা তাকে নতুন একটি ডাকাতের দল গঠন করতে সাহায্য করেন। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ফুলন তার ওপর অত্যাচারকারীদের সন্ধান শুরু করেন। যার মধ্যে প্রধান ছিলেন শ্রী রাম ও লালা রাম। অবশেষে সন্ধান পান যে শ্রী রাম বেহমাই গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। ফুলনকে নির্যাতন করার ১৭মাস পর, ১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রয়ারি তিনি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বেহমাই গ্রামে প্রবেশ করেন। কিন্তু পুরো গ্রাম খুঁজেও তাদের সন্ধান পাননি। পরে ডাকাতের দল গুলি করে গ্রামের ২২ জনকে হত্যা করে। তবে জানা যায় নিহত সবাই ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিল না। এটিই মূলত কুখ্যাত বেহমাই হত্যাকাণ্ড বা বেহমাই গণহত্যা নামে পরিচিত।
বেহমাই হত্যাকাণ্ডের জন্য ওই সময়ের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ভিপি সিং পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন এবং ফুলন দেবীও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন দস্যু রাণী নামে। যদিও ফুলন ছিলেন ডাকাত কিন্তু তার মন ছিল মায়া-মমতায় ভরা। সেই সময়ে উত্তর প্রদেশের শহরগুলোতে দুর্গাদেবীর বেশে ফুলনের মূর্তি বিক্রি হতো।
বেহমাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুরো ভারতজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। পুলিশি হামলায় তার দলের অনেক সদস্য নিহত হন। কিন্তু তাকে ধরতে পারে না পুলিশ। একপর্যায়ে পুলিশ তার বাবা-মাকে গ্রেপ্তার করলে কিছু শর্তসাপেক্ষে বেহমাই হত্যাকাণ্ডের প্রায় দুই বছর পর ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় ৮০০০ জন দর্শকের উপস্থিতিতে ফুলন আত্মসমর্পণ করেন। দেবী দুর্গা ও মহাত্মা গান্ধীর ছবির সন্মুখে তিনি বন্দুকটি রেখে আত্মসমর্পণ করেন। ১১ বছর কারাবাস শেষে ১৯৯৪ সালে তিনি মুক্তি লাভ করেন।

কারামুক্তির পর তিনি ধীরে ধীরে পা রাখেন রাজনৈতিক জীবনে। ১৯৯৬ সনে সমাজবাদী পার্টি ফুলনকে মির্জাপুর আসনের জন্য টিকিট দেয়। ভারতীয় জনতা পার্টি ও বেহমাই হত্যাকাণ্ডে নিহত ঠাকুরের পত্নীরা ঘোর বিরোধিতা করা সত্ত্বেও তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ফুলন পরাজিত হলেও ১৯৯৯ সালে মির্জাপুর লোকসভা নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচিত হন।
২০০১ সনের ২৫ জুলাই তারিখে নতুন দিল্লিতে ফুলন দেবীকে হত্যা করা হয়। ওই সময় তার দেহরক্ষীও আহত হয়। তখন তিনি সংসদ থেকে বের হয়ে আসছিলেন। হত্যাকারীরা তাকে গুলি করে অটোরিকশায় উঠে পালিয়ে যায়। এভাবেই শেষ হয় ফুলন দেবীর অধ্যায়। যিনি নারীদের মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন। বারবার বিচার না পেয়ে নিজেই নিয়েছিলেন নিজের প্রতিশোধ। বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ রোধে রেখেছিলেন যুগোপযোগী ভূমিকা। বেশিরভাগ অপরাধ তিনি নির্যাতিত নারী ও বিশেষ করে নিম্ন শ্রেণীর নারীদের ন্যায়বিচার দিতে সংঘটিত করেছিলেন। তাই তখনকার দিনে ধর্ষক ও নারী নির্যাতনকারীদের কাছে এক আতঙ্কের নাম ছিলেন ফুলেন দেবী।
অনন্যা/জেএজে