কোথাও সে ইভটিজার, কোথাও সে ভাই!
কয়েকদিন আগে একটি বিজ্ঞাপন চোখে পড়লো, যেখানে দেখা যায়, রাতে একা বাড়ি ফিরছিল একটি মেয়ে। কয়েকটি ছেলে মিলে তাকে ধর্ষণ করে নিজ নিজ বাসায় ফিরে যায়। এর মধ্যে একটি ছেলে বাসায় ফিরে দেখতে পায়, তার বাবা-মা চিন্তিত হয়ে বসে আছেন। কারণ তার বোন এখনো বাসায় ফেরেনি। ছেলেটি কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারে, যে মেয়েটিকে তারা দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করেছে, সেটি আর কেউ নয়, তার নিজের বোন।
কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত ছেলেটির কাছে মেয়েটিকে দেওয়ার মতো অনেক দোষ থাকলেও হঠাৎই পুরো চিন্তাভাবনা পরিবর্তন হয়ে যায়। অচেনা কিংবা পরিচিত হলেও যার সঙ্গে কোনো স্বার্থ জড়িয়ে নেই, সেই মেয়ের হাজারটা দোষ একমুহূর্তেই খুঁজে বের করতে পারে পুরুষ সমাজ। আবার ঠিক একইভাবে তার বোন কিংবা সঙ্গে থাকা কোনো বান্ধবী কারও দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেও মুহূর্তেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করাটাও স্বাভাবিক।
এর পেছনে মূলত কাজ করছে আমাদের সমাজব্যবস্থা, আমাদের মানসিক সীমাবদ্ধতা। প্রথমে সমাজব্যবস্থার কথাই বলা যাক। আমরা এমন একটি সমাজে বাস করি, যেখানে ভিকটিম ব্লেমিং একদম চূড়ায়। বিষয়টি কিছুটা ‘যত দোষ, নন্দ ঘোষ’ প্রবাদের মতো। নারী দিনের বেলায় ধর্ষণ হলে তার পোশাক কেমন ছিল তার বিশ্লেষণ, রাতের বেলায় ধর্ষণ হলে পোশাকের সঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন যুক্ত হয়, ‘এত রাতে বাইরে কী?’ এইযে আমাদের সমাজের দাঁড় করানো কিছু প্রশ্ন নারীর প্রতি হয়রানিকে অদৃশ্য সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছে।
শুধু আমাদের দেশে অস্থিতিশীল এক রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে। রাজনীতির নামে দাদাগিরি চলে আমাদের সমাজে। রাজনৈতিক পরিবারের মেয়েদের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকাতে পারবে না ঠিকই। তবে, চাইলে সেসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা কিংবা পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সমাজের অন্য যেকোনো মেয়ের যেভাবে খুশি হয়রানি করতে পারবে। আর এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস সমাজের সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, খোদ প্রশাসনেরও নেই। একইভাবে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত বৈষম্যও কাজ করে।
তারপর আসে আমাদের মানসিকতার প্রশ্ন। সমাজ নামে যতটাই আধুনিক হোক না কেন, আমাদের মস্তিষ্ক দিনের পর দিন সংকীর্ণ হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের মানসিকতা খুব ছোট্ট পরিসরে সাজানো থাকে। যেমন রাস্তায় কাউকে জঘন্যভাবে হত্যা করা হচ্ছে, পাশে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলেও প্রতিবাদ করতে কেউ আসছে না। এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে।
কিছুদিন আগে বাসের মধ্যে হয়রানির শিকার হয়ে প্রতিবাদ করেন এক মেয়ে। তার প্রতিবাদ করার সেই ভিডিওটি ভাইরাল হয় দেশজুড়ে। এ বিষয়ে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় বেশ আক্ষেপের সুরে মেয়েটি বলছিল, যখন তিনি প্রতিবাদ করছিলেন একটি মানুষও এগিয়ে আসেননি। আর এগিয়ে না আসার পেছনের কারণ, প্রত্যেকটি মানুষ হয়তোবা নিজ নিজ আসনে বসে চিন্তা করছিলেন মেয়েটি আমার তো কেউ নয়। এই যে ‘আমার তো কিছু না কিংবা আমার তো কেউ নয়’ বিষয়টি অন্যায়কে কয়েকগুণ বেশি প্রশ্রয় দেয়।
আবার যখন সেই ইভটিজার কিংবা দর্শকের ভূমিকায় থাকা লোকটির বোন, মা, স্ত্রী কিংবা বান্ধবীকে কেউ হয়রানির চেষ্টা করে আর তিনি চিৎকার করেও কারও সহযোগিতা না পান, তখন সমাজের দোষ দিয়ে থাকেন। কিন্তু আসল সমস্যা আমাদের মানসিক সীমাবদ্ধতায়। শুধু অন্যপাশে নারীকে নিজের পরিবার কিংবা পরিচিত কোনো সদস্য ভাবলেই হয়তোবা এই সমস্যা কয়েকগুণ হ্রাস করা সম্ভব।
অনন্যা/এসএএস