মহাভারতের সিঙ্গেল মাদার হিড়িম্বা
‘যা নেই ভারতে, তা নেই মহাভারতে’
কথাটি বহুল প্রচলিত। এই বিশাল জাত মহাকাব্যে চরিত্রের ছড়াছড়ি। মহাভারতে আমরা পরিচিত হই অসংখ্য বীরের সঙ্গে। কিন্তু মহাভারতের অন্যতম মূল আকর্ষণ এর নারী চরিত্ররা। এখানে দ্রৌপদীর মতো নারী চরিত্র যেমন আছে, তেমনই আছে হিড়িম্বার মতো অবহেলিত চরিত্রও।
অথচ হিড়িম্বা যেন আমাদের আধুনিক সময়ের এক নারী চরিত্র। সেটা কিভাবে? হিড়িম্বার জীবনকে লক্ষ করলে মনে হবে, সে যেন আধুনিক সময়ের এক সিঙ্গেল মাদার। অথচ এই বর্ণিল চরিত্রটিকে যেন অনেকটা ছায়ায় রেখে দেওয়া হয়েছে মূল কাব্যে।
শুধু তাই নয়। মহাভারতে হিড়িম্বাকে অনেকটা উপেক্ষা, অনাদর ও অসম্মানেই রেখে দেওয়া হয়েছে। মধ্যম পাণ্ডম ভীমের এই স্ত্রীর চরিত্রকে খুব বেশি আলোতে আনা হয়নি। সেটা কেন হয়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন করে লাভ নেই।
তবে হিড়িম্বার চরিত্রটি যেন আধুনিক নারীর অসংখ্য চিহ্ন বহন করে। এটুকু নিশ্চিত হিড়িম্বা অন্তত আর্য ছিলেন না। মেগাস্থিনিসের বিবরণ অনুযায়ী ভারতে তখন কিছু অর্ধ-যাযাবর জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। আর্যরা সচরাচর অনার্যদের মানুষ হিসেবে গণ্য করতো না। সেই অনার্য মানুষদেরই প্রতিভূ হিড়িম্বা।
মহাভারতে হিড়িম্বার গল্পটিও যেন অদ্ভুতভাবে শেষ হয়। তাও কিনা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ঘটোৎকচের আগমনের জন্যেই হিড়িম্বাকে ব্যবহার করা। জতুগৃহ পুড়ে গেছে। পাণ্ডবরা বারানাবত নগরী থেকে বের হয়ে গঙ্গা পার হলো। দক্ষিণ দিয়ে যেতে যেতেই এক সময় তারা এক জঙ্গলে প্রবেশ করলো।
এই বনে হিড়িম্ব আর হিড়িম্বার বাস। জতুগৃহে মৃত্যুর থেকে মুক্তি পেয়ে এই প্রথম আশঙ্কামুক্ত হতে পারে পাণ্ডরা। মানসিক চাপ, পথচলার ক্লান্তি, আর একটানা জেগে থাকায় সবাই অবসন্ন। এসময় কুন্তি, ধ্রুপদী ও পাণ্ডবরা বিশ্রামের জন্যে থামে। সবাই ঘুমিয়ে গেলো। জেগে রইলো শুধু ভীম। ভীম সহজে ক্লান্ত হতো না। পাণ্ডবদের আগমণের কথা জানলো রাক্ষস হিড়িম্ব। বিনা অনুমতিতে এই প্রবেশ তার ভালো লাগেনি। বোন হিড়িম্বাকে আদেশ করলো পাণ্ডবদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিতে। হিড়িম্বা গিয়ে দেখলো ভীম বাদে সবাই ঘুমিয়ে আছে। ভীমের রূপ দেখে মুগ্ধ হিড়িম্বা।
এখানেই হিড়িম্বার চরিত্র যেন নতুন মোড় নেয়। ভীমের প্রতি মুগ্ধ হয়ে সে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ভীম অবাক। এত বছরের ক্ষত্রিয় জীবনে কোনো নারী বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে, এমনটাই বা কে শুনেছে?
ভীম বোঝালো, নিজের পরিবার ছেড়ে সে আলাদা হতে পারবে না। এমন সময় বোনের দেরি দেখে হিড়িম্ব নিজেই অকুস্থলে চলে আসে। বোনের এই প্রেম সে মেনে নিতে পারেনি। বোনকে মারতে উদ্যত হতেই ভীমের সঙ্গে তার প্রাণপণ যুদ্ধের শুরু। ভীমই অবশ্য বিজয়ী হয়। হিড়িম্বকে হত্যা করে। হিড়িম্বা অবশ্য ভাইয়ের হত্যাকারীকে ঘৃণা করতে পারলো না। বরং তার ভালোবাসা আরও বাড়তে থাকে।
হিড়িম্বার সঙ্গে ভীমের বিয়ে হয়। এই অরণ্যেই তারা আগামী এক বছর দিনাতিপাত করে। হিড়িম্বা পাণ্ডবদের জন্যে কুঁড়েঘর নির্মাণ করে দেয়, এমনকি তাদের সেবা-যত্নও করে। অবশেষে পাণ্ডবরা যখন সময় শেষে ফিরে যেতে উদ্যত হয়, তখন হিড়িম্বাকে যেন অবহেলাই করা হয়। দ্রৌপদী তো বলে, ‘তোমার সঙ্গে হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না। কিন্তু তোমার এই আতিথেয়তার কথা কোনোদিন ভুলবো না।’
বিপদে যার আশ্রয় নেওয়া হলো। ঠিক সুখের সময় তাকে ভাগ দেওয়া হলোনা। হিড়িম্বা একাই নিজের সন্তান ঘটোৎকচকে বড় করলো। শেখালো মায়াবিদ্যা ও যুদ্ধবিদ্যা। আর যখন সময় এলো সন্তানকে পাঠিয়ে দিলো যুদ্ধে। সেই সন্তানও আর ফিরে এলো না।
পাণ্ডবরা হিড়িম্বা থেকে শুধু কেড়েই নিয়ে গেছে। হিড়িম্বা যে কিনা ভীমের প্রতি মুগ্ধতা স্বীকার করেছে এবং সন্তানের দায়ভার নিজের কাঁধেই চাপিয়ে নিয়েছে, কোনোদিনই জানা সম্ভব হয়নি, একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর সংবাদ আদৌ এই সাহসী মায়ের কানে গেছে কি না। তবে মহাভারতের মাঝে যেন এক আধুনিক সিঙ্গেল মাদার হিড়িম্বা। এক স্বাবলম্বী ও আত্নপ্রত্যয়ী নারী।