বন্দনা শাহ’র ডিভোর্স
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। এই সেদিনও ভারতবর্ষের একজন নারীকে আমরা অবলা হিসেবে দেখতেই অভ্যস্ত ছিলাম। সেদিনও তাকে মারা যেতো, অত্যাচার করা যেতো, কথা শোনানো যেতো, এমনকি রাতে ঘর থেকে বের করে দেওয়া যেতো।
যেহেতু গভীর রাতে নারীকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া যেতো, সেহেতু এখানে সম্মান নিয়ে টানাটানি চলে। এমন একটা ধারণা বন্দনা শাহ কেন যে মনের ভেতর লালন করলেন, ঠিক নিজেও বুঝতে পারলেন না। মাথার ওপর কেমন গুমোট আকাশ! শহরের আলো আস্তে আস্তে নিভে যেতে শুরু করেছে। রাস্তার নিভু নিভু আলো যেন আরও বিষণ্নতা নামিয়ে আনছে। আকাশে হয়তো তারাও নেই কিংবা শহরের আলোর ছানি এঁটে বসে আছে।
রাত দুইটা। রাস্তায় কয়েকটা কুকুর কৌতূহল নিয়ে তার দিকে তাকায়। আবার সামনে আগন্তুক কুকুরকে দেখেই তেড়ে যায়। বুক-ফুঁড়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। দশ বছরের সমান দীর্ঘশ্বাসে আক্ষেপের থেকে ক্ষোভ বেশি। একটু অনিশ্চয়তা ঠিকই আছে। নিজের কাছে পার্সে আছে মাত্র সাড়ে সাত শ রুপি। সামনে বা পেছনে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
কিন্তু বিপদ কিংবা আশঙ্কার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা বন্দনার মজ্জাগত। বাবা ছিলেন ফাইটার প্লেন চালক। বিমান বাহিনী থেকে যখনই আসতেন, তখনই মেয়েকে নিয়ে গল্প করতেন। সেগুলো মনে পড়তে একটু মুচকি হাসি পেলো। বিপদ জীবনের অনিবার্য অংশ, নিজেকে নিজেই শোনান তিনি।
এবার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে। নতুন? নতুন করে কিভাবে করে সব? নারীর সেই পথ নেই। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে নতুন করে আবার ভাবতে শুরু করেন। এবার ভাবছেন, ‘দশ বছর মুখ বুজে আমাকে যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। অবশেষে যে মুক্তি মিলেছে, তার সুযোগ নিতে হবে।’
উপমহাদেশে নারীরা কখনো ডিভোর্সের বিষয়ে ভাবেনি। বরং তারা ভেবেছে সবকিছুকে গুছিয়ে নিতে। মানিয়ে নিতে। বন্দনাই ভারতবর্ষের প্রথম নারী, যিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন একজন ডিভোর্স লয়ার হিসেবে। একজন নারী ডিভোর্স চাইতে পারে। নারীর ডিভোর্স চাওয়ার পেছনের কারণকে বিভিন্নভাবে দেখাতে চাইলেন তিনি। সেজন্যে পথ কী? বন্দনা এমনিতে একজন আইনজীব । তবে স্বামীর ঘর করতে গিয়ে তেমন মনোযোগ দেওয়া হয়নি।
এবার আবার নতুন করে আইন-চর্চা শুরু করলেন। এরই মাঝে পত্রিকার কলামে নিজস্ব অভিমত দিতে শুরু করলেন। একই সময়ে লিখতে থাকলেন বই। পরবর্তী সময়ে ‘এক্স-ফাইলস: দ্য স্টোরি অব মাই ডিভোর্স’ নামে একটি বই লিখলেন। নারীর ডিভোর্সকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখায় রাতারাতি বইটি বিশেষজ্ঞদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। দ্রুত জুডিশিয়াল কলেজগুলোতে বইটি পাঠ্য করা হয়।
ভাগ্যিস ২৮ বছর বয়সে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। বন্দনা যেন নতুন উদ্যমে কাজ চালাচ্ছিলেন। ১৫ বছর আগের সেই রাতের কথাটি এখনো তার মনে পড়ে। পুনে আর মুম্বাইয়ে হাই-প্রোফাইল কেস সামলানোর সময় তার মনে পড়ে প্রতিটি ঘটনা।
সে গল্পটাও তিনি স্পষ্টভাবে ‘থ্রি সিক্সটি ব্যাক টু লাইফ’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন। বেশ কয়েক বছরে নিজ উদ্যোগেই অত্যাচারিত বা বৈবাহিক অশান্তিতে ভুগতে থাকা নারীদের জন্যে গড়ে তুললেন সংগঠন। নিজ উদ্যোগে নির্মাণ করলেন ডিভোর্স-কার্ট। এই অ্যাপটি ব্যবহার করে ভারতের নারীরা তাদের অত্যাচারের জন্যে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে।
বন্দনার জগৎ মোটেও সচেতনতা বৃদ্ধির কথা বলায় না। বরং কোনো ভুলকে সংশোধনের প্রচেষ্টা মাত্র। শূন্য থেকে নিজেকে গড়ে তোলাটা সহজ না। নারীর আইনি প্রক্রিয়ায় দাঁড়ানোর জন্যে সাহস জোগানোর এই কারিগর এখনো প্রান্তিক ও নারীদের মুক্তির জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন। তার একটি উক্তিই যেন সব কথা বলে, ‘বন্দর কোর্টে প্রতিদিন একটি ফ্লোরে ৬০টি ডিভোর্স কেস আসে। বন্দর কোর্ট ৭ তলা উঁচু ভবন। তারমানে রোজ ৪২০ টি ডিভোর্স ফাইল হয়। এরমাঝে কিছু কিছু আছে সত্যিই অশান্তির দীর্ঘ রেশে যতিচিহ্ন দিতে আসা। নারীকে নিজের শান্তি নিজেকেই আদায় করতে হবে। কারণ প্রত্যেক পুরুষের সাফল্যের পেছনে একজন নারী থাকলেও নারীর অশান্তির জন্যে অনেক সময় নারীই দায়ী থাকে।’
অনন্যা/এআই