নারীর সাজ-পোশাক হোক নিজের পছন্দের
পদাবলীর কবি চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার ওপর নাই।’ কিন্তু বর্তমান যুগে মানুষ নামের মুখোশের আড়ালে ‘বর্বর পুরুষতন্ত্রের রাজত্ব’ চলছে। মানুষকে তার ব্যক্তিগত রুচি-ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে না দিয়ে পুরুষতন্ত্রের খেয়ালিপণার দাসে পরিণত করার হীনচেষ্টা চলছে। এরই অংশ হিসেবে তারা নারী কী পোশাক পরবে, কী পরবে না, তা ঠিক করে দিচ্ছে। কিন্তু নারীর সাজ-পোশাক নির্ধারণ করার অধিকার পুরুষকে কে দিয়েছে?
সব মানুষ স্বাধীন। নারীও তার বাইরে নয়। তবুও নারীকেই প্রতিনিয়ত পুরুষতন্ত্রের কটাক্ষের শিকার হতে হয়। একজন নারী তার স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী পোশাক নির্বাচন করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার পোশাকের বিভিন্ন ক্যাটাগরি করে দেওয়া হয়েছে! সেই ক্যাটাগরির পোশাক বিভিন্ন মানুষ তাদের রুচি অনুযায়ী বিচার করে! যেমন ধর্মগুরুদের কাছে বোরখাটা নারীর সঠিক পোশাক। সাধারণ মানুষের কাতারে যারা, তারা নারীর পোশাক বলতে সালোয়ার-কামিজ, শাড়িকেই বোঝে। তারা নারীকে জিন্স-টপস, শার্টে বেমানান মনে করে। কিন্তু কথা হলো নারীর পোশাক নারীর নিজস্ব আবরণ। সেক্ষেত্রে নারী কিসে স্বচ্ছন্দ্যবোধ করে, সেটাই তো মুখ্য হওয়ার কথা।
নারীর পোশাকের বিষয়ে প্রথম যে বাধা আসে, তা ধর্মগুরুদের বিধিনিষেধ থেকে। সেখানে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান নেই। বরং নারীকে শেকলে বাঁধতেই যেন এ শ্রেণির হম্বিতম্বি!
নারী-পুরুষ মানবজাতির দুই শ্রেণি। এক শ্রেণির জন্য পৃথিবীর সব অনুশাসন আর এক শ্রেণি নিজের ইচ্ছেমতো বসবাস করে। কিন্তু নারী-পুরুষের জীবনযাপনে কোনো পার্থক্য না থাকলে পোশাকের ক্ষেত্রে কেন থাকবে! বরং নারীকে কয়েক দিক বেশি সামাল দিতে হয়। পুরুষের ক্ষেত্রে সংসারের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়াই প্রধান কাজ। কিন্তু একজন নারীকে পরিবারের সব দায়, সংসার-সন্তানকে সামলানো ছাড়া আরও কিছু দায়ও পালন করতে হয়। তার ওপর চলাফেরায় স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টিও নারীকে মাথায় রাখতে হয়।
যে যেভাবে নিজেকে সাজাতে চায়, নিজের কাজের সুবিধার্থে ও নিজের রুচি-ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে চায়, তাকে সেভাবে থাকতে দেওয়া উচিত। আর পোশাক তো পোশাকই; তা নিয়ে এত টিপিক্যাল ভাবনার কী আছে! নারীকে লৈঙ্গিক পরিচয়ে বা খণ্ডিত পরিচয়ে নয় বরং মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেখা উচিত।
সারাবিশ্ব যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছে, বাঙালি পুরুষতন্ত্র সেখানে পড়ে আছে নারীর পোশাক ও সাজসজ্জার পেছনে। পাশের বাড়ির কোন মেয়ে কী পোশাক পরে বাইরে বের হলো, তাতেই বাঙালি পুরুষের চোখ আটকে থাকে। নারীর পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে জবরদস্তির অন্ত নেই তাদের।
নারী পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ির শুরুটা মূলত পরিবারে। মেয়েকে সুপাত্রের হাতে দিতে হলে তার পোশাক-আশাককে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, এই ভাবনায় পরিবারগুলো সারাক্ষণ তটস্থ থাকে। তাদের কাছে পোশাকই যেন নারীর চারিত্রিক সনদ! তাই পরিবারের সদস্যদের পছন্দ-অপছন্দকে নারী গুরুত্ব দিতেই বাধ্য হয়। তাই স্কুলগামী ছোট্ট বাচ্চাকেও জবড়জং পোশাক পরিয়ে পথে নামানো হয়, তাতে করে সে কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করছে, তার ওপর কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। মেয়ে সুশীল, ভদ্র, সেই তকমা তো জুটছে।
পারিবারিক ঐতিহ্য নারীর পোশাক নির্বাচনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। মা-দাদি-চাচি কিভাবে তাদের জীবন-যাপন করে এসেছে, সেভাবেই পরবর্তী প্রজন্মকেও চলতে বাধ্য করা হয়।
এরপর আছে কর্মক্ষেত্র। কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নারী সহকর্মীদের পোশাক কী হবে, তা নির্ধারণ করে দিতে চায়। পোশাক তাদের পছন্দের না হলে নারীকে প্রায় কটাক্ষ করা হয়। বিদ্রূপের বাণে বিদ্ধ করে দেওয়া হয়। বিষয়গুলো এতটাই কৌশলে ঘটে যায় যে, প্রতিবাদ করার সুযোগ-সাহসটুকু ভুক্তভোগী নারীর প্রায় থাকে না।
সামাজিক প্রথা প্রথা-রীতি অনুযায়ীও নারীর পোশাক নির্বাচন করা হয়। কিন্তু এখানেও সেই একই কথা, নারী তার নিজের স্বাচ্ছন্দ্যকে গুরুত্ব দেবে, এটাই আশা। নিজের রুচির মূল্য কোথায় তাহলে! নারী তো আগে মানুষ, তাই তার প্রতি শ্রদ্ধা -সম্মান দেখানো উচিত। নারীর নিজের জীবনকে তার মতো সাজাতে সাহায্য করতে পারি, কিন্তু তার রুচিকে কটাক্ষ কিংবা বিদ্রূপ করতে পারি না।