Skip to content

আসক্তি শনাক্তের নিখুঁত পদ্ধতি উদ্ভাবনে নেতৃত্বে বাংলাদেশি রামিসা

আসক্তি শনাক্তের নিখুঁত পদ্ধতি উদ্ভাবনে নেতৃত্বে বাংলাদেশি রামিসা

ভবিষ্যতের চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছেন বাংলাদেশের রামিসা ফারিহা। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক্টরাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কর্মরত রামিসা নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন একটি গবেষণাদলের, যারা প্রথমবারের মতো নির্ভুলভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছেন কেউ অপিওয়েড জাতীয় ওষুধে আসক্ত কি না এবং কোন ধরনের অপিওয়েড সে গ্রহণ করেছে। এত দিন এমন কার্যকর এবং নির্ভুল কোনো পদ্ধতি বিশ্বে ছিল না।

এই উদ্ভাবন শুধু আসক্ত রোগীদের চিকিৎসাতেই নয়, জীবনের সূচনাতেই মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা নবজাতকদের রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

মাতৃগর্ভেই বিষাক্ততা, নবজাতকের জীবন শঙ্কায়

একটি সদ্যোজাত শিশুর কথা ভাবুন, যার মা দীর্ঘদিন ধরে অপিওয়েডে আসক্ত। মাতৃগর্ভে থেকেই শিশুটি প্রতিনিয়ত গ্রহণ করে যাচ্ছে সেই মাদকের বিষাক্ত উপাদান। জন্মের পর হঠাৎ এই ‘সরবরাহ’ বন্ধ হয়ে গেলে শিশুটির শরীরে দেখা দেয় মারাত্মক উপসর্গ—যার নাম নিওনেটাল অ্যাবস্টিনেন্স সিনড্রোম (NAS)। শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে এই অবস্থায়। অথচ চিকিৎসকেরা অনেক সময় বুঝতেই পারেন না, এই সমস্যার মূল কারণ অপিওয়েড অভাব!

সেই বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সমাধানে এ গবেষণার তাৎপর্য অবর্ণনীয়।

রক্তের ফোঁটায় নির্ভুল তথ্য: তিন মিনিটেই রিপোর্ট!

রামিসা ও তাঁর দল এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করেছেন, যাতে মাত্র ২০ মাইক্রোলিটার রক্ত, অর্থাৎ আঙুলের মাথায় ছোট্ট একটি ছিদ্র করেই সংগ্রহ করা নমুনা থেকে জানা যাবে:

কেউ আদৌ আসক্ত কি না

আসক্ত হলে কোন শ্রেণির অপিওয়েড গ্রহণ করেছে

শরীরে তার পরিমাণ কত

শুধু তাই নয়, নবজাতকদের পায়ের গোড়ালি থেকে নেওয়া পাঁচটি রক্তফোঁটার মাত্র ৩ মিলিমিটার অংশই বিশ্লেষণে যথেষ্ট। আর এই পরীক্ষাটি করতে সময় লাগে মাত্র তিন মিনিট।

যুক্তরাষ্ট্রে শিশু জন্মের পর এই রক্তফোঁটাগুলো এমনিতেই নেওয়া হয় স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। এখন সেই রক্তের দাগ থেকেই পাওয়া যাবে অপিওয়েড সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য—তাও অত্যন্ত দ্রুত ও সাশ্রয়ী উপায়ে।

গবেষণার পেছনের গল্প

এই গবেষণার পেছনে রয়েছে পারস্পরিক সহযোগিতা ও চ্যালেঞ্জ নেবার সাহস। জনস্বাস্থ্য গবেষক ক্যারোলিনা হ্যাস–কফলার অপিওয়েড আসক্তি নিয়ে কাজ করছিলেন, কিন্তু সঠিক তথ্যের অভাবে বারবার বাঁধা পাচ্ছিলেন। তখন তিনি সহায়তা চান ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অধ্যাপক অনুভব ত্রিপাঠির কাছ থেকে। ত্রিপাঠি এই গবেষণায় রামিসাকে নেতৃত্ব দিতে বলেন, যিনি তাঁর অধীনেই পিএইচডি করেছেন এবং বর্তমানে পোস্টডক্টরাল গবেষণায় আছেন।

রামিসা বলেন, “রক্ত সংগ্রহে মাদকাসক্তদের দেহে চ্যালেঞ্জ থাকে, আবার প্রস্রাবের নমুনাও সবসময় নির্ভুল ফল দেয় না। আমরা এমন পদ্ধতির দরকার অনুভব করছিলাম, যা অল্প রক্তে দ্রুত ও নির্ভুল ফল দিতে পারবে।”

এই গবেষণার ফলাফল ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন, নেচার, সায়েন্স ডিরেক্ট–এর মতো জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ থেকে বিশ্বজয়

নারায়ণগঞ্জে জন্ম নেওয়া রামিসা ২০১৩ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক, তারপর ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডেও।

বর্তমানে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি জনসন অ্যান্ড ওয়েলস ইউনিভার্সিটিতেও শিক্ষাদান করছেন তিনি। ক্ষুদ্র রক্তনমুনা বিশ্লেষণ তাঁর গবেষণার মূল ক্ষেত্র হওয়ায় এই উদ্ভাবনে সেই পূর্ব-অভিজ্ঞতাও কাজে লেগেছে।

রামিসার স্বপ্ন—এই প্রযুক্তি যেন শুধু উন্নত বিশ্বের পরীক্ষাগারে সীমাবদ্ধ না থাকে। কম খরচে, সহজে, দ্রুত–বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে পরীক্ষার সুবিধা যেন পায় সাধারণ মানুষও। সে কারণেই শুকনো রক্ত পরীক্ষার এই পদ্ধতিকে তিনি দেখতে চান বৈশ্বিক সমাধান হিসেবে।