নারীর হিজাবে দোষ, জিন্সেও দোষ!
বর্তমানে নারীর অভ্যাস-আচরণ ও মানসিকতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সমাজে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। বরং নারীরা যেদিকে যায়, সেদিকেই তাদের দোষ খোঁজার চেষ্টা চলে। নারীর জীবনযাপন যেন নিজ ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে পারবে না। সেখানে জড়ো হয় পরিবার-পরিজন থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন মানুষের বিধিনিষেধের পাহাড়। যাদের মনন ও মস্তিষ্ক পুরোটাজুড়ে আছে নারীকে হেনস্তা করার নানা ফন্দি-ফিকির! তাই সমাজের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, নারীর পোশাক যেন একদল মানুষের যন্ত্রণার কারণ!
ইদানীং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেখা মিলছে, দুই ধরনের পোশাক নিয়ে নারীকে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে! একদিকে হিজাব অন্যদিকে জিন্স! কথা হলো, যদি নারীর হিজাবেও দোষ হয়, জিন্সেও দোষ হয়, তাহলে নারী যাবে কোথায়!
আবহমান কাল ধরে বাঙালির জীবনচেতনা যেভাবে গড়ে উঠেছে, সেই গণ্ডির বাইরে আজও নারী-পুরুষ উভয়ই পুরোপুরি বের হতে পারেনি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরুষতন্ত্র সমাজকে শাসন করে চলছে। তাই নারীর পোশাককে ঘিরে নারীর জন্য শৃঙ্খল তৈরি করছে কুচক্রী মহল।
বর্তমানে আমরা ডিজিটাল যুগে বাস করছি। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রাও অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে গেছে। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবারে রূপ নিয়েছে। আবার একক পরিবারের ধারণাও পরিবর্তিত হচ্ছে! সেখানে যুক্ত হয়েছে মত-পথের প্রাধান্য! স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজনের কাছে আরেকজনের মতের গুরুত্ব না থাকলে সেখানে দেখা দিচ্ছে জটিলতা। যুগের সঙ্গে জীবনযাত্রার যেমন পরিবর্তন ঘটেছে, তেমনি পরিবর্তন এসেছে নারীর পোশাকেও। কোনো নারী হিজাবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, আবার কেউ জিন্সে।
পোশাক নির্বাচনে নারীরা প্রথমত নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেয়, দ্বিতীয়ত স্বাচ্ছন্দ্যকে। জীবনচলার পথ যেহেতু এখন বহুমুখী; তাই নারীও তার জীবনকে সহজ করতে বহুধরনের পোশাক নির্বাচন করে। তারা কর্মক্ষেত্রে একটি বিশেষ স্থান দখল করেছে। কর্মস্থল, শিক্ষাঙ্গন এবং জীবনযাত্রা সহজ করতে অনেকেই জিন্স পরে। আবার অনেকে হিজাব ব্যবহার করে। আবার কেউ কেউ জিন্সের সঙ্গে হিজাবও ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে নারীরা তাদের রুচি ও স্বাচ্ছন্দ্য দুটোর ওপর সমান গুরুত্ব দেয়। কিন্তু তারা নিজের মতকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে পড়ছে সমাজের মোল্লা-মাতবর থেকে শুরু করে বখাটেদের রোষানলে। যারা নারীর মতকে গুরুত্ব না দিয়ে কেন হিজাব পরলো, কিংবা জিন্স কেন পরলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
সমাজে একশ্রেণীর মানুষ আছে, যারা নারীর হিজাবকে গুরুত্ব দেয় খুব বেশি। সে অনুযায়ী নারীর চরিত্র, নারীর জীবনযাত্রার একটি টোটাল সার্টিফিকেটও দিয়ে দেয়। যে শ্রেণি নারীর হিজাবকেই গুরুত্বপূর্ণ পোশাকের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে, তারা আবার জিন্সকে অস্বীকার করে। নারীর রুচি-চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে! আবার সমাজের কিছু মানুষ আছে, যারা হিজাবটাকে শুধু বাড়তি আবরণ মনে করেন, তারা আবার জিন্সের মাঝেই নারীর স্মার্টনেস, নারীর স্বাচ্ছন্দ্যের পক্ষে! এই দুই শ্রেণিই আমাদের সমাজে বিদ্যমান।
কথা হলো নারীর পোশাক তো নারীর নিজের। সেখানে কেন সমাজের এত বিধিনিষেধ! নিজের ইচ্ছে-রুচি-অভিরুচিকে নারীরা কেন গুরুত্ব দেবেন না? কেন নারীরা অন্যের জন্য নিজের পছন্দকে গলাটিপে হত্যা করবে। সবচেয়ে বড় কথা, কেউ যদি হিজাব ব্যবহারে শান্তি-স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে, তবে তাকে তাই পরতে দেওয়া উচিত। আবার কেউ যদি জিন্সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তবে তাকেও তাই ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত।
নারী জিন্স-টপস-বোরখা-হিজাব কোনটা পরবে, কোনটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, এটা তার ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, নারীর পোশাক যেন তার মূল্যায়নের চাবিকাঠি না হয়। হিজাব বা জিন্স নয়; বরং নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হোক। নারীর স্বাধীন সত্তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নারীর সহযাত্রী হোক সমাজ।
অনন্যা/এআই