নারীর পোশাক নিয়ে এত প্রশ্ন কেন?

চারপাশে একদল উন্মত্ত যুবকের চিৎকার, স্লোগান। গেরুয়া উত্তরীয় পরা ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়া একদল যুবকের মধ্য দিয়ে স্কুটি নিয়ে চলে যায় মেয়েটি৷ বোরখা পরা একা শীর্ণকায় তরুণী স্কুটি থেকে নেমে এগিয়ে আসে তাদের স্লোগানের মুখে। গলার আওয়াজ তুলে একাই শুরু করেন ‘আল্লাহু আকবর’ স্লোগান। ভারতে কর্ণাটকে হিজাব ইস্যুতে মুসকান নামের এক কিশোরীর এমন সাহসিকতায় পুরো বিশ্ব তাকে প্রশংসায় ভাসিয়ে বলে, নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী যেকোনো পোশাক পরার অধিকার নারীর আছে।
এরপর আরেকটি দৃশ্যে চোখ বুলানো যাক। এ ঘটনা আমাদের দেশের। রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার। বেশ কিছুদিন আগে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় ফার্মগেট সেজান পয়েন্টের সামনে টিপ পরা নিয়ে হয়রানির শিকার হন তিনি। তিনি হয়রানির শিকার হয়েছেন একজন পুলিশ সদস্যের থেকে। পুলিশ সদস্য তাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘টিপ পরছোস ক্যান?’
কিন্তু এই ঘটনায় অনেক মানুষই প্রতিবাদ করলেও, বেশিরভাগ মানুষই উল্টো নারীর দোষ দিয়েছেন। যেমনটা হলো সম্প্রতি নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাক নিয়ে একজন তরুণীর সঙ্গে ঘটা অপ্রীতিকর একটি ঘটনায়। ওই তরুণী আর তার বন্ধু নরসিংদী ঘুরতে যান, তার পরনে ছিল জিন্স ও স্লিভলেস টপ্স। শুধু তার পোশাকের জন্য তাকে হেনস্তা করেন স্থানীয় কয়েকজন। এমনকি দুজন পুরুষ ও দুজন নারী মিলে ওই তরুণীর গায়ের পোশাক টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করেন। একজন তো রীতিমতো রড নিয়ে মারতে চলে যান তাদের।
এই ঘটনাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। কিন্তু সেই টিপ ইস্যুর মতোই এখানেও ভিকটিমকেই দোষারোপ করা হয়, তার পরনের পোশাকের জন্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এ ভিডিওর কমেন্ট বক্সে ওই তরুণীকে গালিও দেন অনেকে। এবার মুসকানের হিজাব পরার অধিকার নিয়ে কথা বলা মানুষগুলোও নিশ্চুপ। ঠিক যেমনটি ঘটেছিল ভারতের কর্ণাটকের এই হিজাব ইস্যুর সময়। তখনো একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষ হিজাবের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল ।

প্রকৃত অর্থে মানুষ দুটি দলে ভাগ হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে। খুব কম মানুষই সত্যিকার অর্থে নারীর পোশাকের অধিকার নিয়ে কথা বলছে। একদল প্রতিবাদ করছে যখন কেউ হিজাব বা বোরখা নিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, আরেকদল প্রতিবাদ করছে যখন আধুনিক কোনো পোশাকের জন্য কেউ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বস্তুত এককভাবে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলছে এমন মানুষের সংখ্যা নগণ্য।
আমাদের দেশের ধর্মান্ধ একদল মানুষ বলছেন, পর্দা করে চললে নারীর বিপদ হবেনা, যত নষ্টের মূল মেয়েদের আধুনিক ভাবে চলাফেরা। আবার অতি আধুনিকমনস্ক একদল লোক বলছেন, বোরখার মধ্যে নারীকে বেঁধে ফেলা হচ্ছে, বোরখা বা হিজাব পরা নারী আত্মবিশ্বাসী হতে পারে না। একজন নারী স্ব-ইচ্ছায় বোরখা বা স্লিভলেস যাই পরুক না কেন, সমাজের আর পাঁচজনের অভিমত দেওয়ার যুক্তি খুঁজে পাই না।
তামান্না হক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সচরাচর জিন্স টপ্স পরেই অভ্যস্ত তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব একটা কথা শুনতে হয় না, তবে রাস্তাঘাটে প্রায়শই পোশাকের জন্য বিদ্রূপের শিকার হতে হয় তাকে। কিন্তু আমাদের সমাজ যে মনে করে বোরখা পরিহিত নারী এসব দিক দিয়ে নিরাপদ সে ধারণা ভুল প্রমাণ করার জন্য কয়েকদিন আগে একটি লোকাল বাসে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বলি তবে।
ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে এক বোরখা পরিহিত নারীকে ওই বাসের হেল্পার বলে, ‘বোরখা পরাগুলা যে শয়তান হয়, আপনারে দেইখা আরও একবার প্রমাণিত হইলো।’ তার মন্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে বাসে উপস্থিত ৯০ শতাংশ মানুষ হাসাহাসি করলো। তবে আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি সেই ৯০ শতাংশ মানুষের মধ্যে অর্ধেক মানুষই আবার মনে করেন ধর্ষণ হয় নারীর পোশাকের কারণে, বোরখা পরা নারী সমাজের জন্য উপকারী আর যত নষ্টের মূল ওই জিন্স-টপ্স পরা মেয়েগুলো।

সাথী আক্তার, বয়স প্রায় ৬০-এর কাছাকাছি। তার কলেজে পড়াশোনার সময়কার কথা বলেন আমাদের সঙ্গে, ‘আমরা যখন কলেজে পড়তাম, আজ থেকে ৪০-৪৫ বছর আগে, তখনো পোশাক নিয়ে এত বাড়াবাড়ি ছিল না। বাকিদের কথা বাদ দেই, আমি নিজেই কত স্লিভলেস ব্লাউজ পরে কলেজে গেছি। আমার বেড়ে ওঠা সেই একটি মফস্বল শহরে, সেখানে আমি এসব বিষয়ে কোনো সমস্যা তখনকার সময়েই দেখিনি। ‘
৪০-৪৫ বছর আগে দেশ যখন এতটা আধুনিক ছিল না, তখনো যেহেতু পোশাক নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি ছিল না, তবে হঠাৎ করে বর্তমান সময়ে কেন এত বাড়াবাড়ি। নারী কোন পোশাক পরবে তা নিয়ে শুধু অভিমত নয়, অভিমতের নামে নারীর ওপর নিজেদের ইচ্ছে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে কয়েকটি গোষ্ঠী। সেখানে তারা দোহাই দিচ্ছে ধর্ম ও সমাজের।
কিন্তু যখন আঠারো বছর বয়স হওয়ার আগেই জোর করে কাউকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয়, যখন যৌতুকের জন্য দিনভর নারীকে অত্যাচার করা হয়, রান্নায় লবণ কম হলেই গায়ে হাত তোলা হয়, ৫-৬ মাস বয়সের একটি শিশুকে যখন ধর্ষণ করা হয় তখন কারও মনে কোনো প্রশ্নের উদয় না হলেও। নারীর পোশাকের দিকে তাকিয়ে কেন প্রশ্ন আসে, ‘ ওড়না কই?’