প্রাকৃতিকসৌন্দর্যেরএকঅনন্য স্থান সাগরকন্যা কুয়াকাটা

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত কুয়াকাটা—যা ভালোবেসে পরিচিত ‘সাগরকন্যা’ নামে—একটি অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ স্থান। বিশাল বঙ্গোপসাগরের কোলে জন্ম নেওয়া এই পর্যটনকেন্দ্রটি তার বিস্তীর্ণ সৈকত, গর্জনরত ঢেউ, রঙিন লাল কাঁকড়া, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য, আদিবাসী সংস্কৃতি এবং গ্রামীণ জীবনযাত্রার অপূর্ব মেলবন্ধনের জন্য বিখ্যাত।

বিশ্বে খুব অল্প কিছু জায়গা আছে, যেখান থেকে একই স্থান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়—কুয়াকাটা তেমনই এক বিস্ময়। ভোরবেলা কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ যখন ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আর সূর্যের প্রথম আলো সাগরের বুকে পড়ে, তখন সেই দৃশ্য যেন এক জীবন্ত চিত্রকর্ম। ঠিক একইভাবে সন্ধ্যায়, সূর্য যখন ধীরে ধীরে জলরাশির নিচে হারিয়ে যায়, তখনও কুয়াকাটা তার রূপের দ্যুতি ছড়ায়।
এখানে রয়েছে ‘বালু কাঁকড়ার দ্বীপ’ নামে এক বিশেষ স্থান, যা প্রকৃতির আরেক বিস্ময়। ভাটার সময় সঠিক সময়ে সেখানে পৌঁছালে দেখা মেলে লাল কাঁকড়ার দলে দলে বিচরণ। তারা পুরো সমুদ্রসৈকতে ছড়িয়ে পড়ে যেন কেউ লাল গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে প্রকৃতিকে অভিনন্দন জানানোর জন্য।
সাগরের গর্জন, বিশাল ঢেউয়ের একের পর এক আছড়ে পড়া, আর বাতাসে লবণাক্ত সজীবতা—সব মিলিয়ে কুয়াকাটা এক অদ্ভুত শান্তি ও প্রশান্তির অনুভূতি দেয়। প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে এটি যেন এক পরম আশ্রয়। প্রতিটি ঋতুতে কুয়াকাটার রূপ আলাদা, অনুভব আলাদা, অভিজ্ঞতা আলাদা।

‘জেটি পয়েন্ট’-এ দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালে দেখা যায় বেলাভূমির বিস্তৃতি, লাল কাঁকড়ার চলাচল, আর জেলেদের দিনযাপনের সংগ্রামী জীবন। এই জীবনের সঙ্গে মিশে রয়েছে ঐ অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ইতিহাস।
স্থানীয় রাখাইন আদিবাসীদের গ্রামে গিয়ে দেখা যাবে তাদের নিজস্ব কৃষ্টি, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। সেইসঙ্গে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় ‘শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার’ ও ঐতিহাসিক ‘সুপেয় পানির কুয়া’—যার নাম থেকেই এসেছে ‘কুয়াকাটা’।
শ্রী মঙ্গল বৌদ্ধবিহার
এই বিহারে এশিয়ার সর্ববৃহৎ বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে। এখানে এলে আপনি গৌতম বুদ্ধর মূর্তির পাশাপাশি ২০০ বছর পুরাতন একটি কুয়াও দেখতে পাবেন। এছাড়াও, এখানে এলে আপনি দেখতে পাবেন রাখাইনদের শতবছরের প্রাচীন রীতি নীতি এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। বৌদ্ধ বিহারে প্রবেশের মুখে দাঁড়ান দুইটি মূর্তি রয়েছে। এগুলো চুনদ্রী দেবীর। রাখাইনদের ধর্মীয় বিশ্বাসে চুনদ্রী দেবী মন্দিরের রক্ষাকর্তা। উপরের দিকে সিঁড়ির শেষ প্রান্তে রয়েছে শাক্য রাজার মূর্তি। বিহারটি সাধারণ জনসাধারণের জন্য সকাল ৮ টা থেকে ১১ টা ও ২ টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। দর্শনার্থীদের জন্য জনপ্রতি ১০ টাকা ফি ধার্য রয়েছে।
লাল কাঁকড়ার চর
কাঁকড়ার চরে ভোরে বা সকালে গেলে লাল কাঁকড়ার দেখা পাওয়া টা কষ্টকর। সূর্যের তাপে বালু উত্তপ্ত হয়ে গেলে কাঁকড়া রা বাইরে বের হয়ে আসে। তাই, সকাল ১১ টার দিকে গেলেই সহজে লাল কাঁকড়ার দৌড়া দৌড়ি উপভোগ করতে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে আপনার উপস্থিতি যেন কোন ভাবেই টের না পায় পেলেই গর্তে চলে যায়। এই লাল কাঁকড়ার চরে আপনাকে বাইকে করে যেতে হবে, সকাল ৭ টার পর থেকে বেলা ১২ পর্যন্ত হাজার হাজার লাল কাঁকড়া দেখতে পাবেন এখানে। এছাড়া বিকালের সময়েও দেখা মিলবে লাল কাঁকড়ার। ভাটার সময় পানি কিছুটা নেমে গেলে অসংখ্য লাল কাঁকড়া মিছিল নিয়ে ছুটে চলে। এঁকেবেঁকে পুরো বেলাভূমিতে যেন তারা আলপনা আঁকছে। কুয়াকাটা ও গঙ্গামতি সৈকতে এখন এ দৃশ্য নিত্যদিনের। যেন দীর্ঘদিন পর ‘বেদখল’ হয়ে যাওয়া বেলাভূমি পুনরুদ্ধার করেছে কাঁকড়ার দল।
শুটকি পল্লী
শুঁটকির জন্য বিখ্যাত জায়গা কুয়াকাটা। প্রাকৃতিকভাবে শুকিয়ে বাজারজাত করা হয় কুয়াকাটার শুটকি। প্রাকৃতিকভাবে শুকানোর ফলে এর রয়েছে আলাদা স্বাদ। কুয়াকাটায় আসা পর্যটক-দর্শনার্থীদের কাছে প্রতিদিন শতাধিক কেজি শুটকি বিক্রির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ১২ মাস গুটকির চাহিদা থাকলেও নেই কোনো স্থায়ী পল্লী। যারা শুটকি খায় না তারাও যায় এইখানে।
যাবে না। পর্যটকরা লেবু বন বা বাগান মনে করতে পারেন আসলে লেম্বু ছিল রাখাইন সম্প্রদায়ের একটি মেয়ে। তার বাড়ি ও বাগান এখানে ছিল। সমুদ্রে সে বাড়ি হারিয়ে গেছে। এখান থেকে পশ্চিমে ফাতরার বন দেখা যায়। লেম্বু বাগান থেকে সূর্যাস্ত সবথেকে ভাল দেখা যায়। এখানে সামুদ্রিক শামুক ঝিনুকের প্রচুর খোলস পাওয়া যায়। এখানে বেশ কিছু দোকান গড়ে উঠেছে। কাঁকড়া বা মাছ ফ্রাই করে খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
কুয়াকাটা যাওয়ার উপায়
নদী ও সড়ক পথে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যাওয়া যায়। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সড়ক পথে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা অনেক কম সময়ে এবং সহজে যাওয়া যায়। তবে লঞ্চ ভ্রমণ ও আরামের কথা বিবেচনা করলে কুয়াকাটা যেতে নদী পথই উত্তম। ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে লঞ্চে করে পটুয়াখালীতে গিয়ে সেখান থেকে বাসে করে কুয়াকাটা যাওয়া যায়। অথবা লঞ্চে সদরঘাট থেকে বরিশাল। গিয়ে সেখান থেকে বাসে কুয়াকাটা যেতে পারবেন। মাথাপিছু ৩০০০-৬০০০ টাকা রাখলে খুব সুন্দর ভ্রমণ হয়ে যাবে।
কুয়াকাটা কোথায় থাকবেন
পর্যটকদের থাকার জন্য কুয়াকাটায় বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল আছে। মান ও শ্রেণী অনুযায়ী এসব হোটেলে ৫০০ টাকা থেকে ৫,০০০ টাকায় থাকতে পারবেন। হোটেল রুম ভাড়া কমাতে কয়েকজন মিলে শেয়ার করে থাকলে খরচ কম হবে। সিজন ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া গেলে আগে থেকে হোটেল বুক করার প্রয়োজন পরে না। আর অবশ্যই দামাদামি করে নিবেন।
এছাড়াও কুয়াকাটায় রয়েছে আরও অনেক দর্শনীয় স্থান, যেমন—ফাতরার চর, গঙ্গামতির চর, মিশ্র সংস্কৃতির মন্দির, বনবিভাগের ঝাউবন এবং নৌকাভ্রমণের সুযোগ। কিন্তু এসব সৌন্দর্যের সবটুকু এখনো অনেকের অজানা।
তাই বলা যায়, কুয়াকাটা শুধু একটি সমুদ্রসৈকত নয়; এটি বাংলাদেশের এক জীবন্ত নিদর্শন যেখানে প্রকৃতি, সংস্কৃতি আর জীবন একসঙ্গে মিশে এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে।