সাদাকালো যুগের সাবিত্রী আজও রঙিন
উত্তম-সুচিত্রাদের যুগের সেই সাদাকালো সিনেমার খোঁজ আজকাল খুব কম মানুষই রাখে। তবে উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেনের নাম কিন্তু কেউ ভোলেনি। উত্তম সুচিত্রার নাম যেমন অনায়াসেই সবার মনে রয়েছে, তেমনি ওই সময়ের আরও অনেক নায়ক-নায়িকাদের নামও বর্তমান প্রজন্ম জানে না বললেই চলে। তেমনই একজন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। বাংলা সিনেমার একসময় তার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে, তবে বয়সের ভারে আজ অনেকটায় ম্লান সে জনপ্রিয়তা। কিন্তু তিনি এখনো সমান তালে তার অস্তিত্বের জানান দিয়েই যাচ্ছেন।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, কুমিল্লায়। ঢাকার কমলাপুরে কেটেছে তার শৈশব। বাবা ছিলেন রেলের স্টেশনমাস্টার। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারতে চলে গিয়েছিলেন কিশোরী বয়সে। দুই বোনকে তাদের বাবা কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। উঠেছিলেন দিদির বাড়ি কলকাতার টালিগঞ্জে। সেখানে অবশ্য বেশ টানাপড়েনে কাটতে থাকে তার জীবন। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি টান আর অর্থ রোজগারের তাগিদ দুটো মিলেই তাকে নিয়ে আসে অভিনয় জগতে।
একসময় বড় পর্দা কাঁপানো এই অভিনেত্রীর অভিনয়ের শুরুটা হয়েছিল নাটক দিয়ে। তার প্রথম সুযোগ আসে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। নতুন ইহুদি নামের একটা নাটক দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। ভাগ্যও তাকে সায় দেয় শুরুতেই। নাটক করতে করতেই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ডাক পান তিনি। ১৯৫১ সালে অগ্রদূত পরিচালিত ‘সহযাত্রী’ ছবিতে অভিনয় করেন সাবিত্রী। ছবিতে নায়ক উত্তমকুমারের পার্শ্বনায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। এরপর আসে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয়ের প্রস্তাব। চলচ্চিত্রের নাম ‘পাশের বাড়ি’। তবে এখানে বাদ সাধলো তার বাঙাল উচ্চারণ। পরিচালক তার উচ্চারণের জন্য বাদ দিলেন সিনেমা থেকে।
কিন্তু ওই যে বললাম, ভাগ্য তাকে শুরু থেকেই সায় দিচ্ছিল। ‘পাশের বাড়ি’ সিনেমাটির জন্য আর কোনো অভিনেত্রীকে না পেয়ে শেষমেশ আবারও সাবিত্রীর শরণাপন্ন হন পরিচালক। তবে এ সিনেমার শুটিং চলাকালে দেখা যায় আর এক সমস্যা। হুট করেই বন্ধ হয়ে যায় শুটিং। নতুন করে শুটিং শুরু হতে কিছু সময় লাগে। সে দিনগুলো অবশ্য বেশ কষ্টেই পার করতে হয় সাবিত্রীকে। তবে সব কষ্টের অবসান ঘটে সিনেমাটি মুক্তির পর। প্রথম ছবিতেই দুর্দান্ত অভিনয় করে সবার মন জয় করেন তিনি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
এ যাবৎ ৬০-এর বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, সুভদ্রা, অনুপমা, দুই ভাই, ধন্যি মেয়ে, মাল্যদান, নিশিপদ্ম, ডাক্তারবাবু, গলি থেকে রাজপথ, হাত বাড়ালেই বন্ধু ইত্যাদি। বয়স্ক অভিনেত্রী হিসেবেও বেশ কয়েকটি কাজ করেছেন এবং তা জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে। হাইওয়ে, হেমলক সোসাইটি, প্রাক্তন সিনেমাতে তার অভিনয় মন কেড়েছে দর্শকদের। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় পেয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘পদ্মশ্রী’, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’সহ নানা পদক ও সম্মাননা।
তার সিনেমা, অভিনয় নিয়ে যেমন তিনি আলোচনায় ছিলেন তেমনই ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও বেশ আলোচনায় ছিলেন তিনি। সে আলোচনা অবশ্য আজও চলমান। উত্তম-সুচিত্রা জুটি তখন যেমন জনপ্রিয় ছিলো, শেষের দিকে তেমনই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো উত্তম-সাবিত্রী জুটি। হাত বাড়ালেই বন্ধু, দুই ভাই, নিশিপদ্ম ইত্যাদি সিনেমায় তাদের অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করে। শুধু রিল লাইফে নয় , তাদের নিয়ে বেশ চর্চা শুরু হয়েছিল রিয়েল লাইফেও।
অনেকের মতে, উত্তম কুমার ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তবে উত্তম কুমার বিবাহিত ছিলেন বিধায় তা পরিণয় লাভ করতে পারেনি। এসব কথা অবশ্য কখনই মুখ ফুটে স্বীকার করেননি নায়ক-নায়িকা কেউ। তবে বর্তমানে জীবনের ৮৫টি বসন্ত কাটিয়ে এসেও অবিবাহিত রয়ে গেছেন সাবিত্রী। তাই তো এসব প্রশ্ন আজও তার পিছু ছাড়ে না।
কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাকে উত্তম কুমারের সঙ্গে প্রেমের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, ‘প্রেম তা ছিল তো খানিকটা। তবে রটনাটা বেশি, আসলটা কম। যেটা শোনা গিয়েছিল যে, আমায় বিয়ে করে বালিগঞ্জে বাড়ি ভাড়া করে আছে, যা নিয়ে ঝড় বয়ে গেলো, সেসব কিন্তু কিচ্ছু না। ‘
এই বয়সে এসেও থেমে নেই বাঙালিদের একসময়কার হার্টথ্রোব অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। ছোটপর্দার নিয়মিত মুখ বলা চলে তাকে। বড় পর্দায়ও মাঝেমধ্যেই ধামাকা নিয়ে হাজির হন। বারবার প্রমাণ দেন বয়স বেড়েছে শরীরের, আর ধারালো হয়েছে অভিনয় দক্ষতা।
অনন্যা/জেএজে