নরসিংদী স্টেশনজুড়ে তাদের নীরব প্রতিবাদ
সমাজের শত শত অনিয়ম, দুর্নীতি, দুর্দশা সব কিছুকে ছাপিয়ে বছরের প্রায় প্রতিটি দিন আলোচনায় থাকে নারীর পোশাক। চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতে দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়া প্রত্যেকটি নারীর পোশাকের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন উপস্থিত প্রায় ৯০ শতাংশ পুরুষ। শুধু চায়ের দোকানে না পথে-ঘাটে, অফিসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, স্টেশনে সর্বত্রই নারীর পোশাক নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকে। তবে মাত্রা ছাড়ায় তখনই যখন পোশাকের জন্য নারীকে জনসম্মুখে হয়রানির শিকার হতে হয়।
আমাদের সমাজের কিছু মানুষের মস্তিষ্কে যে অসুস্থ বীজ রয়েছে, তা ধীরে ধীরে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। তার প্রমাণ সবচেয়ে বেশি মিলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নারীকে পোশাকের জন্য হয়রানি করাতে কোনো অন্যায় খুঁজে পায় না একদল মানুষ। তবে হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মধ্যে অন্যায় খুঁজে পায় তারা৷ কিন্তু তাই বলে প্রগতিশীল মানুষ তো প্রতিবাদ করা থামিয়ে রাখবেন না। যেমন, নরসিংদীতে নারীর পোশাক নিয়ে হয়রানির বিরুদ্ধে ভিন্নধর্মী প্রতিবাদ করেন ২০ জন নারী-পুরুষ।
নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাকের জন্য এক তরুণীকে হয়রানি করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নিজেদের ‘পছন্দমতো পোশাক’ পরে নরসিংদী স্টেশনে যান তারা। গত ২৭ মে শুক্রবার সকালে ঢাকা থেকে নরসিংদীগামী একটি ট্রেনে করে স্টেশনটিতে যান তারা। সেখানে তারা প্রায় আড়াই ঘণ্টার মতো অবস্থান করেন। তাদের নরসিংদী স্টেশনে যাওয়ার উদ্দেশ্য, সেখানকার মানুষের মানসিকতা বোঝা এবং পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করা। তারা বোঝাতে চেয়েছেন প্রত্যেকটি মানুষের স্বাধীনতা রয়েছে, জায়গাটি সবার, এখানে যে কেউ যেকোনো ধরনের পোশাক পরতে পারে।
স্টেশনে তারা বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরে গিয়েছেন। কেউ স্লিভলেস পরেছেন, কেউ স্কার্ট পরেছেন, কেউ টপস পরেছেন, কেউ থ্রি কোয়ার্টার পরেছেন। বৈচিত্র্যময় পোশাক পরে তারা স্টেশনে নেমেছেন। প্রথম থেকেই তাদের পরিকল্পনা ছিলো কোনো ধরনের মিছিল, সমাবেশ বা স্লোগান করবেন না। শুধু তাদের অবস্থানের জানান দেবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা পুরো স্টেশন একসঙ্গে ঘুরেছেন, আলাদা গ্রুপে ভাগ হয়েও ঘুরেছেন।
এ উদ্যোগ ও কার্যক্রম নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন এ দলের একজন সদস্য অপরাজিতা সঙ্গীতা। তিনি পাক্ষিক অনন্যাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, বেশি মানুষ( ২০ জন) একসঙ্গে থাকায় কিছু বলতে পারেননি ওইখানকার মানুষ। কিন্তু যখন দুজন আলাদা হয়েছি ঠিকই পাশ থেকে ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য করেছে তারা। স্থানীয় এক ছেলে তাদের প্রশ্ন করেন, ‘কেন দেশ থেকে এসেছেন?’ সেখানে কয়েকজন মুখে অতিথিপরায়ণ ভাব দেখালেও তাদের চোখ বলছিল অন্য কথা৷ অপরাজিতার মতে যদি সেদিন তারা সংখ্যায় ২০ জন না হয়ে দুই থেকে তিন জন হতেন, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যেতো।
তিনি নরসিংদীকে তুলনা করেন পুরো বাংলাদেশের সঙ্গে। তার ভাষায়, ‘এই জায়গাটিই (নরসিংদী রেলস্টেশন) পুরো বাংলাদেশ।’ আমরা টিপ পরা নিয়ে এক পুলিশ সদস্যকে একজন নারীকে হয়রানি করার ঘটনা দেখেছি, বাসের মধ্যে একটি মেয়েকে পোশাকের জন্য হেনস্তা করার ঘটনা দেখেছি। এসব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু এক দিকেই।
তিনি আরও বলেন, ‘বেশির ভাগ মানুষ তুলনা করে বলছে, মেয়েগুলো যে পোশাক পরেছে, তা বাংলাদেশের কালচার না। কিন্তু হেনস্তাকারী সেই নারীর পরনের পোশাক কিংবা পুরুষের পরনের জিন্স টপস কোনোটাই তো বাংলাদেশের কালচার না। বাংলাদেশের সংবিধানে পোশাক নিয়ে কিছু লেখা নেই, তার মানে আমরা বাংলাদেশের সংবিধান পরিপন্থী কোনো কাজ করছি না, আইন পরিপন্থী কোনো কাজ করছি না। আর এ বিষয়টিই আমরা আমাদের এ উদ্যোগের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করেছি।”
তাদের এ উদ্যোগ নির্দিষ্ট কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে নয়। তারা সবাই ফেসবুকে মেয়ে নেটওয়ার্ক নামে একটি নেটওয়ার্কের সদস্য। আর এ উদ্যোগের সমন্বয়ক হলেন তৃষিয়া নাশতারান। তিনি বর্তমানে অগ্নি ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
যদি আজ থেকে কয়েক দশক আগের কথাও চিন্তা করা হয়, তখন পোশাক নিয়ে মানুষের মানসিকতা এতটা বিকৃত ছিল না। নারীর পোশাকের জন্য তাকে জনসম্মুখে মারধর, হয়রানি, হেনস্তা করার মতো ঘটনা তখন চোখে পড়তো না। তখনো অনায়াসে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে ঘুরতেন বহু নারী। শাড়ির সঙ্গে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে উপজেলা পর্যায়ের কলেজগুলোতেও যেতেন নারীরা। তবে দেশ এত আধুনিক হওয়ার পরেও বর্তমানে সমাজের এই চিত্র কেন? এমন প্রশ্নই করা হয়েছিল নারী নির্মাতা অপরাজিতা সঙ্গীতাকে।
উত্তরে সঙ্গীতা বলেন, এমন পরিস্থিতি ১০-১৫ বছর আগেও ছিল না। বর্তমানে নারীর পোশাক নিয়ে সমাজে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণ, ধর্মান্ধ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সমাজে ভুল ধারণা সৃষ্টি করা, কালচারাল এক্টিভিটিস কমে যাওয়া। এসব বিষয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় হিসেবে তিনি বলেন, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন, শিক্ষাব্যবস্থার সংশোধন এবং একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব দরকার৷
উল্লেখ্য, সম্প্রতি নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাক নিয়ে একজন তরুণীকে হেনস্তা করা হয়। ওই তরুণী আর তার বন্ধু নরসিংদী ঘুরতে যান, তার পরনে ছিল জিন্স ও টপস। শুধু তার পোশাকের জন্য তাকে হেনস্ত করে স্থানীয় কয়েকজন। এমনকি দুজন পুরুষ ও দুজন নারী মিলে ওই তরুণীর গায়ের পোশাক টেনে খুলে ফেলারও চেষ্টা করে। একজন রড নিয়ে মারতে চলে যায় তাদের। ঘটনার একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দেশজুড়ে চলে সমালোচনা। এ ঘটনায় দুজন অভিযুক্তকে এ পর্যন্ত আটক করেছে পুলিশ।
অনন্যা/জেএজে